শনিবার, ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৭

ইনসানিয়াত

বিমল কান্তি দাশ
ইনসানিয়াত

স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্যটা কিন্তু বস্তুত অনুদ্ঘাটিতই রয়ে গেলো এবং থাকবেও। তবে দুটি জিনিস একেবারেই স্পষ্ট। এক পক্ষ খাদক অন্য পক্ষ খাদ্য। এ মহাবিশ্বের সাত আসমান, সাত জমিন স্রষ্টার সৃষ্টি। তন্মধ্যে স্রষ্টা 'মানুষ' নামক একটা জীবকেই আলাদাভাবে সৃষ্টি করেছেন, যাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব তথা বিবেক-বুদ্ধি নিহিত। যা অন্য কোনো জীবের মধ্যে নেই। মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় দুটি চক্ষু, দুটি কান, দুটি পা, দুটি নাক ইত্যাদি নিয়েই জন্মায়। তবে দেশ-কাল-পাত্রভেদে বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদে রূপান্তরিত হয়ে যায়। কথায় আছে আদি মানব হলো আদম মতান্তরে 'মনু' পরিবারের ধারাবাহিক বিবর্তনে বর্তমানের জনসংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় ৮০৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। অবয়বিক সব মানুষই মনুষ্যত্ব গুণসম্পন্ন নয়। মানুষ আর বন্য পশুর মধ্যে পার্থক্যটা হলো বিবেক নিয়ে। বিবেকহীন মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এরা পারস্পরিক সহানুভূতিহীন-পরশ্রীকাতর-অসামাজিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এমনকি আইনের প্রতিও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে মানব সমাজকে পশুর সমাজের সদৃশ করে তুলেছে।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দুটি সত্তাই প্রদান করেছেন, একটি জীবসত্তা অপরটি মনুষ্যত্ব। সেজন্যেই বলা যায় “মানুষ হতে হবে মানুষ যখন।”

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন “জীবে প্রেম করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর।” আবার রুশ সাহিত্যিক তলস্তয় বলেছেন, “মানব সেবাই মনুষ্যত্বের উৎকৃষ্ট পরিচায়ক।” আর ইসলাম ধর্ম মতে, “মানুষই হলো আশরাফুল মাকলুকাত"। অর্থাৎ উৎকৃষ্টতম জীব। আবার মহাদার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন “আগে নিজকে জান।” তাহলেই মনুষ্যত্বের চরম পরাকাষ্ঠা ফুটে উঠবে। যদিও মানুষের ধর্মই হলো মনুষ্যত্ব। যে পরিবারে যত বেশি মমত্ববোধ-পারস্পারিক সহমর্মিতা-মানবীয় নৈতিকতায় ভরপুর এবং হাড়ে হাড়ে নিয়মানুবর্তী, সে পরিবারগুলোই মানবিক গুণসম্পন্ন হয়ে থাকে।

বাংলা বর্ণমালার এগারটি স্বরবর্ণ এবং ঊনচল্লিশটি ব্যঞ্জন বর্ণ রয়েছে। সীতানাথ বসাক প্রণীত আদর্শলিপি বইখানায় শুধু যে বর্ণ পরিচয় তা নয়। প্রত্যেকটি বর্ণ দ্বারা সৃষ্ট বাক্যগুলো মানবশিশুর মনে অবশ্যই নৈতিকতার উদ্রেক ঘটাবে। যা আজকের শিশুকে অবশ্যই মানুষে রূপান্তর করবে। যেমন 'অ' দ্বারা সৃষ্ট বাক্য ছিল 'অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর/রূপান্তর-অজগরটি আসছে ধেয়ে। 'আ' তে ছিল 'আলস্য দোষের আকর/রূপান্তর-আমটি আমি খাব পেড়ে' ইত্যাদি কোন্টি নৈতিকতায় গতিশীলতা আনে সেটি সহজেই বিবেচ্য। ছেলেবেলায় আমাদের অভিভাবকবৃন্দ এমন তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন যে, বাড়ি ফিরার পরপরই সব কিছু বলতে পারতেন এবং পরের দিনের ক্লাসের পড়া শিখায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তা করতেন। পারিবারিকভাবে শিশুদেরকে এই বর্ণ পরিচয়ের শিক্ষাটা মানব মনের স্মৃতিকোষে এমনভাবে লেগে থাকে, যা কোনোদিনও বিস্মৃতির অতলে ডুবে যায় না। এরপর অন্য যে কোনো শিক্ষাই তাকে আঁকড়ে ধরে রাখে। এতে দেশে প্রকৃত শিক্ষার হার যেমন বেড়ে যাবে এবং কিশোর সন্ত্রাসের হারও তেমনি কমে যাবে। কারণ প্রকৃত নৈতিক শিক্ষাটাই তাকে অপকর্মে লজ্জিত করে দিবে।

