প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩৫
নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিলের টাঙ্গুয়ার হাওর

(৩য় পর্ব)
|আরো খবর
নীলাদ্রি লেক ও শিমুল বাগান
আমাদের বাইক চলছে তো চলছে। রাস্তার একপাশে ভারতের বিশাল এবং দীর্ঘ পাহাড়, অন্যদিকে বাংলাদেশের সমতল ভূমি। কখনো পিচঢালা পথ, কখনো কঁাচা রাস্তা, কখনো সলিং আবার কখনো নদীর বিচ, আবার কখনো শুকনো চরের বুক মাড়িয়ে চলছে আমাদের মোটর বাইক। আপাতত আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের বিখ্যাত শিমুল বাগান। এই বাগানকে বলা হয়ে থাকে এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো শিমুল বাগান। তবে কিসের ভিত্তিতে বলা হয় সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।
জাদুকাটা নদীর তীরে ১০০ বিঘা জমিতে দোল খাচ্ছে সারি সারি শিমুল গাছ। বসন্তের আগমনে সেসব গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। বসন্ত বাতাসে শিমুল ফুলের নৃত্যের নান্দনিক দৃশ্য দেখতে সেখানে প্রতিদিন ভিড় করছেন নারী-পুরুষ, শিশুসহ নানা বয়সী দর্শনার্থী। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই দুর্লভ দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারলাম না। কারণ বসন্ত আসার কয়েক মাস আগেই আমরা সেখানে গেলাম। বসন্তে যদি সেখানে উপস্থিত থাকতাম তাহলে পাহাড়ি নদী জাদুকাটার তীরজুড়ে কেবল শিমুলের মুগ্ধতা দেখতাম। দেখতাম রক্তরাঙা শিমুল সবাইকে জানাচ্ছে বসন্তের অভিবাদন। কেউ যখন এতো লাল ফুল একসঙ্গে দেখে তখন তার মধ্যে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। মনটা ভরে যায় স্নিগ্ধতায়। ছন্নছাড়া মানুষও এখানে এসে ভাবুক হয়ে যায়, প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যায়। এখানে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, বড়গোপটিলা আর জাদুকাটা নদীর সমন্বয়ে জায়গাটার সৌন্দর্য আরও বেড়েছে। মাথার ওপরে ফুটে থাকা ফুল ঝরে পড়ে কোথাও কোথাও লাল গালিচা তৈরি হয়।
শুনেছি রাশি রাশি শিমুল ফুল পড়ে থাকে বাগানজুড়ে। শিশুরা ফুল কুড়িয়ে মালা তৈরি করে। দর্শনার্থীদের কাছে সেই মালা বিক্রি করে ১০ থেকে ২০ টাকায়। অনেকে ঘোড়ার পিঠে ছড়ে বাগানে ঘুরে বেড়ান। এতে আয়ের পথ তৈরি হয়েছে ঘোড়ার মালিক ও ছবিয়ালদের। শিমুলের এই স্বর্গরাজ্যের শুরুটা হয় ২০০৩ সালে। উপজেলার বাদাঘাট ইউপি চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নাল আবেদীন পতিত জমিতে গড়ে তোলেন এই বাগান। সময়ের স্রোতে একদিন বসন্তের আগমন ঘটবে, আবার একদিন ফুরাবে তার নিবেদন। তবে তাহিরপুরের রূপে ভাটা পড়বে না এতোটুকু। শহীদ সিরাজ লেক, বড়গোপটিলা, টাঙ্গুয়ার হাওর, মেঘালয় পাহাড়, আর সেই পাহাড় বেয়ে নেমে আসা জাদুকাটা নদীর জাদুর টান রয়ে যাবে বছরজুড়ে।
ফুলবিহীন বাগানে বেশিক্ষণ অবস্থান না করে রওয়ানা দিলাম মায়াবী নীলাদ্রি লেকে। এখানে না আসলে মিস করতাম অনেক কিছু।
আমি বাংলাদেশের অনেক স্থানে ঘুরতে গেছি। এখানে আসার আগ পর্যন্ত আমার চোখে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম স্থান ছিলো বান্দরবান। কিন্তু এখানে আসার পর সেটা পরিবর্তন হয়ে গেলো। স্থানটি খুবই ছোট কিন্তু সৌন্দর্যে অনেক বড়ো। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই স্থানটি পৃথিবীর কোনো ভূমি। কাশ্মীর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শুনেছি কাশ্মীরকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর স্বর্গ। আমার কাছে এই স্থানটিকেও পৃথিবীর স্বর্গ মনে হচ্ছে।
