প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:১৯
নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিলের টাঙ্গুয়ার হাওর

(২য় পর্ব)
|আরো খবর
বারিক্কা টিলা বারেক টিলা, যা বারিক্কা টিলা ও বারেকের টিলা নামেও পরিচিত। সবুজে মোড়া উঁচু টিলার একপাশে পাহাড়, অন্যপাশে স্বচ্ছ জলের নদী। টিলার ওপর দঁাড়ালে হাতছানি দেয় মেঘ-পাহাড়। হাওর-নদী-পাহাড়ের এই অপরূপ সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি একটি উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান।
তাহিরপুর উপজেলার বড়দল উত্তর ইউনিয়নের লাউড়েরগড় এলাকায় ভারত সীমান্ত ঘেঁষা বারেক টিলা। একপাশে বাংলাদেশের সীমান্ত, ওপাশে ভারতের মেঘালয়, খাসিয়া পাহাড়। বারিক্কা টিলাতে রয়েছে ৪০টির মত আদিবাসীদের পরিবার। একপাশে পাহাড়, অন্য পাশে টিলা, তার পাশ দিয়ে নদী, সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ভারতের পাহাড়ে রয়েছে একটি তীর্থস্থান ও একটি মাজার। বছরের নির্দিষ্ট ভিন্ন ভিন্ন দিনে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের হাজার হাজার লোক জড় হয় পুণ্য স্নান ও ওরসে, তখন ২-১ দিনের জন্যে সীমান্ত উন্মুক্ত করা হয়। বর্ষায় উত্তর দিকে মেঘালয় পাহাড়ে মেঘগুলো মনে হয় হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। পাহাড়ের গায়ে নানা রঙের মেঘের খেলা। মেঘ কখনো সবুজ পাহাড়কে ঢেকে দিচ্ছে, আবার কখনো বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার আপন ভালোবাসায়। পাহাড় আর মেঘের সম্মিলনে এক অপরূপ শোভা। মেঘালয় পাহাড়ের অঁাকাবঁাকা সড়কপথে চলাচল করে ভারতীয় বিভিন্ন যানবাহন।
আম, জাম, কঁাঠাল, জলপাই, লিচুসহ নানা ধরনের গাছ টিলা থেকে কেটে বাজারে বিক্রি ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একসময় বারেক টিলায় স্থানীয় আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ ছিলো। তখন আনারস, লেবু, কমলা, পানিজাম, বেল, কমলালেবু, টিলাজুড়ে বেত উলুবন ও কাশবনের বাগান শোভা পেত। বর্তমানে বৃক্ষহীন বারেক টিলা। পাথর উত্তোলনের জন্যে আবাধে যত্রতত্র মাটি খেঁাড়াখুঁড়ি, গাছ কেটে ফেলার কারণে টিলাগুলো তার আসল সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে।
বছরের যে কোনো সময় সুনামগঞ্জ বৈঠাখালি খেয়াঘাট হতে মোটরসাইকেল যোগে সরাসরি যাদুকাটা ও বারেক টিলা যেতে সময় লাগে ৪৫ মিনিটে, টাকা খরচ হয় জনপ্রতি ২০০ টাকা। সরকারি বা বেসরকারি কোনো উন্নত মানের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ শহরে ফিরে যেতে হয় পর্যটকদের। সেখানে রয়েছে আধুনিক রেস্ট হাউজ, হোটেল রেস্তোরঁাসহ অন্যান্য সুবিধা ।
জেলা শহর সুনামগঞ্জ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নান্দনিক সৌন্দর্যে ঘেরা বারেক টিলা। প্রতিদিনই দূরদূরান্ত হতে কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীসহ ভ্রমণ পিপাসুদের নৌ-বিহারে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠে যাদুকাটার বুক। দর্শনার্থীদের কেউ মায়ার নদী কেউবা রূপের নদী বলে অভিহিত করেন এই নদীকে। বর্ষায় পাহাড়ি নদী যাদুকাটার বহমান স্রোতধারায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ভীড় জমায় প্রকৃতিপ্রেমীরা। আর হেমন্তে শুকিয়ে যাওয়া যাদুকাটার বুক জুড়ে ধুধু বালুচরে প্রিয়জন নিয়ে হেঁটে চলা ও যাদুকাটার স্বচ্ছ পানিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে পরম তৃপ্তি বোধ করেন পর্যটকরা।
