শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২১, ০০:০০

বিম্বিত বীক্ষণ
অনলাইন ডেস্ক

পর্ব-১৯

পরীক্ষায় ভিজিল্যান্স টীমে কাজ করতে গিয়ে চাঁদপুর জেলার অধিকাংশ স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের সাথে পরিচয় হয়েছে। কেউ ভালোভাবে নিয়েছেন কেউ খারাপভাবে নিয়েছেন। সেটা বুঝতে পারতাম। কিন্তু আমি আমার অবস্থান থেকে একটুও বিচ্যুত হইনি। ২০০০ সালের দিকে আমার প্রতি অলিখিত নির্দেশ ছিলো আমি যেনো একা জেলার কোথাও না যাই। কারণ নকল প্রতিরোধ করতে যাওয়ায় অনেকেরই আমার ওপর ক্ষোভ ছিলো। হয়তো সে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারে। আমার চলাফেরাটাও অনেকটা সীমিত হয়ে গেলো। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব অনেকেই পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, মানুষের রোষানলে থাকার কী প্রয়োজন! আপনি একা দেশ উদ্ধার করবেন? অধিকাংশ ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক নকল চায়, এমনকি অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিও নকল চায়। আপনি কেনো মানুষের টার্গেট হবেন? আমি যে বিষয়গুলো বুঝতাম না সেটাও নয়। কিন্তু বিবেক সায় দিত না বলে আমার অবস্থানে অনড় থাকলাম।

২০০০ সালের দিকে জেলা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই বদলি হয়ে চলে গেলেন। নতুন অফিসাররা আসলেন। তারাও এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তেমন একটা আন্তরিকতা ছিলো না। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসলেন জনাব আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম। বর্তমানে সচিব হয়ে অবসরে গেছেন। অসম্ভব রকমের একজন সৎ, দক্ষ এবং ভালো মানুষ। আমি নানা কারণে তাঁর সাথে কাজ করতাম। প্রায়ই তিনি আমাকে খবর দিয়ে নিয়ে যেতেন এবং দুই জনে মিলে গাড়িতে করে গ্রামের দিকে চলে যেতাম। গ্রামে গিয়ে কোনো টং দোকানে বন রুটি এবং চা খেতাম। গল্প করতেন, অবসরে গিয়ে পুকুরে মাছ চাষ করবেন, কৃষি করবেন ও ফল বাগান করবেন, হাঁস-মুরগী পালন করবেন। অনেকদিন পর্যন্ত যোগাযোগ নেই। জানি না তিনি এখন কোথায় আছেন।

