প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
দেশপ্রেমী মহৎ মানুষ হুমায়ুন কবির
বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বৃক্ষপ্রেমী, সাংস্কৃতিক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা, চাঁদপুর সদর উপজেলার ৩নং কল্যাণপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ইব্রাহিম বিএবিটি সাহেবের বড় ছেলে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কবির বীর প্রতীকের বড় ভাই হুমায়ুন কবির সাহেবের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো ৮ জানুয়ারি। হুমায়ুন কবির বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকাস্থ নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী চাঁদপুর কল্যাণপুর ইউনিয়নের ডাসাদী গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মরহুম হুমায়ুন কবির জীবদ্দশায় অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল, সৎ ও মহৎপ্রাণ মানুষ হিসেবে চাঁদপুর শহরে খুব পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত। তিনি তাঁর কথায়-গল্পে বলতেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এ মনিহার আমায় নাহি সাজে’। তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করে প্রতি বছরের মতো এ বছরও ৮ জানুয়ারি রোববার চির সমাহিত কবরস্থানে বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ও পারিবারিকভাবে দোয়া ও মিলাদ আয়োজন।
মরহুম হুমায়ুন কবিরের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ফোকাস বাংলা নিউজের কর্ণধার ইয়াসিন কবির জয়, তাঁর পিতার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সকলের কাছে মহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনায় দোয়া চেয়েছেন। পৃথিবীজুড়ে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিজেদের সকলের তরে মিশিয়ে দিয়েছেন, অথবা তাঁরা জীবনদর্শনে এমন অসাধারণ কিছু করেছেন, যা চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে যায়। এ সকল ক্ষণজন্মা মানুষের কোনো মৃত্যু নেই। যদিও পরলৌকিক হয়ে যান। কিন্তু তাঁদের সৎ ভাবনার মহৎ গুণগুলো হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখে। হুমায়ুন কবির সাহেব ঠিক তেমনই একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর নাম শুনলেই তাঁকে যারা চেনেন বা দেখেছেন সেই সকল মানুষ আজো তাঁকে বিন¤্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করে বলেন, এমন বড় মনের মানুষ আর পাবো না আর আসবেও না ইত্যাদি কথামালা শুনতে পাই।
আমার অনেক স্মৃতি তাঁর সাথে, যা প্রতিক্ষণ খুব মনের মাঝে ভেসে ওঠে। আমার চোখে হুমায়ুন কবির সাহেব অনেক উদার ও বড় মনের মানুষ ছিলেন। আমার সাথে ওনার ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় ১৯৯৯ সাল থেকে। সে সময় একুশে ভাষা শহিদ স্মরণে ফুলের ঢালা নিয়ে আসলে হুমায়ুন কবির সাহেব বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ মার্কেটে সামনে আমাকে ডেকে বললেন, তোর নাম কী, তুইকি আমাকে চিনছ? ওনার কথার উত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি আপনাকে চিনি, আপনি কবির চেয়ারম্যান। আমার কথা শুনে তিনি খুশি হলেন। তারপর আমাকে বললেন, ভাষা শহিদ মিনারে ফুলের ঢালা দিবি তো সংগঠনের নাম মিঠুন ফ্রেন্ডস্ এসোসিয়েশন কেন? তখন আমি সংগঠনের বিষয়টি তাঁকে সময় দিয়ে জানালাম। তিনি বেশ খুশি হয়ে বললেন, শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে পরে আমার সাথে দেখা করিস। সেই থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছিলাম। জীবদ্দশায় হুমায়ুন কবির সাহেব সত্যিই অনেক বড় মনের মহৎ মানুষ ছিলেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন এবং বিশেষ স্থানে ইংরেজিতে কথা বলতেন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সাথে প্রচলিত বাংলায় কথা বলতেন।
মনে পড়ে, ২০০১ সালে মিঠুন ফ্রেন্ডস্ এসোসিয়েশন সংগঠনের আয়োজনে চাঁদপুরের কৃতীসন্তান ও গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করবো, তো হুমায়ুন কবির আংকেলের সাথে দেখা করে সব বললাম, তিনি সব শুনে বুঝে সেদিন আমাকে তাৎক্ষণিক ইংরেজিতে চিঠি লিখে দিয়ে আমায় বলেন, চাঁদপুর গিয়ে শিল্পকলার সেক্রেটারী অজয় ভৌমিককে চিঠিটা দিয়ে বলবি, আপনাকে কবির চেয়ারম্যান আমার সাথে বাবুরহাট যেতে বলেছেন। তাঁর কথা মতো অজয় ভৌমিকের কাছে চিঠি দেওয়ার পর তিনি চিঠি পড়েই বললেন, কবির ভাই কোথায় আছেন এখন? তখন শ্রদ্ধেয় অজয় ভৌমিক রিকশা নিয়ে বললো, চলো পলাশ। এরপর শ্রদ্ধেয় অজয় ভৌমিককে নিয়ে চলে আসলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের কাছে বাবুরহাট। আসার পর কবির সাহেব হেসে বললেন, কেমন আছত আজয়? সত্যিই বলতে কী আমি খুব বিস্ময় হয়ে ভাবলাম ওনাদের একজনের প্রতি একজনের শ্রদ্ধা-ভক্তি-সম্পর্ক-ভালোবাসা আজকাল সত্যিই বিরল, যা আমাকে সেইদিনের দৃশ্যটি এখনো খুব ভাবায় এবং খুব ভালো লাগে।
তিনি দেশ ও সমাজ নিয়ে অনেক ভাবতেন। অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বুঝে উপকার করেছেন। তিনি তাঁর সময় ইউনিয়নের নতুন রাস্তা করাসহ বৃক্ষরোপণ, অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে গেছেন। যার কারণে ইউনিয়নবাসী তাঁকে আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
একদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অনেক স্মৃতিময় গল্প করে বললেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে চেয়ারম্যান কবির বলে ডাকতেন। তাঁর উচ্চবিলাসিতা ছিলো, কিন্তু তিনি যখন ঢাকা থেকে চাঁদপুরে আসতেন বিশেষ করে বাবুরহাট বাজার এসে পৌঁছতেন তখন তাঁর মাঝে কোনো রূপ বিলাসিতাই দেখাতেন না, বরং সাদামাটা চলাচল কথা গল্প করতেন।
দুই.