সৃষ্টি তত্ত্বানুযায়ী আগে আবির্ভূত হয়েছে মানুষ, পরে মতান্তরে ক্রমানুযায়ী সনাতন (হিন্দু) ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম (মুসলমান) ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। ইত্যাদি সকল ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ কিন্তু রক্ত মাংসের 'ইনসান'। ভারতীয় উপমহাদেশ বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে 'ধূল-কা-ফুল' ছায়াছবির একটি অনন্য দৃশ্যে মানুষের সংজ্ঞায় উচ্চারিত হয়েছিল, “ইনসান কি আওলাদ ইনসান বনেগা।” অপর একজন জননন্দিত শিল্পীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, “মানুষ মানুষকে পণ্য করে, মানুষ কি মানুষের কাছে একটু সহানুভূতি পেতে পারে না?'' তাহলে সেই প্রস্তর যুগ-প্রাচীন যুগ-মধ্য যুগ-আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগ-সুচিত সভ্য যুগ-চলিত ডিজিটাল যুগে এসেও আমরা সভ্য হতে পেরেছি? সবক্ষেত্রেই যেন ইনসানিয়াত বিবর্জিত পরিবেশ। ফলস্বরূপ দেশ আজ আইনহীনতার রাহু গ্রাসে পতিত হয়ে মানব সভ্যতাকে কটাক্ষ করছে।

বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না গত ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে দৈনিক 'বাংলাদেশ প্রতিদিন' পত্রিকায় বলেছেন “এদেশের ক্ষমতার ভিতর বাইরের সবাই মিথ্যা কথা বলে।” একথা সব পৃষ্ঠপোষক পাশ কাটায়ে গেলেও ইতিহাস কিন্তু তার স্বভাবানুযায়ী পুনরাবৃত্তির কোষে জমা করে রাখে। নিষ্ঠুরভাবে সময় মতোই মঞ্চস্থ করে দেয়। বিজ্ঞানী নিউটনের স্বতঃসিদ্ধ সূত্রানুযায়ী : প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া ঘটে, যা জাতি-ধর্ম-দেশ-কাল-পাত্র ভেদের তোয়াক্কা করে না। যাহা অবশ্যম্ভাবী ঘটবেই।

যদি শৈশবের নৈতিকতার শিক্ষাটা উকৃষ্ট দ্রাবক এবং ধর্মীয় নিগূঢ় তত্ত্বগুলো উৎকৃষ্ট দ্রাব্য হয়, তবে দ্রবণটি নিষ্কলুষ মানব সমাজ হবে। যেখানে থাকবে না বিচারহীনতা-মানব সৃষ্ট সামাজিক বৈষম্য, যা স্বয়ংক্রিয় উন্নত মানব সমাজের পরাকাষ্ঠা। নতুন এই আলট্রা যুগের ডিজিটাল প্রযুক্তির আসক্তিতে আমাদের দেশের সুন্দর শৈশব আজ অতিশয় বিপন্ন। এসব কলুষিত শৈশব দুরন্তপনার কৈশোরকে হাতছানি দেয় এবং ধনাত্মক প্রভাবক হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশীকে মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত করবে। দেশে মুক্ত চিন্তক দীর্ঘজীবী হোক, নির্জীব মানবতা প্রস্ফুটিত হোক। বিচারহীনতায় প্রবল আসক্তি আর দানবীয় প্রবৃত্তি সমধর্মী। এতেই ঘটে যায় সমাজের অধঃগতি। মানুষের জন্যে ধর্ম, ধর্মের জন্যে কিন্তু মানুষ নয়। সৃষ্টির কালান্তরে মনান্তর-মতান্তর-বিশ্বাসান্তরগুলোতে দলিত-মথিত-নিগৃহীত হয়েছে যুগে যুগে শুধুই শাশ্বত 'মানবতা'। সর্বংসহা প্রকৃতি কিন্তু প্রতিশোধ প্রবণ। যার কোনোই পূর্বাভাষ থাকে না। মানবীয় বোধোদয়ই একমাত্র নিষ্কৃতি।

লেখক : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়