প্রকাশ : ৩১ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
মানুষ যখন নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটায়, তখন একে আত্মহত্যা বা সুইসাইড বলে। একজন মানুষ নানা কারণে আত্মহত্যা করতে পারে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত সমস্যা, গুরুতর মানসিক রোগ বা স্বল্পতর মানসিক সমস্যা, মাদকাসক্তি অথবা প্ররোচনা ইত্যাদি। তাদের কাছে মৃত্যুই বোধহয় মুক্তি!
গত ২৩ আগস্ট ২০২২ চাঁদপুর পৌরসভার ১৫নং ওয়ার্ডের জিটি রোডস্থ উত্তর বিষ্ণুদী সামু গাজী বাড়িতে চুরির অপবাদে কিশোর মোঃ হাসান ছৈয়াল (১৬) আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (চাঁদপুর সদর সার্কেল) আসিফ মহিউদ্দীন ও ওসি মুহাম্মদ আবদুর রশিদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসআই মোঃ শাহজাহান লাশের সুরতহাল রিপোর্ট সংগ্রহ করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠান। পরদিন বুধবার হাসানের লাশ হস্তান্তর করেন মডেল থানা পুলিশ। ওই দিনই জানাজা শেষে চাঁদপুর পৌরসভার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
হাসানের বাবা মোঃ শরীফ ছৈয়াল এ ঘটনায় ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামী করে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ এ যাবত ৩ জনকে আটক করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এবং জাতীয় দৈনিক ও স্থানীয় পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে হত্যা না আত্মহত্যা শিরোনামে নিউজ হয়েছে। পুলিশও তদন্ত করে পেয়েছে হাসান আত্মহত্যা করেছে। তবে হাসানের মৃত্যুর পূর্বে তাকে কয়েকদফা মারধরসহ নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। হাসানের এ আত্মহত্যায় এলাকার মানুষের মাঝে ভয় ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। তার এভাবে চলে যাওয়াটা হাসানের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউ মানতে পারছেন না।
বিষ্ণুদী গ্রামে গেল কয়েক বছরে প্রায় ২০-এর অধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ওই সামু গাজী বাড়ির মোঃ সফিক গাজীর ছেলে হামিম গাজী (১৮) পরিবারের সাথে অভিমান করে নিজ বাসার সিঁড়ির রডের সাথে গলায় বোনের ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। এ ঘটনাটি ঘটেছে ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল। হামিমের বাবা-মায়ের কোনো অভিযোগ না থাকায় মামলা হয়নি। কিন্তু হামিমের বাবা-মায়ের সন্তান হারানোর আর্তনাদ এখনো থামেনি। হামিম ছিল বর্তমান চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র জিল্লুর রহমান জুয়েলের কিউআরসি নামক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। তার এই আত্মহত্যার ঘটনায় এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনার জের না কাটতেই হামিমের বাসার দক্ষিণে ৫০০ গজ পরেই মুন্সির বাড়ির রাসেল মুন্সি ২৮ জুলাই ২০২০-এ নিজ বসত ঘরে আত্মহত্যা করে। এক কন্যা সন্তানের পিতা রাসেল মুন্সির (২৮) আত্মহত্যার ঘটনায় এলাকার মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাসেলের কথাবার্তা, আচার-আচরণে এলাকার মানুষ মুগ্ধ ছিলো। কেন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো- এ প্রশ্ন ছিলো সর্বত্র। রাসেলের মৃত্যু নিয়ে অভিযোগ না থাকায় পোস্টমর্টেম ছাড়াই আবেদনের প্রেক্ষিতে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়েছে।
রাসেল মুন্সির বাড়ির পূর্ব দিকে ১১ অক্টোবর, ২০২০ তারিখ দুপুরে মুক্তা আক্তার সুখি (১৬) নামে একজন আত্মহত্যা করেন। জিটি রোডস্থ উত্তর বিষ্ণুদী কোহিলী ভিলা (ভাড়া বাসা) থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মুক্তা আক্তার শাহমাহমুদপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মফিজ মিজির মেয়ে। তার মা মাসুদা বেগম চাঁদপুর সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য ছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তা আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।
জিটি রোডস্থ উত্তর বিষ্ণুদী আখন্দ বাড়ি থেকে রমজান আলী গাজী বাড়ি পর্যন্ত ৮টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ গ্রামের মানুষ কি শুধু এভাবেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে? আখন্দ বাড়ির হাফেজ মোঃ আবুল বাশার বাদশা আখন্দ। তিনি বিপণীবাগ বাজারের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ২০১৫ সালের ৫ জুন নিজ শয়ন কক্ষ থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই এলাকার মনুফার মেয়ে তাসলিমা আক্তার (১৭), রশিদ বেপারী বাড়ির করুণা বেগমের ছেলে জমির (১৬) ও রমজান আলী গাজী বাড়ি সংলগ্ন বিল্লাল মিজির ছেলে মানিক মিজি (২৮)ও আত্মহত্যা করে।
চাঁদপুরে চিরকুট লিখে আত্মহত্যার অভিযোগ উঠেছে বিষ্ণুদী আজিমিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি বুধবার বিকেলে তিনি ওই স্কুল ভবনের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। নিহত রফিকুল ইসলাম ফরিদগঞ্জ উপজেলার গৃদকালিন্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা। মৃতদেহের সাথে ঘটনাস্থল থেকে একটি সুইসাইড নোট ও বিষের বোতল উদ্ধার করে পুলিশ।
চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী মাদ্রাসা রোডে স্বামীর সাথে কলহের জেরে দুই সন্তানের জননী রেজিয়া বেগম শিল্পী (২৬) নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে ২২ জুন সন্ধ্যা ৭টায় বিষ্ণুদী মাদ্রাসা রোডের আক্তারুজ্জামানের মালিকানাধীন জান্নাত ভিলার দ্বিতীয় তলায় এ ঘটনা ঘটে। এই নারী ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ গ্রামের মোঃ মওদুদের স্ত্রী। মওদুদ বেক্সিমকো কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তাদের ১২ ও ৮ বছরের দুপুত্র রয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রফেসর পাড়ার (পশ্চিম বিষ্ণুদী) বিল্লাল জমদ্দার (৪০), পিতা বাসু জমদ্দার ও নান্টু ছৈয়াল (৩৫) পিতা হাসমত ছৈয়াল, পশ্চিম বিষ্ণুদী নদীর পাড় এলাকার রহিমা বেগম (২৫), ব্যাংক কলোনীর ভাড়াটিয়া আকলিমা আক্তার (২৫) ও ভাড়াটিয়া কালা নামের এক দিনমজুরের ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
বিশিষ্ট লেখক ও চিকিৎসক ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া বলেন, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অস্থিরতা বেড়েছে। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এটা শুধু চাঁদপুর শহরেই নয়, সারা বাংলাদেশ ও সারাবিশ্বের চিত্র। এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয় মনে করেন, জীবন অর্থহীন মনে করেন তখন আত্মঘাতী হন। তিনি আরো বলেন, গেল করোনায় মানুষের সংকট বেড়েছে। বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। জীবন নিয়ে সংশয় বেড়েছে। বেড়েছে দারিদ্র্য, হতাশা, শূন্যতা। এটা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নেয়নি। যার ফল আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়া। পরিবার রাষ্ট্র ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে। কাউন্সেলিং-এর সুবিধা বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডাঃ আসিবুল আহসান চৌধুরী বলেছেন, আবেগময় মুহূর্তে অর্থাৎ যে বিষয়টা আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে সমাধান হতে পারতো, তা না করে অনেকে আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কিছু থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, যা মোটেও ঠিক নয়। যেমন অবৈধ গর্ভধারণ। হয়তো সেই নারী ভাবছেন, বিষয়টি মানুষ জেনে ফেললে তাকে মানুষ কী ভাববে? এ ভাবনা থেকে হয়তো আত্মহত্যা করেন। অথচ তিনি আত্মহত্যা না করলেও পারতেন। তিনি যদি ভুল করেই থাকেন, তা সংশোধনের উপায় ছিলো। তিনি যদি প্রতারিত হয়ে থাকেন, এরও প্রতিকার ছিল। কিন্তু একটা সময় একটা বয়স মানুষকে হয়তো এতো সুযোগ দেয় না। যে কারণে অনেক সময় মানুষ আত্মহত্যা করে, যা মোটেও কাম্য নয়। যা ভীষণ কষ্টদায়ক।