হুমায়ুন কবির তাঁর জীবনে খুব সাহসী মানুষ ছিলেন। দেশের উচ্চস্তরের চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, চিকিৎসক, কবি, সাহিত্যিক, লেখকসহ বহু জ্ঞানী-গুণীদের সাথে যোগাযোগ ছিলো ও আড্ডা দিতেন। তিনি আমেরিকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আমেরিকায় বেশি সময় অবস্থান করেনি। বরং দেশের টানে দেশের মানুষের ভালোবাসার জন্যে দ্রুত ফিরে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
হুমায়ুন কবির সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমী মানুষ ছিলেন। তিনি মানুষকে অল্প সময়ের মধ্যে আপন করে নিতে পারতেন। তাই তিনি প্রায় মানুষকেই স্বভাবসুলভ আদরের ডাক ‘তুই’ সম্বোধন করতেন। তাঁর তুই বলে ডাক কেউ মনে আঘাত পেতেন না। তিনি যেমনিভাবে ধর্মপ্রাণ ছিলেন তেমনি মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ ছিলেন। বহুমাত্রিক জ্ঞানী মানুষ ছিলেন হুমায়ুন কবির সাহেব। চাঁদপুর শহর অঞ্চলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একমাত্র ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার গাড়ি হুমায়ুন কবির সাহেবের ছিলো বলে কথার গল্পে তাঁর কাছ থেকে জানতে পেরেছি। জনহিতৈষী এই মানুষটি জনপ্রতিনিধি চেয়ারম্যান হিসেবে জনবান্ধব ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। অত্যন্ত নিরহংকারী ও সাদাসিধা জীবন-যাপন করে গেছেন তিনি। সত্যিই তিনি একজন উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন। আমার মাঝে মধ্যেই মনে হয় হুমায়ুন কবির নিজেই একজন ইতিহাস। তাঁর স্মৃতিকথা বলতে গেলে শেষ হওয়ার নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, ‘শেষ হয়ে ও হইল না শেষ’।
তাঁর জীবনের পড়ন্ত বেলায় ঢাকা বাসাবোর বাসায় গিয়ে শেষ দেখা করি। সেইদিন তিনি আমায় বলেন, দেখ পলাশ আমার শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না, হয়তো যে কোনো দিন মারা যাবো, তবে তুই সাবধানে থাকিস ও চলিস। মনে রাখবি, কোনো কিছু ভয় করে চলবি না। সৎ কর্ম এবং দেশ-সমাজের সৎ চিন্তা নিয়ে মাথা উঁচু করে চলবি। আর আমার বিশ্বাস, তুই কোনো কাজে আটকাবি না। এমন অনেক উপদেশ ও পরামর্শ দিলেন। এর কিছুদিন পরেই আমার পরম শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন কবির সাহেবের মৃত্যুর সংবাদ আসে!
আমি খুব কাছ থেকে হুমায়ুন কবির সাহেব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ শহীদ উল্লাহ মাস্টারের ইস্পাতকঠিন বন্ধুত্ব দেখেছি। হুমায়ুন কবির তুই বলেই কথা বলে ডাকতেন, তেমনি শহীদ স্যারও তাঁকে কবির ভাই বলে কথা বলতেন। আজ দুজনই চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে! চিরতরে হারানো বেদনায় প্রায় চোখ ভিজে যায় আমার।
একদিন তিনি আমার অভিনয় করার আগ্রহ আছে শুনে তিনি তাঁর পুত্রবধূ ও অভিনেতা বুলবুল আহমেদ কন্যা এক সময়ের টেলিভিশন নাটকের অভিনেত্রী ঐন্দ্রিলার কাছে আমার বিষয়ে কথা ও গল্প করে বলেন এবং ঐন্দ্রিলা আপুকে দিয়ে আমার সাথে মোবাইলে কথা বলালেন, যা চিরদিন স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে। হুমায়ুন কবির সাহেবের স্নেহ-ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই গৌরব বোধ করি। এ মহান মানুষের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে পরিশেষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বলাকা’ কবিতা দিয়ে শেষ করছি।
স্মরণের গ্রন্থি টুটে সে যে যায় ছুটে
বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন।
মহারাজ, কোনো মহারাজ্য কোনোদিন পারে নাই তোমারে ধরিতে;
সমুদ্রস্তনিত পৃথী, হে বিরাট তোমারে ভরিতে নাহি পারে-
তাই এ- ধরারে
জীবন-উৎসব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে
মৃৎপাত্রের মতো যাও ফেলে।
তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারম্বার।
পলাশ দে : সাংস্কৃতিক ও সংবাদকর্মী। প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, মিঠুন ফ্রেন্ডস্ এসোসিয়েশন, চাঁদপুর।