প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
শাহরাস্তিতে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহননকারী মিনুর মা শাহিদা বেগমের কান্না ৭ বছরেও থামেনি। আদালতে মামলা বিচারাধীন অবস্থায় থাকলেও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আইনি চোখ ফাঁকি দিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে মামলার মূল আসামী মমিন হোসেন তারেকসহ তার পরিবারের অন্য আসামীরা। পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট অভিযোগ গঠনের কারণে দফায় দফায় তদন্ত কার্যক্রম পরিবর্তন ও আসামীদের মামলা তুলে নেয়ার হুমকিতে হতাশ মিনুর মা শাহিদা বেগম।
২০১৫ সালের ২০ আগস্ট শাহরাস্তি উপজেলার আয়নাতলী ফরিদ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন আক্তার মিনু শ্রেণিকক্ষে ও বিরতির সময় ক্যাম্পাসে সহপাঠির দ্বারা উত্ত্যক্তের শিকার এবং উত্ত্যক্তকারীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নাজেহাল হয়ে ক্ষোভে আত্মহত্যা করে।
জানা যায়, উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের পণ্ডিত বাড়ির প্রবাসী মোহাম্মদ আলীর মেয়ে শারমিন আক্তার মিনুকে প্রায়ই প্রেম নিবেদন ও উত্ত্যক্ত করতো সহপাঠি একই ইউনিয়নের সংহাই গ্রামের প্রবাসী আবু তাহেরের ছেলে তারেক। তারেক কোনোভাবে মিনুকে পটাতে না পেরে মা রূপবান বেগম ও বোন কনিকাকে সহযোগিতা করতে বলে। এ ব্যাপারে ঘটনার ৩ দিন আগে ১৭ আগস্ট ২০১৫ সোমবার বিকেলে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ ইসমাইল হোসেনের নিকট শারমিনের মেঝ ভাই নয়ন মৌখিকভাবে একটি অভিযোগ দেয়। ২০ আগস্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে ইংরেজি ক্লাস চলাকালে রূপবান বেগম ক্লাসের ভেতর ঢুকে মিনুকে দাঁড় করায়। পরে তার ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। এ প্রস্তাব মিনু প্রত্যাখ্যান করলে তারা মিনুকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। পরে বিরতির সময় রূপবান বেগমের সাথে তার মেয়ে কনিকা এসে আরো অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। ওই সময় তারেক মিনুকে চড় মারে ও মুখে থুতু দেয়। উপস্থিত অন্যান্য সহপাঠির সামনে অপমাণিত হয়ে রাগে ক্ষোভে ৪র্থ ঘন্টার পর ছুটি নিয়ে বাড়িতে যায় মিনু। এরপর তাদের বসতঘরের ২য় তলায় ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে মিনু।
মিনুর আত্মহননের পর তার ঘর হতে একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছে পুলিশ। যাতে লিখা ছিলো ‘মা, ভাইয়া, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর মানুষেরা আমাকে বাঁচতে দিল না। আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারেক, তারেকের মা ও তার বোন কণিকা। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ তোমরা নিও।’
ঘটনার পর মিনুর ভাই শাহাবুদ্দিন নয়ন ৫ জনের নাম উল্লেখ করে শাহরাস্তি থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় শুধুমাত্র তারেককে গ্রেফতার করা হয়।
মিনুর পরিবারের লোকজন জানান, ধূর্ত তারেকের পরিবার অর্থের বিনিময়ে বয়স কমিয়ে ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে। তাতে তারেকের বয়স দেখানো হয় ১৭ বছর ৫ মাস ১২ দিন। অথচ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসাপাতালের তৎকালীন জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি) ডাঃ এম মাঈন উদ্দিনের মেডিকেল রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী তারেকের বয়স ২০ বছর। এই ভুয়া জন্মসনদ দ্বারা তারেককে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দেখিয়ে ৩২ দিন কারাবাস শেষে প্রতারণামূলক তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে তার জামিন নেয়া হয়। কিন্তু মিনুর আত্মহত্যায় প্রধান প্ররোচনাকারী বখাটে তারেকের মা রূপবান বেগম ও তার বোন কনিকা আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এই মামলায় শাহরাস্তি থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক মোঃ নিজাম উদ্দিন গত ২২ ডিসেম্বর ২০১৫ তারেক ও তার মা রূপবান বেগমকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এতে মামলা থেকে ৩ জন আসামীর নাম বাদ দেয়া হয়। তারা হলো : মৃত আব্দুল জলিলের পুত্র তারেকের বন্ধু আবু রায়হান, ছালেহ আহমেদের পুত্র মোঃ শামীম হোসেন ও তারেকের বোন নুরুন্নাহার আক্তার কনিকা। এরপর গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত করেছেন মর্মে তার দাখিলকৃত চার্জশীটের উপর নারাজি আবেদন করে বাদিপক্ষ। গত ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখ নারাজি আবেদন মঞ্জুর হয়ে মামলাটি বিজ্ঞ আদালত সিআইডিতে প্রেরণ করে। সিআইডি পুনঃতদন্ত শেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিলে আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) আবারো তদন্তের নির্দেশ দেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ২০১৭ সালে তারেক, তার মা রূপবান বেগম ও বোন কণিকাকে আসামী করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। যা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে।
সরজমিনে হাঁড়িয়া গ্রামে মিনুর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মিনুর মায়ের সাথে। সংবাদকর্মীদের দেখেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি ৭ বছর রাস্তায় বের হই না, স্কুল ড্রেস পরা মেয়েদের দেখলেই বুক ফেটে যায়। যদি গাড়িতে দেখি চোখ বন্ধ করে রাখি, সামনে পড়লে চোখ ফিরিয়ে নেই। মনে হয় আমার মিনুর মতো কেউ সামনে চলে আসে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না। আপনা আপনি চোখে পানি চলে আসে। কান্না চাপতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি ঘরেই থাকি, বই-খাতা, জামা-কাপড় ও তার ব্যবহৃত জিনিসের মাঝেই আমি তাকে খুঁজে পাই। ঘরে থেকে যখন ক্লান্ত হয়ে যাই তখন বাইরে রাস্তার দিকে তাকালেই মনে হয় স্কুল ড্রেস পরা মিনু ব্যাগ কাঁধে বাড়ি আসছে। যাদের কারণে আমার মেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলো আমি তাদের বিচারের আশায় রয়েছি। দোষীদের বিচার হলে আমার মিনুর আত্মা শান্তি পাবে।
মিনুর ভাই মামলার বাদী শাহাবুদ্দিন জানান, জামিনে এসে তারেক ও তার মা তাকে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে আসছে। আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তারেক জামিন নিয়েছে, তার মা ও বোন প্রকাশ্যে ঘুরছে। তারা জনসম্মুখে বলে বেড়াচ্ছে, মামলা শেষ হয়ে গেছে, কোনো কিছুই হবে না। শাহাবুদ্দিন আরো জানান, নিজের বোন হারানোর বিচার চেয়ে নিজেই প্রাণের শঙ্কায় রয়েছি।
মামলার আইনজীবী অ্যাডঃ শাহেদুল হক মজুমদার সোহেল জানান, মিনু আত্মহননের মামলায় দায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন। আসামী পক্ষের হুমকি-ধমকির প্রেক্ষিতে মিনুর পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হবে।