প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ০৯:৫৫
বাংলা কবিতায় প্রবীণ

বাংলা কবিতায় প্রবীণ জীবন, বার্ধক্যের অভিজ্ঞতা, স্মৃতিচারণ, নিঃসঙ্গতা, জ্ঞান ও মৃত্যু চেতনা বারবার উঠে এসেছে। কবিরা কবিতায় বার্ধক্যকে কীভাবে তুলে ধরেছেন সেটা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে।
১. অশ্বত্থতলায় বুড়ো-কবি জীবনানন্দ দাশ।
‘পথের ধারে অশ্বত্থতলায় বসে আছে বুড়ো, চোখে নীরব সমুদ্র।’
গ্রামীণ জীবনে এক প্রবীণ মানুষের প্রকৃতির সাথে মিশে থাকার চিত্র। নীরব সমুদ্রের মতো গভীর তার অভিজ্ঞতা।
২. বুড়ো গাছ-কবি শামসুর রাহমান।
‘বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকা-গাছের মতো আমিও দাঁড়িয়ে আছি।’
বৃদ্ধ বয়সে জীবনের ধীরগতি ও স্থিরতা যা গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে।
৩. অবসরের বিকেল-কবি সুফিয়া কামাল
‘সূর্যের আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঢোকে,
আর স্মৃতি এসে বসে কোলের ওপর।’
এক প্রবীণ নারীর বিকেলের নীরবতা যেখানে অতীতের স্মৃতি এসে বসে কোলের উপর।
৪. স্মৃতির বুকে বৃদ্ধ-কবি নির্মলেন্দু গুণ।
‘বর্তমান হারিয়ে গেছে, আমি কেবল অতীতের গলিতে হেঁটে বেড়াই।’
প্রবীণ মানুষ অতীতেই বাঁচে, বর্তমান তার কাছে অচেনা। অতীতের সুখ দুঃখই তার জীবনের ভরসা।
৫. দাদুর গল্প-কবি আল মাহমুদ।
‘আমার শৈশবের দুপুরগুলো দাদুর গল্পে বাঁধা ছিল।’
দাদুর গল্প প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্কের সেতু। এখানে দাদু এক জীবন্ত ইতিহাস যিনি নাতি নাতনির কল্পনার জগৎ তৈরি করে দেন।
৬. শেষ চিঠি-কবি রফিক আজাদ।
‘তুমি এলে না, তাই চিঠির প্রতিটি অক্ষরে জমে আছে কুয়াশা।’
মৃত্যুর প্রাক্কালে প্রিয়জনের জন্য লেখা চিঠি যেখানে ভালোবাসা, অভিমান ও বিদায়ের বেদনা মিশে আছে।
৭. বৃদ্ধাশ্রম-কবি নির্মলেন্দু গুণ।
‘জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বটগাছ-যেন সেও আমার মতো একা।’
প্রবীণদের একাকী জীবন, পরিবারের অবহেলা সমাজের দায়িত্ব হীনতা এই কবিতার মূল সুর।
‘যেখানে ঘরের দরজা আর খোলা হয় না/সেখানে আমি বন্দী, সন্তানরা শহরমুখী।’
কবি দেখিয়েছেন সন্তানের সচ্ছল জীবনের পেছনে বাবা মায়ের নিঃসঙ্গতা লুকিয়ে আছে। ‘ঘরের দরজা খোলা হয় না।’ এখানে প্রতীকীভাবে বোঝানো হয়েছে সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতা।
৮. দাদুর খাতা-কবি সুফিয়া কামাল।
‘পাতায় পাতায় লেখা কেবল নদীর গান
আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের নাম।’
দাদুর ডায়েরিতে জমা আছে জীবনের গল্প যা পরিবারের ইতিহাস ও প্রজন্মের সংযোগের প্রতীক।
৯. অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ-কবি শামসুর রাহমান।
