প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১১২৯ জন প্রাণ হারায়, ৯৯৬জন নিখোঁজ হয় ও ২৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়, যার অধিকাংশই ছিলো পোশাক শ্রমিক। এই দুর্ঘটনাটি ছিলো বিশ্বের ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। রানা প্লাজা নামের এই বহুতল ভবনটিতে ফাটল থাকায় সেটি ব্যবহারের বিষয়ে আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও সেটি উপেক্ষা করায় অনিবার্য দুর্ঘটনা এড়ানো যায়নি। এ দুর্ঘটনা ঘটার পর সারাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে শুরু হয় অনুসন্ধান ও সতর্কবার্তা জারির হিড়িক। কেবল শতোর্ধ্ব, তদূর্ধ্ব বয়সী জরাজীর্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ব্যাপারে নয়, পঞ্চাশোর্ধ্ব, তদূর্ধ্ব, এমনকি পঞ্চাশের চেয়ে কম বয়সী জরাজীর্ণ ভবনের বিষয়েও সতর্কতা জারির কোশেশ চালায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে, দায়দায়িত্বের জবাবদিহিতায় দোষ থেকে বাঁচতে কর্তৃপক্ষীয় এই প্রয়াস ছিলো স্বস্তিদায়ক। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে ছিলো উদ্দেশ্যমূলক, সুযোগসন্ধানীদের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহৃত হবার কারণে ছিলো দৃষ্টিকটু। এটা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় অনেক ভবন মালিককে হতে হয় অযথা হয়রানির শিকার। তারপর সময়ের একটা ব্যবধানে সবাই চুপ হয়ে যায়, থেমে যায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনকেন্দ্রিক সকল তৎপরতা। মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে এগুলোর দৃশ্যমান বিকট অস্তিত্ব অনেককে আতঙ্কিত করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনককে নড়ায় না। কারণ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সক্রিয়তার গতি বাড়লেও দুঃসহ স্মৃতি ক্রমশ মন থেকে মুছতে থাকে এবং ওই সক্রিয়তাও তিরোহিত হতে থাকে। এটা আমাদের দেশের মানুষের অতি সাধারণ প্রবণতা। এই প্রবণতা থেকে, একটা খোলস থেকে কেন যেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না।
সাভারে এতো বড় ভবন ধসের ঘটনার এক দশক পূর্তির ২০ দিন বাকি থাকতেই চলতি ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার ফুলবাড়িয়া এলাকার বহুল পরিচিত পোশাকের পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজারে ঘটলো এমন অগ্নিকাণ্ড, যাতে কতোটি দোকান পুড়েছে সেটি বড়ো কথা নয়, পুড়েছে লাখো মানুষের স্বপ্ন। এ ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস বিভাগ আগুনের ঝলকানিতে নিজেকের কম-বেশি নিষ্ক্রিয়তার অন্ধকার দূর করে সক্রিয়তার আলোয় নিজেদের উদ্ভাসিত করে তোলে। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ভবন, সপিং মল, বাজার সহ বিভিন্ন স্থাপনা নিয়ে তাদের তোড়জোড় শুরু হয়। তারপর? তিন মাস সময় পেরিয়ে চার মাস পেরুবার সময় হয়েছে। সক্রিয়তাকে অদৃশ্য শক্তি পদদলিত করে আবার নীরবতাকেই সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। অবস্থা এখন যেই-সেই।
এর মধ্যে অগ্নিকাণ্ড থেমে নেই। চাঁদপুর সহ সারাদেশেই ঘটছে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড। গত ২৩ জুলাই মধ্যরাতে চাঁদপুর শহরের সাবেক কুমিল্লা রোড, বর্তমান মিজান চৌধুরী সড়কস্থ মিয়া ম্যানশন ভবনের নিচতলায় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ৫/৭টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, এটি একটি অপরিকল্পিত বহুতল ভবন। ভবন মালিক আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্যে নিচের অংশে অর্থাৎ পিছনের দিকে অপরিকল্পিতভাবে বেশ কিছু রুম করে তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন। যেভাবে রুম করা হয়েছে তাতে একজন মানুষ হাঁটা-চলার জায়গা পর্যন্ত নেই। ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পুরো আগুন নিভাতে সক্ষম হন। যদিও প্রথম অবস্থায় তাদের বেশ হোঁচট খেতে হয়। পরে কৌশল অবলম্বন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চাঁদপুরের সহকারী উপ-পরিচালক মোরশেদ হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, ভবনটির নিচে তথা ঘটনাস্থলে যেভাবে গোডাউন বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো করা হয়েছে, এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এভাবে করা হলে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সকলকে এ সকল বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
কথা হলো মোরশেদ হোসেনের ন্যায় ফায়ার সার্ভিসের ছোট-বড় কর্মকর্তা ও গণপূর্ত বিভাগের এমন কর্মকর্তাসহ সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার ক্ষোভ, আক্ষেপ, আবেগ, সক্রিয়তা সহ অনুসন্ধান, জরিপ, সচেতনতা, সতর্কতা সহ প্রাসঙ্গিক কর্মসূচি নিতান্তই সাময়িক, দুর্ঘটনাকেন্দ্রিক। দুর্ঘটনা ছাড়া আমাদের কর্মকর্তাদের সক্রিয় করতে এমন কী করা যায়, সেটা নিয়ে সময় থাকতে আমাদের গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে। যদি আমরা এমনটি ভাবি, তাহলে সময়ের এক ফোঁড়ে আমরা করতে পারবো অনেক কাজ, যেটা নয় ফোঁড়ের বাড়তি ঝামেলা-ঝুঁকি এড়াতে হবে সহায়ক। সর্বোপরি সময়োচিত দায়িত্বপালনের সঠিকতায় আমাদেরকে কার্যত করবে স্মার্ট। এতে আমরা দুর্ঘটনায় সক্রিয়তা, তারপর নিষ্ক্রিয়তার অপবাদ থেকে ক্রমশ নিজেদেরকে পরিত্রাণ দিতে সক্ষম হবো, যেটি আর অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।