মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২:১২

নারীমুক্তির দিশারী মহীয়সী বেগম রোকেয়া

শিবলী সাদিক
নারীমুক্তির দিশারী মহীয়সী বেগম রোকেয়া

‘পৃথিবী ক্ষুদ্র হোক আর বিপুলা হোক, জীবন পদ্মপত্রে নীড় হোক আর জীবনকোষের সমাহার হোক’--প্রতিটি মানবসন্তান এই পৃথিবীপৃষ্ঠেই জন্মগ্রহণ করে, লালিত-পালিত ও বিকশিত হয়, আবার ভবলীলা সাঙ্গ করে স্রষ্টার আহ্বানে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে। তবুও অবিরাম চলতে থাকে জন্মের পর হতে মানুষের আত্মনির্মাণের অন্তহীন প্রচেষ্টা। আমৃত্যু আত্মনির্মাণ ও আত্মবিকাশের ক্রমাগত প্রাণান্তকর প্রয়াস ও প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে মানুষ ক্রমেই এগিয়ে যায় সফলতার দিকে। ‘সম্পূর্ণ জীবন কেউ বর হিসেবে পায় না’, সেটা গড়ে নিতে হয়। এই প্রচেষ্টার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইতিবাচক, গতিময় ও অর্থবহ জীবনের অস্তিত্ব ও অঙ্গীকার। সেদিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ইতিহাস বিখ্যাত বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী জাগরণের পথিকৃৎ, মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩০) জীবন অর্থবহ ও সার্থক।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তমসাচ্ছন্ন বাঙালি মুসলমান নারী-সমাজের জাগরণে বেগম রোকেয়ার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তঁার প্রদর্শিত পথ ধরেই অগ্রসর হতে থাকেন মুসলিম মুক্তিপিয়াসী নারীর দল; উত্তরকালে অনেক নিন্দা- সমালোচনা-বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এবং বহু কঁাটার আঘাত সহ্য করে তারা শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজনীতি ও রাজনীতি বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি নারীর সামগ্রিক জীবন নিয়ে ভেবেছেন এবং নারীকে দেখেছেন একজন সত্যিকার সমাজসংস্কারকের নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্রমবিকাশের সূত্রে। সমাজমনস্ক ক্ষণজন্মা এই মহীয়সী নারীর মননচর্চার যে স্বর্ণফসল তঁার বৈচিত্র্য ও গভীরতা গভীর বিস্ময়ের উদ্রেক করে। তঁার শিক্ষা ও সমাজহিতৈষী মানবিক ভূমিকা ও সাহিত্যসাধনার মর্মমূলে প্রেরণার জলসিঞ্চন করেছিলেন তঁারই অগ্রজা করিমুন্নেসা খানম (১৮৫৫-১৯২৬) এবং স্বামী সাখাওয়াত হোসেন।

পুরুষনিয়ন্ত্রিত, সামাজিক পরিবেশ কীভাবে নারীর জীবনকে নষ্ট, ব্যর্থ, বিড়ম্বিত ও কলুষিত করে তা উদ্ঘাটনের জন্যে তিনি তঁার রচনায় সুনিপুণ দক্ষতায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে সমাজের নানা অসঙ্গতি, দায় ও দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ করেছেন। ঊনিশ শতকে বাঙালি সমাজে নারীর জীবন যে নিতান্ত নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ, বর্ণহীন, ভারাক্রান্ত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও পীড়িত হয়ে উঠেছিলো, তার কারণ অশিক্ষা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সংসারে উপেক্ষা, বৈধব্যযন্ত্রণা ইত্যাদি; তন্মধ্যে অশিক্ষা সর্বপ্রধান।

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলার রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। বাবার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের, মাতার নাম রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। বাবা ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি, তথাপিও মেয়েদের শিক্ষাদানের প্রশ্নে ছিলেন অত্যন্ত উদাসীন। পরিবারে তিনি পড়াশোনার উৎসাহ লাভ করেন অগ্রজা করিমুন্নেসা খানম এবং পরবর্তীতে ১৬ বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে ভাগলপুরের এক উচ্চ শিক্ষিত উদার পরহিতব্রতী সজ্জন ব্যক্তি তৎকালীন জঁাদরেল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহের পর স্বামীর কাছ থেকে। সত্যি কথা বলতে কী, স্বামীর কাছ থেকে এই উদার আনুকূল্য, সহমর্মিতা, সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে তিনি হয়তো এমন মহীয়সী হয়ে উঠতে পারতেন না। এ প্রসঙ্গে ‘লুকানো রতন’ স্মৃতিকথায় রোকেয়া নিজেই জানিয়েছেন, ‘সত্যি বলিতে কি, তিনি (করিমুন্নেসা খানম) উৎসাহ না-দিলে এবং আমার শ্রদ্ধেয় স্বামী অনুকূল না হইলে আমি কখনই প্রকাশ্য সংবাদপত্রে লিখিতে সাহসী হইতাম না।’