‘অফিসের ফাইলের গন্ধ ভুলে গেছে,
কিন্তু মনে রেখেছে ভোরের বাসের শব্দ।’
১০. বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ-কবি জীবনানন্দ দাশ।
‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ---/ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যাওয়া আকাশের রঙ---।’
এই কবিতায় বুড়ো শালিক আসলে সময়ের সাক্ষী-যেমন বৃদ্ধ মানুষ জীবনের বহু ঋতু দেখেছে তেমনি এই শালিকও বহু অভিজ্ঞতার ধারক।
১১. পথের শেষ প্রান্তে-কবি শামসুর রাহমান।
‘শেষ পথে পা বাড়িয়ে ভাবি,
কত মানুষের ভীড়ে আমি ছিলাম একা।’
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এক প্রবীণ বুঝতে পারছেন যে জীবনের ভীড়ে থেকেও তিনি আসলে নিঃসঙ্গ ছিলেন। এখানে শহুরে জীবন ও একাকীত্ব একসাথে ধরা দিয়েছে।
১২. শেষ চিঠি-কবি কাজী নজরুল ইসলাম
‘বার্ধক্যের কাঁপা হাতে লিখি,
যৌবনের আগুন এখনো নিভেনি।’
এখানে প্রবীণ প্রেমিক দেখাচ্ছেন বয়স শুধু দেহকে ক্ষয় করে কিন্তু হৃদয়ের প্রেমের আগুন শেষ হয় না।কবিতায় ভালোবাসার ভালোবাসার অমরত্ব ফুটে উঠেছে।
১৩. বার্ধক্যের দিন-কবি জীবনানন্দ দাশ।
‘গোধূলি নামে ধীরে,
আমার বয়সও নামছে নদীর তীরে।’
গোধূলি ও বয়সের অবসানকে এক সাথে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কবিতায় বার্ধক্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ম্লানতার মিশ্র অনুভূতি পাওয়া যায়।
১৪. বৃদ্ধ বাবা-কবি সেলিনা হোসেন।
‘বৃদ্ধ বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে,
শহরের ছেলে ব্যস্ত,চোখ মেলে না।’
বাবার প্রতীক্ষা ও সন্তানের অবহেলা সমাজের এক কঠিন সত্যকে প্রকাশ করে। এখানে দৃষ্টিহীনতা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক দিক থেকেও বোঝানো হয়েছে।১৫. নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-কবি হেলাল হাফিজ।
‘ভীড়ের মাঝে হাঁটি,
কিন্তু আমার পাশে কেউ নেই।’
শহুরে জীবনে প্রবীণদের একাকীত্ব কতটা গভীর হতে পারে তা বোঝাতে কবি সোজাসাপটা ও হৃদয়স্পর্শী চিত্র ব্যবহার করেছেন।
১৬. শেষ বিকেল-কবি সৈয়দ শামসুল হক।
‘সূর্য ঢলে পড়ে,
আমার জীবনের আলোও কমছে।’
বিকেলের আলো কমা এবং জীবনের সময় ফুরিয়ে আসাÑএই দৃশ্যের মধ্যে প্রতীকী মিল রয়েছে। এখানে বার্ধক্যকে সুন্দর অথচ বেদনাময় ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
১৭. অন্তিম প্রহর-কবি ফররুখ আহমেদ।
‘হিসাবে খাতায় লিখি পাপ পূন্যের যোগফল,
সময় বাকি আর মাত্র এক প্রহর।’
কবি বার্ধক্যের শেষ মুহূর্তকে মৃত্যুর আগে এক আত্মসমীক্ষার সময় হিসেবে দেখিয়েছেন। এখানে ধর্মের ও আধ্যাত্মিক ভাবনা প্রবল।
১৮. প্রবীণ মায়ের গান-কবি জসীম উদ্দিন।
‘সোনার নৌকা বানিয়ে দিলি,
মা কই সে খেলার দিন?’
