বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

চূড়ান্ত ক্ষতি জনগণের ও জনপদের
অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার

নির্বাচন কমিশনের অবস্থান, তাদের কথাবার্তা, ক্ষমতাসীনদের মনোভাব এবং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখে, দেশের বাইরেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রখর মনোযোগের সৃষ্টি হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীলতা দেখাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অনুসারী মিত্র পশ্চিমা দেশগুলো। আগে পশ্চিমারা ‘সন্ত্রাস’ নামক অস্ত্র ব্যবহার করতো ভিনদেশে হস্তক্ষেপ করার জন্যে। সেই অস্ত্র এখন অকেজোপ্রায়। তাই এখন তারা ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র’ নামক উছিলা ব্যবহার করছে অন্য দেশে হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেয়ার জন্যে। তাই মার্কিনরা বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ও গণতন্ত্র অনুশীলনের নেতিবাচক দিকগুলোকে পুঁজি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সরব হতে থাকে।

রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে ইউরোপের মাধ্যমে ইউক্রেনের ‘প্রক্সিওয়ার’ যথেষ্ট। কিন্তু চীনকে ঠেকাতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। উল্লেখ্য, ইউক্রেন একটি স্বাবলম্বী উন্নত দেশ। কিন্তু বিদেশিদের প্ররোচনায় বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি দেশ রাশিয়ার সঙ্গে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দেশটি তছনছ হয়ে গেছে প্রায়। তবে জানি না, ইউক্রেনের পরিণতি কী হবে। তা ভবিষ্যতেই বলে দিবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির শাসন-শোষণ থেকে লিবিয়াকে স্বাধীন করে কর্নেল গাদ্দাফি তার দেশকে একটি উন্নত ও অনেকটা স্বাবলম্বী দেশের সীমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গণতন্ত্রের ধোঁয়া তুলে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তবে শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করা হয়নি তাকে হত্যা করে সারা লিবিয়াকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। অগণতান্ত্রিক আজকের লিবিয়ার যে স্বপ্ন সেই স্বপ্ন বর্তমান লিবিয়ার নেতৃত্ব কোনো দিন পূরণ করতে পারবে না বললে অত্যুক্তি হবে না। হয়তো গাদ্দাফির লিবিয়াতে পশ্চিমা মডেলে গণতন্ত্র ছিলো না, কিন্তু উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ছিলো, শান্তি ও শৃঙ্খলা ছিলো, সাধারণ জনগণ সুখে-শান্তিতে ছিলো। কিন্তু তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে গাদ্দাফির কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তোলা লিবিয়াকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে লিবিয়ার হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, এমনকি একটি শহর প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন ও খাদ্যের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের পাশে কোনো পশ্চিমা উন্নত দেশ বা পরাশক্তিকে তেমন দেখা যাচ্ছে না। এমনকি গাদ্দাফির তথাকথিত অগণতান্ত্রিক লিবিয়াতে বাংলাদেশের হাজার হাজার কর্মজীবী কাজ করে জীবন-জীবিকা রক্ষা করতো, অথচ আজকে তারা কর্মহীন। এই কর্মহারা একটি মানুষকেও কর্ম দেয়নি আমাদের তথাকথিত পশ্চিমা বন্ধুরা। তারপরও তাদের প্ররোচনায় আমরা লাফালাফি করি। এমনকি যা করার না তা করে থাকি।

ইতিহাসের প্রাচীনতম রাষ্ট্র ইরাক। শাসক সাদ্দামকে অগণতান্ত্রিক হিসেবে অভিহিত করে সেই ইরাক ও তার রাজধানী বাগদাদকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। ইরাকে গণতন্ত্র নেই বলে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় (২০০৩ সালে) এবং ২০০৬ সালে তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়। প্রায় ২০ বছর হতে চললো কথিত অগণতান্ত্রিক সাদ্দামের পতন হয়েছে, কিন্তু আজও পশ্চিমাদের তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তা কে না জানে। তারপরও আমাদের বোধোদয় হয় না। এই ইরাকেও একসময় লাখ লাখ বাংলাদেশি কাজ করতো। আজকে সেই পশ্চিমা দেশের কেউ তাদের খোঁজ রাখে না।

অপরদিকে উল্লেখ করতে হয়, গণতান্ত্রিক নয় বলে মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ফেব্রুয়ারি ২০১১ ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তারপর নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা মোহাম্মদ মুরসি ভোটে নির্বাচিত হলেও তাকে ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হয়নি এবং পরে তাকে দুর্নীতির দায়ে ফাঁসি দেয়া হয়। কিন্তু মিশর আজও দুর্নীতিমুক্ত হয়নি, গণতন্ত্র কায়েম হয়নি এবং জনগণের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গণতন্ত্র তো দূরের কথা উলটো পশ্চিমাদের স্বার্থে মিশরে কঠোর সামরিক শাসন চলছে। আমরা বুঝেও বুঝি না, তাই ওদিকে আমাদের দৃষ্টি যায় না।

