প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ফরিদগঞ্জে বন্যায় পানিবন্দি মানুষের হাহাকার
বন্যার্তদের সহায়তায় বিরতিহীনভাবে কাজ করছে শিক্ষার্থীদের বন্যা রেসকিউ টিম ॥ উপজেলাবাসীর এমন ক্লান্তিলগ্নে নীরব ভূমিকায় উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ
টানা কয়েকদিনের বর্ষণে ফরিদগঞ্জের বেশ ক'টি এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলার কোনো কোনো এলাকায় পানিবন্দি মানুষের অবস্থা এতোটাই ভয়াবহ যে, গত এক সপ্তাহ সময় জুড়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। চলাচলের কোনো কোনো রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ পানি আবার কোথাও কোমর সমান, এমনকি বুকের সমপরিমাণ পানিও আছে। বিশেষ করে নদী তীরবর্তী এলাকার বাড়ি-ঘরগুলোতে ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়েছে বন্যার পানি। রান্না করার চুলা পানির নিচে থাকায় নারীরা রান্নাবান্না করতে পারছেন না। এতে মিলছে না নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিবেলার খাবার। অধিকাংশ এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল পানিতে নিমজ্জিত থাকায় ব্যাপকভাবে অভাব দেখা দিয়েছে নিরাপদ পানির। ১৮ আগস্ট থেকে বন্যার পানিতে অধিকাংশ বাড়ি-ঘর পানির নিচে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক পরিবার। আশ্রয় নেওয়া এ পরিবারগুলো অর্ধাহারে অনাহারে পার করছে দুর্বিষহ জীবন। অপরদিকে প্রতিদিন মৃদু ও মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার কারণে পানিবন্দি মানুষগুলোর চিন্তা যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে।
উপজেলার বেড়িরবাজার, আলোনিয়া, পাইকপাড়ার চৌরাঙ্গা, ভাওয়াল, সুবিদপুর, শোল্লার ঘড়িয়ানা, কমলকান্তি, চরকুমিরা, আইটপাড়া, বালিচাটিয়া, পূর্ব রূপসা, চরমান্দারী, চরপোয়া ও পশ্চিম পোয়া, গোয়ালভাওর, গুপ্টি এলাকা, পশ্চিম হাঁসাসহ বেশ ক'টি এলাকার পানিবন্দি মানুষের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। খাবারের অভাবে পানিবন্দি এসব এলাকার মানুষগুলোর অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
উপজেলাবাসীর এমন ক্রান্তিলগ্নে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা ফরিদগঞ্জ বন্যা রেসকিউ টিম বিরতিহীনভাবে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের কাজ করছে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১০ টা এবং তারও বেশি সময়জুড়ে। এ কর্মযজ্ঞে সকাল থেকে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চলে খাদ্য প্যাকেজিংয়ের কাজ। এরপর দুপুর গড়িয়ে এলে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খাবারের প্যাকেট ও নিরাপদ পানি নিয়ে ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবীরা। কখনো নৌকায় করে, কখনো কলা গাছের ভেলায় কিংবা দুই-তিন কিলোমিটার রাস্তা কোমর সমান পানি ডিঙ্গিয়ে পানিবন্দি মানুষের কাছে খাবার সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে এসব স্বেচ্ছাসেবী। এখন পর্যন্ত ফরিদগঞ্জ বন্যা রেসকিউ টিমের স্বেচ্ছাসেবীরা ৩ হাজার ৪৯০টি পরিবারের দোরগোড়ায় খাবার সামগ্রী পৌঁছে দিতে পেরেছে।
শিক্ষার্থীদের বিতরণকৃত খাদ্য সহায়তার প্রতিটি খাবারের প্যাকেটে প্রয়োজন ভেদে দেয়া হচ্ছে নিরাপদ পানি, রান্না করা খিচুড়ি, নির্দিষ্ট পরিমাণ মুড়ি, চিড়া, বিস্কুট, প্যারাসিটামল ঔষধ, খেজুর, স্যালাইন, বাচ্চাদের প্যামপার্স, স্যানিটারি ন্যাপকিন, মোমবাতি ও গ্যাস লাইট। খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি একটি মেডিকেল টিমের মাধ্যমে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মানুষের চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত এ বন্যা রেসকিউ টিমে বিরতিহীনভাবে কাজ করছেন অর্ধ শতাধিক শিক্ষার্থী।
এদিকে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার পক্ষ থেকে শুক্রবার ২৩ আগস্ট ফরিদগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজে আশ্রয় নেওয়া ৬০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল এবং ২৬ আগস্ট সোমবার সমগ্র ফরিদগঞ্জ পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ১টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করা মানুষদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে রান্না করা খাবার। অপরদিকে এখন পর্যন্ত বন্যার্ত পানিবন্দি মানুষদের ভোগান্তি লাঘবের জন্যে কোনো প্রকার দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনকে।
এদিকে ফরিদগঞ্জের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য লায়ন হারুনুর রশিদ ও আলহাজ এমএ হান্নানের পক্ষ থেকে উপজেলা ও পৌরসভা যুবদলের নেতৃবৃন্দের একাধিক টিম, সিআইপি জালাল আহমদের পক্ষ থেকে ও বিভিন্ন ইউনিয়নের ছাত্রদলের কয়েকটি ইউনিট, ফরিদগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সমাজ ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বপ্নছায়া সামাজিক সংগঠন, সেবার আলো, অনির্বাণ, প্রজ্জ্বলনসহ বেশ ক'টি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা বন্যার্তদের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছেন।
ফরিদগঞ্জ বন্যা রেসকিউ টিমের স্বেচ্ছাসেবক মিরাজ এই প্রতিবেদককে জানান, বন্যার প্রভাবে পানিবন্দি মানুষগুলো কতোটা কষ্টে সময় পার করছে তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পানিবন্দি মানুষদের খাবার সামগ্রী পৌঁছে দিতে আমাদের বহু ঘাত প্রতিঘাত পোহাতে হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় কোমর সমান পানি দিয়ে দুই থেকে তিন কিলোমিটার কংক্রিট যুক্ত পথে পায়ে হেঁটে পানিবন্দি মানুষদের ঘরে ঘরে আমরা খাবার সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছি। মুষলধারে বৃষ্টি কিংবা বুক সমান পানি সহ যে কোনো প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের সেবা সার্বক্ষণিক চলমান রয়েছে। প্রতিদিন যে টি-শার্ট টি পরে বের হই, খাবার সামগ্রী বিতরণ করতে গিয়ে সেটি কতবার পানিতে ভিজে আবার কতবার শুকোয় তা বলা বাহুল্য। খাবার সামগ্রী নিয়ে দুপুরের পূর্ব মুহূর্তে বের হলেও উপজেলার একেবারে শেষ প্রান্ত গল্লাকের মতো এলাকাগুলো থেকে ফিরে আসতে রাত এগারোটার অধিক সময় হয়ে যায়। সত্যিকার অর্থে বন্যা দুর্গত মানুষগুলো কতোটা কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছে তা না দেখতে পেলে বোঝানো সম্ভব নয়।