ভিজিল্যান্স টীমে আমি এবং চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ছিলাম ওনার টীমের সদস্য। যতটুকু মনে পড়ে, একবার মতলব গিয়েছিলাম ফরাজিকান্দি মাদ্রাসা কেন্দ্রে। দুই বছর নকল প্রতিরোধ করার পরও তেমন একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হলো না। মাদ্রাসার হুজুররা অনেক আপ্যায়ন করেন। কিন্তু আপ্যায়ন করুক আর যাই করুক নকলে কোনো ছাড় নেই। তারা হয়তো ভেবেছিলেন একটু খাতির-যত্ন করবো। কিন্তু ফল হয়েছে বিপরীত। যারা একটু খাতির-যত্ন করতো, বুঝতাম সেখানে উদ্দেশ্য আছে। ফরিদগঞ্জে পরীক্ষার ডিউটি করতে গিয়ে এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। পরীক্ষা শুরু হলে প্রথম অবস্থাতেই ছাত্রদেরকে অবৈধ কোনো কাগজ আছে কিনা তা দিয়ে দেয়ার জন্যে বল্লাম। এরপর একজন শিক্ষককে দিয়ে দেহ তল্লাশি করে দেখা হতো কারো কাছে নকল আছে কিনা। পরীক্ষা শেষে ইউএনও সাহেবের বাসায় দুপুরের লাঞ্চ করতে এসে এক বিব্রতকার অবস্থায় পড়লাম। লাঞ্চ শেষে ইউএনও সাহেব অভিযোগ করে বল্লেন, ‘আপনি তো আমার ছেলের দেহ তল্লাশি করেছেন।’ এডিএম স্যার তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন, পরীক্ষার হলেতো সবাই ছাত্র। তিনি এতেও সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। আমি উনাকে বুঝনোর চেষ্টা করলাম, পরীক্ষার হলে সবাই ছাত্র। আমি আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি মাত্র। আপনার ছেলে যদি অসদুপায় অবলম্বন করতো অবশ্যই আমার হাতে বহিষ্কৃত হতো। পরীক্ষার হলে ইউএনও সাহেবের ছেলে বলে তাকে ব্যতিক্রম ভাবার কি কোনো কারণ আছে? মনে হলো তার ক্ষোভটা আমার উপর আরো বেড়ে গেল। তবে আমি এসব থোরাই কেয়ার করি। আমাদের এই তিনজনের টীমটার মধ্যে একটা ভাল সমন্বয় ছিলো। যাওয়া আসার পথে নানা রকম গল্প হতো। কাজী শাহাদাত ভাই রাশভারী মানুষ। তবে সময় খুব মানতেন। আমাদের যখন রওয়ানা দেয়ার সময় তিনি সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে যেতেন। যেটা আমিও করতাম। এখনো তিনি সে ধারা ধরে রেখেছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে রসিকতাও করতেন। সে দিনগুলোর কথা মনে হলে অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এ জীবন চলার পথে কত ভালো এবং খারাপ মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, তাতে আর কিছু না হোক অভিজ্ঞতার ভা-ার সমৃদ্ধ হয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো তখন লিখে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতাম। তারা ছাপাতোও। এতে কিছু পয়সাও পেতাম। জনকণ্ঠে পাঠালে তারা ছাপতো এবং পারিশ্রমিকও দিতো। তখন থেকেই লেখালেখিতে উৎসাহ পেতাম।

পরীক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছিলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমি বারবারই একটা কথা বলতাম, নকল বন্ধ হলে কী হবে, পরীক্ষাকেন্দ্রিক দুর্নীতি বন্ধ হবে কিভাবে? সেটা বন্ধ না হলে নকল বন্ধ করা যাবে না। ফরম পূরণের সময় এবং প্রবেশপত্র দেয়ার সময় কেন্দ্রগুলো ছাত্রদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিতো। তবে কথিত ছিলো, এ টাকার ভাগ উপর পর্যন্ত যেতো। এ অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে স্বার্থ ছিলো ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, বোর্ড এবং প্রশাসিনিক কর্মকর্তা পর্যন্ত। এগুলো বন্ধ না করলে নকল বন্ধ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সৎ হলে হবে না, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও সৎ হতে হবে। তবেই ফল পাওয়া যাবে। হাজীগঞ্জের বলাখাল স্কুলেতো ডিউটি করার সময় একজন ইউএনও বলেই ফেলেছেন, রতন বাবু একটু আস্তে, ধীরে।

কিছুদিন পরই ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন। নির্বাচনের পূর্বেই সরকারি কলেজের শিক্ষকদের প্রমোশন হলো। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক। শিক্ষা সচিব জনাব সাদত হোসেন। মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলো, প্রমোশনের সাথেই পোস্টিং দেয়া হবে। এমনটি অতীতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যথারীতি প্রমোশন পোস্টিং দেয়া হলো। নিজ জেলায় এবং কর্মস্থলে কাউকে পোস্টিং দেয়া হলো না। নির্বাচনের পূর্বের ৬ মাস আমলাদের একটি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিলো এটি। যেটা আওয়ামী লীগ সরকার বুঝতে পারেনি। অর্থাৎ শিক্ষকদের ক্ষেপিয়ে তোলা এবং তারা যেনো নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে না পারে। নির্বাচনে যা হবার তা-ই হলো। কিছু আমলাদের মুখোশ খুলে গেলো। জি ৪ নামে চার প্রভাবশালী আমলার একটা গ্রুপ ছিলো। যাদেরকে জি ৪ বলা হতো। যারা বিএনপিকে ক্ষমতায় আনায় ভূমিকা রেখেছিলো। এটা আপনারা অনেকেই সম্ভবত জানেন। এ পরিসরে তাদের নাম না-ই বল্লাম।

