প্রকাশ : ১৪ জুলাই ২০২১, ০০:০০
পর্ব-২০
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যদি সমন্বয় থাকে তবে সে এলাকায় শিক্ষার মানও ভাল থাকে। কিন্তু চাঁদপুর শহরের তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় বা ভাল সম্পর্কের অভাব প্রকট ছিলো। এমনটি হয়েছে অধ্যক্ষদের সমন্বয়হীনতার কারণে। তিন কলেজের অধ্যক্ষদের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াই ছিল। যে কারণে একটু সুসম্পর্কের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। যার ফল গিয়ে পড়েছে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর। কোনো কোনো সময় শিক্ষকরাও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। তবে আমার সাথে তিন কলেজের শিক্ষকদের সাথেই একটি ভালো সম্পর্ক ছিলো।
আমাদের কলেজটি বেসরকারি হওয়ার কারণে আমরা সবসময় চেষ্টা করতাম কিভাবে ভালো ফলাফল করা যায়। এসএসসি’র ফল প্রকাশের পর ভালো ছাত্র-ছাত্রীদের আমাদের কলেজে ভর্তির চেষ্টা করতাম। এতে ফলও হয়েছে। শহরের ভালো স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা পুরাণবাজার কলেজে ভর্তি হতে থাকে। এর ফলও পাওয়া গেছে। ২০০২ সালে পুরাণবাজার কলেজ থেকে কুমিল্লা বোর্ডের মেধা তালিকায় ১০জন স্থান করে নিয়েছে। এভাবে প্রতিবছরই আমাদের কলেজের ফলাফল ভালো হতে থাকে। কিন্তু সরকারি কলেজের দুই অধ্যক্ষ বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। তবে সরকারি কলেজের অনেক শিক্ষক আমাদের ফলাফলে প্রশংসা করেছেন। এমনকি তাদের সন্তানদেরও আমাদের কলেজে ভর্তি করাতেন। এতে করে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ পড়েছে বিপদে। তাদের ছাত্রী সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছায়। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি যত্ন নিলে, অভিভাবকদের কাছে দায়বদ্ধ থাকলে ভালো ফলাফল হবেই। যেটার অভাব ছিলো সরকারি দুটি কলেজে।
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের সম্পর্কে সবারই একটা নেতিবাচক মনোভাব ছিলো। এর যৌক্তিক কারণও ছিলো। অধিকাংশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ব্যবসায়িক মনোভাবাপন্ন। ছাত্রের কল্যাণের চেয়ে অর্থের প্রতি ঝোঁকটা ছিলো বেশি। সেটা এখনও আছে। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের দেখতাম, এসএসসির রেজাল্ট দেয়ার পর থেকেই প্রাইভেট পড়ানো শুরু করতেন। তারা সিলেবাসের এ-টু জেড পর্যন্ত প্রাইভেট পড়াতো। এর কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে করি না। প্রাইভেট পড়ানোর ধারাটা বহু আগেই ছিল। তবে এখনকার মত ছিল না। ষাট-সত্তরের দশকে সিলেবাস শেষ হয়ে গেলে যে যে চ্যাপ্টারগুলো কোনো কোনো ছাত্রের কাছে বোধগম্য হতো না সে চ্যাপ্টারগুলো প্রাইভেট পড়ে নিতো। বিজ্ঞানের প্রতি বিষয়ে বড় জোর দুই মাস প্রাইভেট পড়তো। কিন্তু এখন দুই বছরের সেশনে ২৪ মাসই প্রাইভেট পড়ানো হয়। আমি এটাকে বলি ছাত্ররা প্রাইভেট পড়ে না, শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করে।
বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে ছাত্র এবং অভিভাবকদের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারণা আছে এই যে, এ বিভাগে পড়তে হলে সকল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে হবে। কথাটা যে মিথ্যা সেটাও নয়। যদি একজন ছাত্র একটি বিষয়ে সারাবছরই প্রাইভেট পড়তে হয় তবে কলেজের প্রয়োজন আছে কি? এতে করে অসচ্ছল পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের সম্পর্কে আরেকটি নেতিবাচক ধারণা আছে, যদি কেউ প্রাইভেট না পড়ে তবে তাকে ব্যবহারিক পরীক্ষায় নাম্বার দেয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এটারও সত্যতা আছে। একজন শিক্ষক হিসেবে এ জিনিসটা আমাকে খুব পীড়া দিতো। একজন ছাত্র শিক্ষকের কাছে পড়লে তাকে বেশি নাম্বার দেয়া হবে আর না পড়লে কম নাম্বার দেয়া হবে, যাতে শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। ছাত্ররা কিন্তু সবই বোঝে, কিন্তু শ্রদ্ধার কারণে হয়তো কিছু বলে না। মুখ বুঁজে সহ্য করে যায়। আরেকটা বিষয় দেখেছি, ব্যবহারিক পরীক্ষা আসলেই কে কোন্ কলেজে বহিঃ পরীক্ষক হয়ে যাবে তার একটা প্রতিযোগিতা লেগে যায়। এটারও কারণ প্রাইভেট ব্যবসা। আমি এটাকে প্রাইভেট ব্যবসাই বলবো। অর্থের বিনিময়ে যে শিক্ষা তাকে তো শিক্ষা-ব্যবসাই বলা যায়। যে সমস্ত শিক্ষক প্রাইভেট ব্যবসার সাথে জড়িত সেসব শিক্ষককে কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। এটাই অনেক শিক্ষক বুঝতে চেষ্টা করে না।
প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে আবার শিক্ষকদের মধ্যে থাকে প্রতিযোগিতা। এ কথাগুলো আমি অকপটে এখানে বলে গেলাম। হয়তো এর জন্যে অনেকেই রুষ্ট হবেন। কিন্তু সাদা চক্ষু দিয়ে একবার দেখুন কথাগুলো সত্য কিনা? সত্য যত কঠিনিই হোক বলা উচিত। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলতেই হবে। যে শিক্ষক বেশি প্রাইভেট পড়ায় সে শিক্ষক তত ভাল এমন একটি ধারণা অনেকের মধ্যে আছে। শিক্ষাটাকে আমরা শিক্ষকরাই পণ্য করে ফেলেছি। কোন্ ছাত্র কোন্ শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে তা নিয়েও দ্বন্দ্ব আছে নিজেদের মধ্যে। শিক্ষকতা পেশাটাকে আমরা কোন্ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছি নিচের ঘটনাগুলো তা প্রমাণ করে।
একদিন দেখলাম একজন শিক্ষক তার প্রাইভেট পড়ানো ছাত্রদের নিয়ে নৌবিহার করছে। আরেকজন শিক্ষককে দেখলাম তার বিবাহবার্ষিকীতে ছাত্ররা পার্টি দিচ্ছে। শিক্ষকের ছেলের জন্মদিনে ছাত্ররা পার্টি দিচ্ছে। যে সমস্ত শিক্ষক আত্মমর্যাদাহীন তারাই এগুলো করতে পারে। এ সবের পেছনের কারণ হলো, ব্যবসায়িক মনোভাব। শিক্ষা বাণিজ্য। ছাত্রদের সাথে শিক্ষকের আত্মিক সম্পর্ক থাকবে, তবে সেটারও একটা সীমারেখা থাকবে বলে মনে করি। সেই সীমাটা যখন অতিক্রম করবে তখন আর ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক থাকে না। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক থাকবে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা বন্ধুত্বের সীমারেখার মধ্যে। তা হলে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃত ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। ছাত্রের বিদেশী পিতার কাছে শিক্ষক যখন গিফট্ চায় তখন শিক্ষক হিসেবে লজ্জিত হই। জনপ্রিয় শিক্ষক মানে ছাত্র-ছাত্রীর সাথে সম্পর্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় সেটা নয়। জনপ্রিয় শিক্ষক মানে যে শিক্ষকের আত্মমর্যাদা আছে, যে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের হিত কামনা করে, জনপ্রিয় শিক্ষক মানে যিনি ছাত্রদের নৈতিক শিক্ষা দান করেন।
আমরা শিক্ষকরা প্রায়ই একটা কথা বলি, শিক্ষকতায় এখন সম্মান নেই। থাকবে কিভাবে বলুন। আমরা শিক্ষকরা আমাদের পেশার প্রতি কতটুকু মর্যাদাশীল? সে প্রশ্নটা কিন্তু চলে আসে। আমরা শিক্ষকরাই অনেকে ব্যবসায়িক মনোভাব নিয়ে শিক্ষা দান করি। আমরা শিক্ষকরাই সকল ছাত্র-ছাত্রীকে সমান চোখে দেখি না, আমরা শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের প্রতি অমানবিক আচরণ করি। আমরা শিক্ষকরাই কেউ কেউ ছাত্রদেরকে অনৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকি। এই যদি হয় বর্তমান অনেক শিক্ষকের নৈতিক অবস্থা তবে শিক্ষকদের প্রতি সমাজের শ্রদ্ধাবোধ থাকবে কিভাবে? তিনিই হবেন সমাজের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক, যিনি সবসময় ছাত্রদের হিত কামনা করবেন, নিজ সন্তানের মত মনে করবেন। যেমন স্নেহ করবেন তেমন শাসনও করবেন। যে ছাত্রের ব্যথায় শিক্ষক ব্যথিত হয় না তাকে আমি শিক্ষক বলতে নারাজ। যে শিক্ষকের কাছে ছাত্র-ছাত্রীদের মান-সম্মান, অধিকার, আত্মমর্যাদা, সুরক্ষিত থাকবে তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। বর্তমানে অনেক শিক্ষকের মধ্যে এ জিনিসগুলোর অভাব দেখি প্রকট। (চলবে)