এখানে মা সন্তানের শৈশবের স্মৃতি মনে করে। অতীত ও বর্তমানের ব্যবধান প্রবীণ মায়ের একাকীত্বকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।
১৯. বার্ধক্য-কবি আল মাহমুদ।
‘শরীর ভেঙে পড়ে,
কিন্তু চোখে দেখি স্বপ্ন।’
২০. মায়ের প্রার্থনা-কবি জসীম উদ্দিন।
‘বার্ধক্যের শীতে কাঁপছে শরীর,
ছেলে আমার আসুক ফিরে।’
প্রবীণ মায়ের শারীরিক দুর্বলতা এবং সন্তানের জন্য অবিরাম অপেক্ষাÑএই দ্বৈত কস্টকে কবি সরল অথচ করুন ভাষায় ফুটিয়েছেন।
২১. বৃদ্ধ কাকু-কবি নির্মলেন্দু গুণ।
‘চায়ের দোকানে একা বসে,
পানের খোল চিবোতে চিবোতে ভুলে যায় ঠিকানা।’
স্মৃতিভ্রংশ ও একাকীত্বকে এখানে গ্রামীণ আঙ্গিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রবীণ বয়সের মানসিক দুর্বলতার ছবি স্পষ্ট।
২২. শেষ যাত্রা-কবি ফররুখ আহমেদ।
‘পা কাঁপছে, তবু রওনা হয়েছি
এক অজানা পথের দিকে।’
এখানে বার্ধক্য ও মৃত্যুর প্রস্তুতি একই সাথে এসেছে। ‘অজানা পথ’ প্রতীকী ভাবে মৃত্যু পরবর্তী যাত্রাকে বোঝায়।
২৩. গোধূলি-কবি জীবনানন্দ দাশ।
‘আকাশে ধুলি জমে,
চোখে জমে জীবনের ধুলো।’
প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে প্রবীণ জীবনের ক্লান্তি ও স্মৃতির ভার মিলিয়ে এক মর্মস্পর্শী চিত্র আঁকা হয়েছে।
২৪. দূরের মানুষ-কবি শামসুর রাহমান।
‘তুমি গেলে দূরে,
বয়স এলো কাছে।’
ভালোবাসার মানুষ হারানোর পর বার্ধক্যের আগমন আরও তীব্র হয়ে উঠে। ব্যক্তিগত ক্ষতি ও বয়সের বোঝা এখানে একাকার।
২৫. বৃদ্ধাশ্রমের গান-কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
‘ছেলে মেয়েরা ব্যস্ত শহরে,
আমি ব্যস্ত নিজের ছায়ার সাথে কথা বলতে।’
একাকীত্ব এতো গভীর যে, প্রবীণ মানুষ নিজের ছায়াকে সঙ্গী করে নেয়Ñএটি সামাজিক অবহেলার তীব্র প্রতিচ্ছবি।
২৬. শেষ বসন্ত-কবি হেলাল হাফিজ।
‘শেষ বসন্তে ফুল ফোটে না,
কেবল ঝরে পড়ে শুকনা পাতা।’
বয়সের শেষ প্রান্তে এসে আনন্দের পরিবর্তে ক্ষয় ও অবসাদ বেশি প্রকট হয়।এখানে প্রকৃতির প্রতীকী ব্যবহার প্রবল।
২৭. প্রবীণ চাষা-কবি জসীম উদ্দিন।
‘ধানের ক্ষেতের দিকে তাঁকিয়ে থাকে,
জানে-আর ফসল কাটতে পারবে না।’
কৃষকের জীবন শক্তি ক্ষয়ে যাওয়া এবং মাটির সাথে আবেগী বন্ধনকে কবি খুব সহজে অথচ গভীর ভাষায় বলেছেন।
২৮. বার্ধক্যের চিঠি-কবি নির্মলেন্দু গুণ।
‘হাতে কাঁপুনি, তবু লিখি
আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি।’
২৯. অবসান-কবি সৈয়দ শামসুল হক।
‘ঘড়ির কাঁটা থেমে যাবে শিগগির,
অথচ গল্প বাকি আছে অনেক।’
জীবনের শেষ মুহূর্তেও প্রবীণ মানুষের মনে থাকে অসমাপ্ত গল্প ও স্বপ্ন। সময়ের সীমাবদ্ধতা ও জীবনের অপূর্ণতা এখানে একসাথে ফুটে উঠেছে।