প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:১৮
যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিষেধাজ্ঞায় উদ্বেগ কতটা

যুক্তরাজ্যের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ ও স্থগিত করেছে বলে সম্প্রতি দেশটির প্রভাবশালী পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলেছে। খবরটি ‘শিক্ষার্থীর’ ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত হলেও স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে দেশের নামটি আসে। শিরোনাম দেখেই অনেকের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ কাজ করতে পারে। বিশেষ করে যখন পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরাও এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যুক্ত করে খবরটি প্রচার হচ্ছে, তখন একে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যারও অবকাশ থাকে। অংশীজন হিসেবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী কিংবা তাদের পরিবারকেও এ ঘটনা আতঙ্কিত করতে পারে। যদিও খবরটি নিঃসন্দেহে নেতিবাচক; কিন্তু আতঙ্কিত হওয়ার মতো নয়। প্রকৃত অর্থেই যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বিদেশ যেতে চান, তাদের সতর্কতার জন্য একে শাপেবর হিসেবে দেখার সুযোগ আছে। তবে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ও অন্যান্য করণীয় ভুলে গেলে চলবে না।
বস্তুত যুক্তরাজ্যের নতুন ভিসা নীতির কড়াকড়ির কারণেই সেখানকার ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট, অধিক সংখ্যক ভিসা আবেদন বাতিলের কারণেই যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতি বছর বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যের ভিসা আবেদন বাতিল হয়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। পাকিস্তানের ভিসা বাতিল হয়েছে ১৮ শতাংশ। অথচ যুক্তরাজ্যের হোম অফিস তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নিয়ম করে দিয়েছে– বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এই পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ১৭ বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাশিত শিক্ষার্থীদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বেশি হওয়ার কারণে তারা যুক্তরাজ্যের জাতীয় মান রক্ষা করতে পারছে না। এ ধারা বজায় থাকলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রশাসন ব্যবস্থান গ্রহণ করত। সেই সতর্কতা হিসেবেই তারা এমন ব্যবস্থা নিয়েছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনার হার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষ দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাজ্য। যদিও যুক্তরাজ্যের ভিসা নীতি কড়াকড়ির কারণে সেখানে শিক্ষার্থীদের যাওয়ার হার কমেছে। এ বছর প্রকাশিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের ‘ট্রান্সন্যাশনাল এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণার খবর বণিক বার্তায় ২২ মার্চ ২০২৫ তারিখে এসেছে বিস্তারিত। সেখানে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে যাওয়ার হার ৩৯ শতাংশ কমেছে; ২০২২ সালে ১৫ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য যুক্তরাজ্যে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভিসা নীতির কঠোরতার কারণে পরের বছর তা নেমে আসে ৯ হাজারে। দেশটি ধারাবাহিকভাবে অভিবাসীদের জন্য ভিসা কঠোর করেছে। তার ফল হিসেবেই সম্প্রতি ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত আমরা দেখেছি।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে এও এসেছে, যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে এ বছর ২৩ হাজার ৩৬টি ভিসা নাকচ করেছে, তার ৫০ শতাংশই বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থী। আবার এ দুটি দেশ থেকেই যুক্তরাজ্যে অ্যাসাইলাম বা রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার আবেদন বেড়েছে। এমন আবেদনকারী অধিকাংশই ওয়ার্কিং বা শিক্ষার্থী ভিসায় ব্রিটেনে এসেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার লক্ষ্যে প্রার্থিত ভিসা যখন বাতিল হচ্ছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায় বাড়ছে। এমন অবস্থান থেকে পরিত্রাণেই ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ করেছে। বিষয়টি নিয়ে জানাশোনা রয়েছে এবং ইতোমধ্যে জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন মো. সফিউল্লাহ, যিনি এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তাঁর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমি কথা বলেছি।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে প্রয়োজনীয় ভাষা দক্ষতা, আর্থিক প্রমাণ বা সঠিক নথি দিতে না পারাসহ নানা কারণে ভিসা আবেদন বাতিল হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। তাঁর মতে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য যুক্তরাজ্যের দরজা এখনও বন্ধ হয়নি। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই চালু আছে। এ ক্ষেত্রে এজেন্সির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। তিনি বিদেশে উচ্চশিক্ষা বিষয়ে একটি সমন্বিত নীতিমালার প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে জালিয়াতি, অসম্পূর্ণ কাগজপত্র ও ভুল তথ্য দেওয়ার প্রবণতা কমে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ করেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। যেমন ইউনিভার্সিটি অব উলভারহাম্পটন বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এক হাজারের পরে অবস্থান করছে। ইউনিভার্সিটি অব চেস্টারের অবস্থানও অনুরূপ। তার বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকা যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা করছেন। সে জন্য সত্যিকার অর্থেই উচ্চশিক্ষার জন্য যারা যুক্তরাজ্যে যেতে চান এবং সেখানকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে চান, তাদের জন্য বিচলিত হওয়ার কারণ নেই। মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে এখনও যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশিদের সুযোগ অবারিত।
তবে সরকারের নিশ্চিন্তে বসে থাকার সুযোগ নেই। যে মানেরই হোক, যুক্তরাজ্যের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় যখন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি বন্ধ ও স্থগিত করার ঘোষণা দিচ্ছে, সেটা দেশের ভাবমূর্তির জন্য প্রশ্ন তৈরি করে। যদিও এটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং কঠোর ভিসা কমপ্লায়েন্স নীতির অংশ, তারপরও সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যকে আস্থায় আনতে হবেÑভিসার অপব্যবহার রোধে বাংলাদেশ কাজ করছে। এ দেশের শিক্ষার্থীরা যুগ যুগ ধরে সুনামের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন এবং সেখানকার কম্যুনিটিতে বাংলাদেশিরা যে অবদান রাখছেন, তাও তুলে ধরা দরকার।
অভ্যন্তরীণভাবে করণীয় হলো, যুক্তরাজ্যের নতুন ভিসা নীতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের সব শর্ত মেনে সঠিক কাগজপত্র দিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করেন, তা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে কোনো দালাল বা এজেন্সি নিয়মবিরোধী কাজ করলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, এখানে ব্যক্তিগত লাভের চেয়েও দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত।