এমনটাই দূরে পোস্টিং দেয়া হয়েছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে করে শিক্ষকদের মাঝে একটা ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যার দায় নিতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারকে। নির্বাচনে বিএনপি জেতার পরই শুরু হলো রাজনৈতি প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের কাজ। বেছে বেছে প্রগতিশীল এবং হিন্দু শিক্ষকদের নানা রকম হয়রানি শুরু হলো। সারা দেশে প্রগতিশীল শিক্ষকদের মাঝে একটি আতঙ্ক দেখা দিলো। আমার কলেজেও কয়েকজন বিএনপি ঘরানার শিক্ষকের আচরণ দেখেছি। তাদের মাঝে ভাবটা ছিলো যেনো চর দখল করেছে। বিভিন্ন কলেজে জামাত-বিএনপির অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া শুরু হলো। যে যে কলেজে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিলো সেগুলো নামিয়ে ফেলা হলো। এক সকালবেলা আমার কলেজে গিয়ে দেখি, অধ্যক্ষের রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি অধ্যক্ষের পিয়নকে বল্লাম, এ ছবি নামিয়েছে কে? সে উত্তর দিলো, রব স্যার নামিয়ে ফেলেছেন। অপমানে সেদিন কিছু বলতে পারিনি। শুধু মনে মনে ধিক্কার দিয়েছি এ নিমকহারাম জাতিকেই কি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন? বঙ্গবন্ধু দেখে যাও তোমার বাংলাদেশে তোমার ঠাঁই নাই। আমাদের কলেজের ৪/৫ জন শিক্ষকের দাপট দেখেছি সেদিন। আমরা সংখ্যায় বেশি থাকলেও কিছু করার ছিলো না। সারাদেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন তখন শুরু হয়ে গেছে।

চাঁদপুর শহরেই কয়েকজন জামাত-বিএনপি শিক্ষকের আস্ফালন দেখেছি। মনে হয় যেনো তারা প্রতিষ্ঠান দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ২০০১ সালেই চাঁদপুর সরকারি কলেজে একজন বিএনপি ঘরানার লোক অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ নিয়ে আসলেন। চাটুকার শিক্ষকরা এরই মধ্যে তার কাছে ভিড়তে শুরু করেছে। প্রতি অধ্যক্ষের ক্ষেত্রেই তাদের এমন আচরণ দেখেছি। চাঁদপুর সরকারি কলেজের প্রগতিশীল হাতেগোণা ক’জন অধ্যাপক কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। নানা কারণে তাদেরকে হয়রানি করা শুরু করলো। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বেনামে চিঠি দিয়ে তাদেরকে ডেকে নিয়ে হুমকি ধমকি দেয়া শুরু করলো। তাদের ভাবটা এমন ছিলো যে, মনে হয় তারা তাদের পেয়ারের পাকিস্তান ফিরে পেয়েছে। প্রথম ছয় মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চর দখলের মতো শুরু হয়ে গেলো। সে সময়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ইংরেজির সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন সৈয়দ মুয়িজুর রহমান স্যার। অসম্ভব রকমের একজন সংস্কৃতিপ্রেমী, প্রগতিশলী মানুষ। বিষয়গুলো স্যার মেনে নিতে পারতেন না। প্রকাশও করতে পারতেন না। নীরবেই সহ্য করে চলতেন। আমাকে মাঝে মাঝে উপদেশ দিতেন প্রকাশ্যে কিছু না বলার জন্যে। কিন্তু আমার ডিকশনারিতে অপ্রকাশ্য বলতে কিছু নেই। কোনো কোনো সময় নীরবে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করতেন। তখন তিনি নিজেকে অনেক কিছু থেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন। চাঁদপুর সরকারি কলেজের জামাত ঘরানার ক’জন শিক্ষক মিলে প্রগতিশীল শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি শুরু করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে একজন শিক্ষক দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়