প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, যেটি সর্বত্র দেখা যায় এবং পাওয়া যায়। আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল, ভরা মৌসুমে যেটির প্রাচুর্য থাকে এবং দামও সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে। ফলের রাজা আম, ভরা মৌসুমে ভালো জাতের আমের কেজি খুচরা ও পাইকারি মূল্য গড়ে ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে থাকে। যেটি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা কিনে খেতে পারে। অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব আমের মধ্যে পড়ে না। এবার তরমুজের ব্যাপক ফলন হওয়ায় ৫ কেজি ওজনের তরমুজও মানুষ গড়ে ১০০ টাকায় কিনে খেতে পেরেছে। তারপরও ক্রেতা সঙ্কটে কতো তরমুজ যে পচেছে, সেটার অন্যতম নীরব সাক্ষী ডাকাতিয়া নদী। এভাবে অন্য কিছু কৃষি/খাদ্যপণ্যের প্রাচুর্যে বাজারে নিয়ন্ত্রিত দাম দেখা যায়। কিন্তু জাতীয় মাছ ইলিশের প্রাচুর্যেও দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে না, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেও থাকে না। গতকাল চাঁদপুর কণ্ঠে বিষয়টি নিয়ে শীর্ষ সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে, যার শিরোনাম হয়েছে ‘ভরা মৌসুমেও দাম কমছে না ইলিশের ॥ লোকাল মাছ খুবই কম, ঘাটে সাগরের ইলিশের প্রচুর আমদানি’। এ সংবাদে চাঁদপুরের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মিজানুর রহমান লিখেছেন, চাঁদপুরের রূপালি ইলিশ মাছ, তার স্বাদ, আকৃতি এবং দাম বাংলাদেশে নিয়মিত আলোচনার বিষয়। ক্রেতারা বলছেন, এই প্রিয় মাছটি আগের চেয়ে বেশ চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। চাঁদপুর ইলিশ অবতরণ কেন্দ্র বড়স্টেশন মাছঘাটে গত ক’দিন যাবত প্রচুর ইলিশের আমদানি বেড়েছে। শনিবার (১৯ আগস্ট) চাঁদপুর বড়স্টেশন মাছঘাটের আড়ত ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, ভরা মৌসুমেও আকার ও মানভেদে প্রতি কেজি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ থেকে ১০০০/১২০০ টাকায়। স্থানীয় নদীর ইলিশ হলে ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ টাকা কেজি। আড়তে এবং বাজারে প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেলেও চড়া দাম হাঁকছেন বিক্রেতারা। তাই সাধ থাকলেও সাধ্যের কারণে মাছটির স্বাদ নিতে পারছেন না সাধারণ ক্রেতারা। দূর-দূরান্ত থেকে আগত একাধিক ক্রেতা বলছেন, বাজারে এক কেজি ওজনের মাছের যা দাম দেখি তাতে কেনার সাহস হয় না।
জানা যায়, ইলিশের ভরা মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস। পাঁচশ’ গ্রাম থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ এই আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ৯০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। গত বছর একই সময় একই আকৃতির ইলিশের দাম ছিলো সাড়ে ছয়শ’ থেকে সাড়ে সাতশ’ টাকা। এমন তথ্য দিচ্ছে ইলিশ কিনতে আসা ক্রেতা সাধারণ। বারশ’ থেকে চৌদ্দশ’ টাকার বেশি পড়ছে এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশের দাম। সরেজমিনে ঘাটের আড়তগুলো ঘুরে দেখা যায়, হাজী মালেক খন্দকার, হাজী বাবুল হাজী, গফুর জমাদার, ছোট সিরাজসহ অন্য আড়তগুলোতে ইলিশের স্তূপ। ইলিশ-সংশ্লিষ্ট শত শত মানুষ কেনাবেচা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত দুদিনে ৮ থেকে ১০টি ইলিশ-বোঝাই ফিশিং বোট ও ৫/৭টি পিকআপভর্তি হয়ে আসায় বড়স্টেশন মাছঘাট ইলিশে সয়লাব। প্রায় ৫ হাজার মণ ইলিশের আমদানি হয়েছে বলে জানান চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী শবে বরাত সরকার। তিনি বলেন, ইলিশ ধরা পড়ার অনুকূল পরিবেশ জো, বাতাস ও বৃষ্টি ছিলো বলে সাগর উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। আমাদের ব্যবসায়িক লেনদেন থাকায় ভালো দামের আশায় বৃহত্তর নোয়াখালীর হাতিয়া, রামগতি, আলেকজান্ডার ও লক্ষ্মীপুর এলাকা থেকে এসব ইলিশ আসায় দামও কেজিতে দুই-তিনশ’ টাকা কমেছে। ইলিশের এমন আমদানি আরো ক’দিন থাকলে দাম আরো কমবে। স্থানীয় নদীতে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওই মৎস্য ব্যবসায়ী নেতা। আলী আকবর নামে ঘাটের একজন ইলিশ ব্যবসায়ী বলেন, এখন ইলিশের দাম হওয়ার কথা সবচেয়ে কম। কিন্তু এখনই সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এ মাছ। ঘাটে এখন যেই ইলিশ দেখা যাচ্ছে তার সিংহভাগই সাগরের। ঘাটে মাছ বেশি দেখলে কী হবে, এসব মাছ এখান থেকে অন্যত্র চালান হয়ে যাচ্ছে, আবার ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে। লোকাল নদীর মাছ হলে ইলিশের দাম ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা কেজি। সাগরের ইলিশ হওয়াতে হাজার-বারোশ’ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ৬০০ গ্রাম ওজনের একটি মাছ কিনতে হয়েছে ৯০০ টাকায়, ১৫০০ টাকা করে কেজি। কিন্তু এই মাছটির দাম হওয়া উচিত ছিলো ৪০০ টাকা। দামের কারণে বিত্তবানরাই ঠিকমতো ইলিশ খেতে পারছে না, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের তো খাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। সচেতন মহলের মতে, এবার সকল পণ্যেরই দাম বাড়ায় এর প্রভাব ইলিশ মাছের উপরও পড়েছে। তাই ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
আমরা চাঁদপুরে ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম সাধারণ ক্রেতাদের সামর্থ্যরে অনুকূলে না থাকার পেছনে অনেক কারণ পর্যবেক্ষণ করছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা, নিষ্ক্রিয়তা কিংবা অন্য কিছু। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ নামে চাঁদপুরের নূতন নামধারণ সত্ত্বেও পরিহাস হচ্ছে, গত ক’বছর ধরে স্থানীয়-অস্থানীয় তথা সারাদেশের বিত্তবান মানুষ ছাড়া মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের মানুষগুলো তথা সাধারণ মানুষ মোটেও ইলিশ খেতে পারছে না। এজন্যে সাধারণ্যে চাপা ক্ষোভ, এমনকি প্রকাশ্য ক্ষোভও দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ তো সরকারের দেয়া ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ নামটি প্রত্যাহার এবং ইলিশকে জাতীয় মাছের তকমা দেয়ার বিষয়টি বাতিলে জাতীয় সংসদে আলোচনার দাবি জানিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ইলিশ নিয়ে যে নেতিবাচকতা দিনের পর দিন বাড়ছে, তাতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটি বিবেচনার দাবি প্রকট হচ্ছে। এ ব্যাপারে মৎস্য মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনকে সতর্ক হবার জোর অনুরোধ জানাচ্ছি।