এদিকে বাংলাদেশেও গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্যে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশ ও একটি বৃহৎ পরাশক্তি ওপরে পড়ে অনেক দরদ দেখাচ্ছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তন করে এবং এই সামরিক সরকার ষড়যন্ত্রমূলক বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকারীর অনেককে পশ্চিমা কথিত গণতান্ত্রিক দেশ আশ্রয় দিয়ে থাকে। ওই সকল পশ্চিমা দেশের তখন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইস্যু কোথায় ছিলো? ১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এরশাদের অগণতান্ত্রিক শাসন সম্পর্কে একটি কথাও বলেনি। তারা কেউই ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। এমনকি ২০১৮ সালের কথিত বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা ৪/৫ ঘণ্টার মধ্যে সব পরাশক্তির রাষ্ট্রপ্রধান বর্তমান সরকার প্রধানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

আজকে বাংলাদেশের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করে যাচ্ছে। অথচ পশ্চিমাসহ বিদেশি রাষ্ট্র এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে যাচ্ছে। এমনকি সরকারের পদত্যাগের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো প্রকার মনোভাব দেখাচ্ছে না। অপরদিকে সরকারি দলসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি এমনকি প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে একটি (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ) অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো পশ্চিমা দেশ বা পরাশক্তি সরকারের বক্তব্যকে আমলে নিচ্ছে না কিংবা সরকারের কাছে এ বক্তব্যের কোনো নিশ্চয়তা দাবি করছে না। তার হেতু কী? ভাবসাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, বিশ্বের কোনো কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশে রাজনৈতিক গ-গোল সৃষ্টি হওয়ার সুড়সুড়ি দিচ্ছে এবং কী পরিমাণ উচ্ছৃঙ্খল ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হতে পারে তা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে। হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয়তো?

বিএনপি তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না। এদিকে সরকারও পরিষ্কার করে বলছে, সংবিধান মোতাবেক যথাসময়ে নির্বাচন করবে। দুটো পক্ষেরই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থান। তাই জনগণের মধ্যেও হতাশা ও দুশ্চিন্তা এবং অশুভণ্ডআশঙ্কা। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে হয়তো সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ সংঘাত এড়ানোর জন্যে কেউ কিংবা কোনো দেশ এগিয়ে আসছে না। বিএনপির বিশ্বাস, তারা সরকারকে পদত্যাগ করাতে পারবে এবং অপরদিকে সরকারের দৃঢ় বিশ্বাস, তারা যথাসময়ে সংবিধানমতে নির্বাচন করতে পারবে। কার পরিকল্পনা ও অবস্থান সঠিক তার জন্যে জাতিকে অল্প কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। হয়তো ইউক্রেন, ইরাক, লিবিয়া বা মিশরের মতো সময় পার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সময় যা-ই পার হোক না কেনো চূড়ান্ত ক্ষতি হবে জনগণের ও এই জনপদের।

শেষান্তে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বললে বলতে হয়, ধ্বংসের মাধ্যমে বিলীন হয়ে যাওয়ার চেয়ে সময় থাকতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার মেনে ধ্বংসের রাজনীতি পরিহার করে নির্বাচনী-রাজনীতিতে সোচ্চার হয়ে রণে ভঙ্গ দেয়া অতীব রাজনৈতিক-রণকৌশলের কাজ। আরও বলতে হয়, হাঁটাহাঁটি বা মিডিয়ার সামনে গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে সরকার পতনের কল্পনা হয়তো কল্পনাই থেকে যেতে পারে। যদি না জনগণের কাঙ্ক্ষিত অংশগ্রহণ না থাকে। তবে অতীতের মতো দুর্ঘটনার আশা যারা করছেন তাদের আশা পূরণ না-ও হতে পারে কেননা এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়-গণতন্ত্রমনা ও পরাধীনতা মানতে পারে না।

তথ্য-সহায়ক :

১. বাংলা একাডেমি পত্রিকা (৬৫ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা), জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২১) পৃ: ৪২-৪৫

২. International Relation and Bangladesh, Harun-ur-Rashid, Dhaka, The University Press Ltd. 2004, P-216

৩. নয়া দিগন্ত, ঢাকা, ৩ এপ্রিল ২০২৩ পৃ: ৭

৪. কালের কণ্ঠ, ৯ মে ২০২২, পৃ: ৬

৫. বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পৃ: ১, ৪

৬. লেখকের প্রকাশিত প্রবন্ধ : নির্বাচন হবে বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসকে কে? চিন্তা ভিনদেশের! (দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ২২ মে, ২০২৩, দৈনিক ইলশেপাড় ও দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ ২১ মে ২০২৩)

অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার : সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়