বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক

৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ৯ মাস অবরুদ্ধ বাংলার সব অর্গল খুলেছিল একাত্তরের এই দিনে। উন্মুক্ত নীলাভ আকাশ আর সুনীল সমুদ্রের মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছিল সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি। তাই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাথা উঁচু করার দিন।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্র্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সেটির পুনরুদ্ধার ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এই বিজয়ের মহানায়ক হিসেবে যিনি ইতিহাসের চির অম্লান ও ভাস্বর হয়ে আছেন, তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরপরই শুরু হয় বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের নির্যাতন। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের ওপর তারা হস্তক্ষেপ শুরু করে। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে নিরীহ বাঙালির জীবন। বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার ওপর পাক জান্তাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ বাঙালিদের জীবন বিষিয়ে তোলে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে বাংলার সূর্যসন্তান সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্রনেতাদের বুুকের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার রাজপথ। উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ববাংলা। অবশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়। কিন্তু নির্যাতন ও শোষণের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। তাদের বিমাতাসুলভ আচরণে দেশবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, জন্ম নেয় চাপা ক্ষোভ। বিদ্রোহী হয়ে ওঠে সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষ। ১৯৬৯-এর বিদ্রোহ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচন সব পরিণতিকে দেয় চূড়ান্ত রূপ। শুরু হয় নতুন অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আসে বঙ্গবন্ধুর বজ্র-নিনাদ ঘোষণা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ইয়হিয়া খান বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর অতর্কিত হামলায় বাংলার মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। সারা দেশ জুড়ে চলে ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। বাঙালি জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তি সংগ্রামে। অবশেষে সুদীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির চির কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য উদিত হয়।

পৃথিবীর সব স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা দিবস থাকলেও বিজয় দিবস থাকে না। বাংলাদেশ সেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী দেশ। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি গৌরবময় বিজয় ৫১ বছর অতিক্রম করছে। ইতিহাসের মহাসমুদ্রে এটা খুব দীর্ঘসময় না হলেও একটি জাতির উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য সময়টা একেবারে কম নয়। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, যে লক্ষ্য ও আদর্শকে সামনে রেখে মুক্তিযুুদ্ধ করেছিল বাঙালিরা, সেই লক্ষ্য ও আদর্শ কতটা অর্জিত হয়েছে? স্বাধীনতার পর দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলেও তা হোঁচট খেয়েছে বারবার। বজায় থাকেনি তার ধারাবাহিকতা। রাজনীতিতে ঐকমত্যের অভাব ও অসহিষ্ণুতা এর বড় কারণ। অন্তত জাতীয় ইস্যুগুলোয় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐক্য থাকা প্রয়োজন হলেও কোনো শাসনামলেই তা দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থই হয়ে উঠেছে মুখ্য। একইভাবে সরকার পরিবর্তনের পর আগের সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ থমকে গেছে। এটা দেশের অগ্রগতির পথে হয়েছে অন্তরায়। এটা সত্যি—দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশুমৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রভূত সাফল্য রয়েছে আমাদের। জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিলেও এর উত্থান ঠেকিয়ে রাখা গেছে।

আশার কথা হলো, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ এখন বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। রাজনীতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব, টানাপোড়ন কাটিয়ে মহাজোট সরকার দেশকে একাত্তরের চেতনায় পরিচালিত করার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ। ইতিহাসের এই নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে গিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মকে এটাও বুঝতে হবে যে, স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়। নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনও শুধু নয়। স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে বৈধ ও নৈতিক ইচ্ছার স্বাধীনতা। রাজনীতির স্বাধীনতা এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক মুক্তি।

বর্তমান সরকারের গতিশীল ও পরিকল্পিত চিন্তাধারার মাধ্যমে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নিজের দেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন যখন ভিনদেশি টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়, তখন মানুষ হিসেবে মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। যখন শুনি আমাদের তৈরি ওষুধ পৃথিবীর ১০৪ টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, তখন গর্ববোধ করি। যখন দেখি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। তখন ভালো লাগার মাত্রায় যোগ হয় এক অনির্বচনীয় গর্ব ও প্রত্যাশা। আগামীর সম্ভাবনাময় চোখে যখন দেখি আমাদের আইটি সেক্টর গার্মেন্টস সেক্টরকেও পেছনে ফেলবে, তখন বিস্ময়ে অভিভূত হই। কৃষিতে শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদনে আমাদের সমকক্ষ দেশ পৃথিবীতে খুবই কম।

কখনো কখনো খাদ্যে ভেজাল, নারী ও শিশু নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে দুর্নীতি, চাকরিতে নিয়োগে অস্বচ্ছতা ও বিদেশে টাকা পাচারসহ বহু নেতিবাচক কার্যকলাপ আমাদের সোনার বাংলার এই ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। আমরা উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলেও কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের অগোচরেই থেকে যাচ্ছে। তা হচ্ছে জীবন ও কর্মক্ষেত্রে আমাদের দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও উপলব্ধিবোধের অভাব। ‘উপলব্ধিবোধ’ শব্দটি এজন্য ব্যবহার করলাম যে, কখনো কি আমরা দেশমাতৃকার দিকে সন্তানের দৃষ্টি নিয়ে গভীর মমতা ভরা চোখে চেয়ে দেখেছি? দেখলে দেখতাম আমাদের মাতৃভূমি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের বিপুল সম্ভাবনার সমাহার। পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যেখানে দিনের বেলায় খোলা জায়গায় ডিম রাখলে ডিম সিদ্ধ হয়ে যায়। আবার এমন অনেক দেশ আছে যেখানে শীতে বরফ পড়ে। হিটিং সিস্টেম ছাড়া জীবন ধারণ দুরূহ। সে দিক থেকে বলা যায়, ঋতু-বৈচিত্র্য আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, ঠিক তেমনি সমৃদ্ধ করেছে। এ দেশে জন্মে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারাটাও গভীর উপলব্ধিবোধের বিষয়। পরিবার, সমাজ, জাতি যখন দেশপ্রেমিক। যখন জাতি সততা ও নৈতিকতার চর্চা করবে তখন দেশের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে থাকবে প্রাণ, প্রাচুর্য ও বিজয়ের ছোঁয়া।

বিজয় মাসের শপথ হোক, বৈরিতাণ্ডবিদ্বেষকে পেছনে ফেলে দেশ ও জনগণের কল্যাণে সবাই এক হয়ে মিলেমিশে কাজ করা। আনন্দ অনেকভাবেই আসতে পারে জীবনে। কিন্তু মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির জন্য প্রাণোৎসর্গ করা যুদ্ধজয়ের আনন্দের কোনো তুলনা হয় না। আগামী প্রজন্মের মন ও মননে মহান বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও গুরুত্বের বীজ বপন করতে হবে। এভাবেই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জাগ্রত হবে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়