যাদুকাটা নদী থেকে হাত বাড়ালেই ছেঁায়া যায় শাশ্বত সবুজে ঘেরা বারেক টিলা। বারেক টিলায় ঘুরে ঘুরে যাদুকাটা নদীর প্রকৃত রূপ উপভোগ করা সম্ভব। বারেক টিলার সবুজ বনায়ন ও চারপাশে নদী, পাহাড় ও হাওরের মনোরম দৃশ্যে মন হারিয়ে যায় ভ্রমণপ্রেমীদের।
যাদুকাটা নদীর তীরঘেঁষে পূর্ব-উত্তর পাশের্ব অবস্থিত ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত শাহ আরেফিন (রহ)-এর আস্তানা। নান্দনিক সৌন্দর্যে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিদিনই বিকেলে পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটাতে আসেন অনেকেই। আমরাও আসলাম এবং বিমোহিত হলাম।
আসলেই অনেক সুন্দর। যে দিকেই চোখ যায় শুধুই সুন্দর। আমাদের নৌকা বারেক টিলায় আসলো বিকেলে। সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা ঘুরে ঘুরে উপভোগ করলাম ভারতের শেষ সীমানা মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়, যাদুকাটা নদী, বারেক টিলা এবং পাশের টাঙ্গুয়ার হাওর।
সন্ধ্যার পর নৌকা আবার চলতে থাকলো। নৌকা হাওরের মাঝখানে। নয়টার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর নৌকার ছাদে শুয়ে শুয়ে জোছনা দেখলাম। উপরে পূর্ণ চঁাদ, নিচে নৌকা, পাশে হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি, মৃদু বাতাস, দূরে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের কিছু অংশে ইলেকট্রিসিটির আলো, সব মিলিয়ে মায়াময় এক স্বপ্নিল পরিবেশ। যা হৃদয়ে দাগ কেটে গেছে, যে দাগের স্থায়িত্ব অনন্তকাল থাকবে। আমরা যে এলাকাটিতে রাত্রিযাপন করেছি, মাঝি জানালো সে স্থানের নাম ব্লাকমা।
লাকমা ছড়া
জাহিদ সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে তাড়া দিলো। তার তাড়াতেই আমরা ৮টার মধ্যে নৌকা থেকে বের হলাম। রাস্তায় উঠে দেখি জাহিদ মাঝির সাথে কথা বলে বাইকও ঠিক করে নিলো। আমরা বাইকে করে সরাসরি লাকমা ছড়ায় চলে গেলাম। আমরা যে সময় লাকমা ছড়ায় গেলাম তখন পুরোটাই ছিলো শুকনো। শুধুমাত্র একেবারেই ছোট একটি নালায় পানি প্রবাহিত ছিলো। কেউবা এ অঞ্চলকে বলেন হাওরের রাজধানী। রূপের রাণীও বলেন কেউ কেউ। কবিরা বলেন জোছনার শহর। হাওর-বঁাওড় আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা নিজের মতো করে তুলে ধরতে সুনামগঞ্জের সুনাম এভাবেই লোকমুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। টেকেরঘাটের লাকমা ছড়া দর্শনে প্রকৃতিপ্রেমীদের ভালো লাগবে। কারণ, এই স্থানটি এখানো একেবারেই প্রাকৃতিকভাবেই আছে। এখানে এখনো কোনো ইমারত গড়ে উঠেনি। পর্যটকের ভীড় তেমন একটা নেই এখানে। স্থানীয়ভাবে পাহাড়ি ছোট ছোট নালাকে ছড়া বলা হয়। এখানে লাকমা নামের একটি গ্রাম আছে। টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পের পশ্চিমের মাথার শেষ প্রান্তে দৃষ্টিনন্দন লাকমা ছড়াটি এরই মধ্যে পর্যটকদের নজর কেড়েছে।
এ ছড়ার পানি লাকমা গ্রাম ছুঁয়ে পাঠলাই নদী ও টাঙ্গুয়ার হাওরে এসে নামে। বুনো পাহাড় ও সাদা মেঘ ছুঁয়ে ছড়াটি ধীরে ধীরে যেন ভাটিতে নেমেছে। এখনো কোনো অবকাঠামো গড়ে না ওঠায় অনেকটা প্রাকৃতিক আবহেই নিজেকে বঁাচিয়ে রেখেছে লাকমা ছড়া। তাই প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকরা এ স্থানে এসে আরো বেশি মুগ্ধ হয়। (চলবে)