নীলাদ্রি লেকের অফিসিয়াল নাম শহীদ সিরাজ হ্রদ বা শহীদ সিরাজ লেক। এটি বাংলাদেশের তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত। সীমান্তবর্তী ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনিজ প্রকল্পের পরিত্যক্ত এই কোয়ারীটি ১৯৪০ সালে চুনাপাথর সংগ্রহ শুরু করে। এখানে চুনাপাথর সংগ্রহ করে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় নির্মিত আসাম বাংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা মিটানো হতো। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর বিভিন্ন সমস্যা ও ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় এর সকল কার্যক্রম। পরে ১৯৬০ সালে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু রাখার জন্যে চুনা পাথরের প্রয়োজনে ভূমি জরিপ চালিয়ে সীমান্তবর্তী ট্যাকেরঘাট এলাকায় ৩২৭ একর জায়গায় চুনাপাথরের সন্ধান পায় বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে খনিজ পাথর প্রকল্পটি মাইনিংয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পাথর উত্তোলন করা হয়। ১৯৯৬ সালে এই প্রকল্পটি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোয়ারী থেকে চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ করে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সিরাজুল ইসলামের নামানুসারে এই হ্রদের নামকরণ করা হয়। মো. সিরাজুল ইসলাম ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার ফিলনী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্নাতকে পড়াকালীন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঘর ছাড়েন সিরাজ। আসামের ইকো ওয়ান সেন্টারে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাবসেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট সুনামগঞ্জের সাচনা বাজার এবং জামালগঞ্জ থানা থেকে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করার লক্ষ্যে আক্রমণ চালান একদল মুক্তিযোদ্ধা। এই দলে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। পাকিস্তানি সেনারা তঁাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যাপক গুলি শুরু করে। এ অবস্থায় সিরাজুল ইসলাম ক্রলিং করে গ্রেনেড চার্জ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় অপর দিক থেকে ছোড়া একটি গুলি তার চোখ ভেদ করে চলে যায়। তিনি শহীদ হন। সিরাজের জীবনের বিনিময়ে সেদিন সাচনা বাজার এবং জামালগঞ্জ পাকিস্তানি মুক্ত হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর শহীদ সিরাজকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার। হ্রদের পাশেই সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার কবরও সংরক্ষিত রয়েছে এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ স্মৃতি সংসদ গড়া হয়েছে।
লেকের চমৎকার নীল পানি, ছোট-বড় টিলা আর পাহাড়ের সমন্বয়ে নীলাদ্রি লেককে করেছে অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের জন্যে নীলাদ্রি লেক দেখে অনেক পর্যটক একে বাংলার কাশ্মীর হিসেবে অভিহিত করেন। সত্যি বলতে এখান থেকে আসতে মন চাচ্ছিলো না। বাইক চালকদের তাড়ার কারণে চলে আসতে হলো। জানি না আবার কবে যেতে পারবো। আবার কবে দেখা হবে নীলাদ্রি, যা আমাকে নীলাক্রান্ত করেছে।
তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন ও শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, দ্বিতীয় ভাগ, প্রথম খণ্ড।
লেখক পরিচিতি : প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি : ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম; সাধারণ সম্পাদক : ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাব।