প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
লীলাবতী ফিরে আয়
মাসুমা রুমা
লাবণ্য চলে যাওয়ার এক বছর পূর্ণ হলো আজ। ঘরের আসবাবগুলো এখন যতেœ গুছিয়ে রাখি। একই নিয়মে খুলে দিই দখিনের জানালাটা। ভোরবেলা যে জানালার পাশে বসে লাবণ্য তার শরীরে সূর্যের আলো মেখে নিত। কখনও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। ব্যালকনিতে চড়ুই পাখির বাসাটা আগের মতোই আছে। বিকেলের সময়টুকু লাবণ্য চড়–ই পাখির সঙ্গে গল্প করে কাটাত। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলেই বারবার আমাকে ফোন করে জ্বালাত। ‘তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো প্লিজ। ঝড় শুরু হয়ে গেছে। আমার চড়ুইটার যদি কিছু হয়!’ মাঝে মধ্যে ওর এসব ছেলেমানুষী দেখে বড্ড বিরক্ত হতাম আমি। সেই আমিই আবার লাবণ্যকে খুশি করতে, ফোন করে চড়ুই পাখির খোঁজ নিতাম। লাবণ্য কি জানে তার প্রিয় চড়ুই পাখিটা আরও দুটো বাচ্চা দিয়েছে?
আজ ঘরে কোনো আলো নেই। ঘর ভর্তি অন্ধকার। আমার হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটাই আমার একমাত্র সঙ্গী। অতীত নিয়ে আজকাল ভাবতে ভালো লাগে না। কিন্তু আমি চাই আর না চাই, লাবণ্যর স্মৃতিগুলো সবসময় আমার সত্তাজুড়ে থাকে। লাবণ্যর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা একটা কোচিং সেন্টারের ইতিহাস ক্লাসে। ও তখন বারো ক্লাসের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। আমি রাত জেগে ওর জন্য নোট তৈরি করতাম। কিন্তু নোটগুলো পড়ে ওর রেজাল্ট কতটুকু ভালো হবে সেসব নিয়ে ভাবতাম না। কেন জানি মনে হতো, নোটগুলো পেয়ে আমার প্রতি ওর দৃষ্টি সদয় হবে। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হতো আমাদের। স্বাভাবিক কিছু কথাবার্তা। একদিন লাবণ্যর পরীক্ষা শেষ হলো। হাতে প্রচুর অবসর পেল মেয়েটা। দিন দিন আমার প্রতি ও মনোযোগী হয়ে উঠল। সুযোগ পেলেই আমাকে ফোন করত। মেসেজ পাঠাত। ওর দেওয়া মেসেজের শব্দে মুখর থাকত আমার মন। ধীরে ধীরে আমাদের মৌন দূরত্বটা কমে এলো। মে মাসের ১৩ তারিখ ছিল লাবণ্যর জন্মদিন। সেদিন আমরা নদীর পাড়ে দেখা করলাম। মনের কথাগুলো সাহস করে বলেই ফেললাম ওকে। লাবণ্য আমাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। সেদিন থেকেই আমাদের একসঙ্গে পথচলার শুরু।
বছরখানেক পরেই আমি একটি চাকরি পেয়ে গেলাম। লাবণ্য আমার ঘরে বউ হয়ে এলো। দারুণ কাটছিল সময়গুলো! রাগ, অভিমান, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, কোনো কিছুরই কমতি ছিল না আমাদের ভেতর। সুযোগ পেলেই আমরা পাহাড়-নদীর কাছে ছুটে যেতাম। শাড়ি পরতে লাবণ্য ভীষণ ভালোবাসে। ও যখন লাল-সাদা শাড়ি পরে চুলগুলো খুলে দিত, মনে হতো আমার সামনে কোনো দেবী দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে লাবণ্যকে দেখতাম। ভাবতাম, মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে! আমার পাগলামি দেখে লাবণ্য তার হাসি থামাতেই পারত না।
আমাদের ঘর আলো করে এলো একটি কন্যাসন্তান। আমি তার নাম দিলাম ‘লীলাবতী’। নামটি হুমায়ুন আহমেদের একটি উপন্যাস থেকে নেওয়া। ধীরে ধীরে ‘লীলাবতী’ বড় হয়ে উঠল। একদিন আমাকে বাবা বলেও ডাকল। সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। বাবা ডাক শোনার আনন্দ যে এত সুখকর হতে পারে, আমি তা কল্পনায়ও ভাবিনি! হাসি-আনন্দেই কাটছিল আমাদের জীবন।
যান্ত্রিক শহরে চলতে গিয়ে আমি বেশ হাঁপিয়ে উঠলাম। লাবণ্যকে রাজি করিয়ে, আমরা ঘুরতে গেলাম গ্রামের বাড়িতে। সেই চিরসবুজ গ্রাম, খোলা আকাশ এখনও আমার দু'চোখে ভাসছে! বেশ কয়েকটা দিন গ্রামেই কাটল আমাদের। এই দিনগুলোর ভেতর আমাদের জীবনের মোড়টাই বদলে গেল। একদিন দুপুরের খাওয়া শেষে আমি বাহির বাড়িতে শীতলপাটি বিছিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। লাবণ্য গোসলে যাবে বলে লীলাবতীকে আমার কাছে রেখে গেল। যাওয়ার আগে বারবার বলে গেল, আমি যেন ঘুমিয়ে না পড়ি। ‘লীলাবতী’কে যেন চোখে চোখে রাখি।
কিন্তু আমি যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই! এখন মনে হয়- সেই ঘুম থেকে আর কোনোদিন না জাগলেই ভালো হতো! তাহলে অন্তত ‘লীলাবতী’র মৃত মুখটা আমায় দেখতে হতো না। আমার অতটুকুন মেয়ে পানিতে পড়ে মারা গেল সেদিন! কত কষ্টই না পেয়েছে আমার ছোট্ট ‘লীলাবতী’!
সন্ধ্যা নাগাদ ‘লীলাবতী’কে কবর দেওয়া হলো। কবর দেওয়া শেষ হলে আর এক মুহূর্তও গ্রামে থাকেনি লাবণ্য। আমার ঘরেও ফিরে আসেনি আর। লাবণ্য এখন ওর মার সঙ্গে থাকে। অনেক ফেরানোর চেষ্টা করেছি আমি, পারিনি। আমার প্রতি ওর অভিমানটা এত জোরালো যে, সেই অভিমানের দেয়াল ভেঙে আবার আমার কাছে ফিরে আসা ওর জন্য হয়তো অসম্ভব। লাবণ্য আজও মনে করে, আমি যদি সেদিন ঘুমিয়ে না যেতাম ‘লীলাবতী’ হয়তো মারা যেত না। ‘লীলাবতী’কে হারিয়ে আমি কতটা অসহায় হয়ে পড়েছি লাবণ্যকে বলাই হলো না।
রাত প্রায় শেষের দিকে। জানালা দিয়ে এখনও আকাশ দেখে চলেছি। হঠাৎ করেই আমার ভেতরের মানুষটা বেরিয়ে এলো। সে মানুষটা চিৎকার করে বলে উঠল- ‘লীলাবতী’! ফিরে আয় মা। তুই ফিরে এলে লাবণ্যও ফিরে আসবে আমার জীবনে। একা থাকতে বড্ড বেশি কষ্ট হয়! তোরা কি তা বুঝিস না?
* পাঠক ফোরাম বিভাগে লেখা পাঠানোর ঠিকানা