বেগম রোকেয়া যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। তৎকালীন বাঙালি মুসলিম সমাজে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত ও নিগৃহীত নারীসমাজ। এই বিশাল নারীসমাজকে অন্ধকারে পশ্চাদপদ রেখে দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অসম্ভব। তাই তিনি হাজারো প্রতিকূলতা এবং বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও নারীশিক্ষার সম্প্রসারণে ব্রতী হয়ে মাত্র ৫জন ছাত্রী নিয়ে ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর মেয়েদের জন্য অকালপ্রয়াত স্বামীর নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল।’ তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন দেশের নারীসমাজ উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অধিকার সচেতন এবং সকল প্রকার গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে না।

সমাজ বিনির্মাণে এবং সমাজের অবস্থার পরিবর্তনে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সফল হয়েছে সেই আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত, যা এখনও বিরাজমান। নারী-পুরুষের এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। তাইতো কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ সময়-সুযোগ ও পথ পেলে নারীরাও পুরুষের থেকে কোনো অংশে কম নয়-- ইতিহাসে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে ভুরি ভুরি।

বেগম রোকেয়া নারীসমাজের দুর্গতির মূলে যে অশিক্ষা, অন্ধকারতা, কুসংস্কার তা যথার্থই উপলব্ধি করে শিক্ষার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গি গঠন বলিষ্ঠ বীর্যবতী ও সংগ্রামী করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেজন্যে নিজে জমিদারকন্যা হয়েও এই মহৎপ্রাণ বিদূষী বাঙালি রমণী নারীজাগরণ, বাঙালির জাগরণ, বাঙালি মুসলমানদের জাগরণের লক্ষ্যে স্কুল এবং নানান রকম নারী কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ বহুবিধ মানবিক ও জনহিতকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কেন তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারসহ পরহিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেকথা তিনি নিজেই বলেছেন, ‘এ কথা আমার শয়নকক্ষে আরামকেদারায় বসিয়া ভারত-ললনার জীবন সন্বন্ধে চিন্তা করিতেছিলাম। আমাদের দ্বারা কি দেশের কোনো ভালো কাজ হইতে পারে না’ !

স্কুল ছিল তঁার কাছে প্রাণাধিক প্রিয়। এর সমর্থনে ব্যক্ত হয়েছে সওগাত পত্রিকার সম্পাদককে লিখিত একপত্রে। সেই পত্রে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি যে অবরোধবাসিনী হয়েছি, তার কারণ আছে। আমার স্কুলটা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। একে বঁাচিয়ে রাখার জন্য আমি সমাজের অযৌক্তিক নিয়মগুলোও পালন করেছি।’

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরষ সমান অধিকার লাভ করিবেন।’ বর্তমান বাংলাদেশের নারীসমাজে মহান সংবিধানের এই অঙ্গীকারের প্রতিফলন অনেকাংশে দৃষ্টিগ্রাহ্য। অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বাংলাদেশ তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মানবিক প্রচেষ্টা, লিঙ্গ সংবেদনশীল নীতির জন্যে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। নারীসমাজের আজকের এই ক্রমবিকাশ, উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতির প্রেরণাশক্তি হলেন বেগম রোকেয়া।

বেগম রোকেয়া প্রকৃত শিক্ষা ও মনুষ্যত্ববোধে উদ্দীপ্ত অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তঁার চমৎকার ব্যক্তিত্ব ও উদার মানবিক গুণাবলির যুগদুর্লভ দৃষ্টান্ত আজও দেদীপ্যমান প্রতিটি প্রগতিশীল বাঙালি নারীর হৃদয়ে। অত্যধিক চিন্তা ও পরিশ্রমের কারণে এই নারীজাগরণের পথিকৃৎ এবং অগ্রনায়িকা বিদূষী বিরলপ্রজ নারী ১৯৩২ সালে ৯ ডিসেম্বর মাত্র ৫২ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। ‘নারীর ভাগ্যজয়ের অধিকার শাশ্বত’- আজন্ম এই সত্যকে বুকে লালন করে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং বহুগুণে গুণান্বিত, বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই ক্ষণজন্মা মহীয়সী নারী এক জনমে বাঙালি মুসলমান নারী তথা বাঙালিদের মুক্তির লক্ষ্যে সভ্যতার ইতিহাসে যা দিয়ে গেলেন তার জন্য তিনি হয়ে থাকবেন অমর চিরস্মরণীয়।

শিবলী সাদিক : অধ্যক্ষ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়