প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৩৬
নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিলের টাঙ্গুয়ার হাওর

(১ম পর্ব)
|আরো খবর
টাঙ্গুয়ার হাওরের গল্প শুনে শুনে আর ভিডিও দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছি যে, সশরীরে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে হৃদয় গহীনে। যাবো বলে কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও দু-একজনের কারণে শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না। শেষ পর্যন্ত উপজেলার প্রবীণ সাংবাদিক, শিশু সংগঠক, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফরিদ আহমেদ রিপন ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় আমার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত সেই টাঙ্গুয়ার হাওর দেখা হলো। যদিও রিপন ভাইয়ের পছন্দের স্থান ছিলো রাঙ্গামাটি। আমি বললাম ‘রাঙ্গামাটি অন্য সময় যাবো, এবার চলেন টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে আসি। তিনি আর দ্বিমত করলেন না। ঢাক ঢোলও পিটালাম না। একেবারে হঠাৎ করে ২দিনের প্রস্তুতিতে নীরবে নিভৃতে চলে গেলাম সুনামগঞ্জ। সময় না নেওয়ার কারণ হলো নির্দিষ্ট একটা তারিখ নির্ধারণ করলে সেদিন কারো না কারো সমস্যা থাকে। আর লম্বা তারিখ দিলে হয় না। ভ্রমণ সঙ্গীর সংখ্যা কমিয়ে তারিখ নির্ধারণের পরেও একদিনের ব্যবধানে একজন যাবে না বলে জানিয়ে দিলো। সবাইকে দুদিন আগে বললেও আনোয়ার হোসেন সজিব ভাইকে একদিন আগে বলেছি। তিনি একদিনের প্রস্তুতিতে আমাদের সাথে চলে আসলেন। আনোয়ার ভাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। লেখার বাঁকে বাঁকে আমাদের সফরের অন্য বন্ধুদের কথা চলে আসেব ইনশাআল্লাহ।
রিপন ভাইকে কল দিয়ে বললাম, ভাই ভালো লাগছে না; চলেন কয়েকদিনের জন্যে দূরে কোথাও চলে যাই। তিনি বললেন- ‘ঠিক আছে পরিকল্পনা সাজিয়ে সন্ধ্যায় আমাকে দেখাও।’ সাথে সাথে জাহিদকে কল দিলাম। জাহিদ আসলো এবং দুজন মিলে টাঙ্গুয়ার হাওরের লিখিত পরিকল্পনা করলাম। সন্ধ্যায় রিপন ভাইকে দেখালাম। রিপন ভাই বললেন- “ওকে। আমাদের সাথে কে কে যাচ্ছেন আগামীকালের মধ্যে জানাও। আর আমি ঢাকা থেকে একজন গেস্ট নিতে চাই। কোনো সমস্যা আছে?” আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই। পরে জানতে পারলাম আমাদের সফর সঙ্গী হচ্ছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক নেতা জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, যিনি ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি। চাঁদপুরের কৃতী সন্তান জাহাঙ্গীর আলম প্রধান বর্তমানে ‘জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক ফোরামে’র সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। এমন একজন মানুষকে সফর সঙ্গী পেয়ে আমরা ধন্য। তাঁর কারণে আমাদের ভ্রমণ স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর রাত ৮টায় ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ জেলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়িতে অনেক মজা করলাম। গভীর রাতে আমরা আখাউড়ায় রাতের খাবার খেলাম। কেউ গরুর মাংস দিয়ে ভাত, কেউ আবার গরুর মাংস দিয়ে রুটি খেলাম। গরুর মাংসের রান্নাটা অসাধারণ হয়েছে।আখাউড়া
আখাউড়া একটি বিখ্যাত, আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আখাউড়া উপজেলা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি প্রশাসনিক এলাকা। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ উভয় ঘটনার জন্যে একটি ঐতিহাসিক শহর। আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ও বাংলাদেশের অন্যতম আন্তর্জাতিক স্থল বন্দর। এ উপজেলার আয়তন ৯৮.০৫ বর্গ কিলোমিটার (২৪,২২৮ একর)। এর উত্তরে বিজয়নগর উপজেলা, দক্ষিণে কসবা উপজেলা, পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা ও কসবা উপজেলা। এই অঞ্চলটি হরিকেল নামক জনপদের অংশ ছিলো। কালক্রমে অঞ্চলটি ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মাণিক্য বাহাদুরের জমিদারের অংশে পরিণত হয়। এই জমিদারের চাকলা রৌশনাবাদ এস্টেটের মোগড়া রাজকাচারী ও আখাউড়াস্থ তহশীল কাচারীর ছিলো। এই কাচারী দুটির মাধ্যমে এই অঞ্চলের জমিদারির যাবতীয় খাজনাদি আদায়সহ জমিদারি ব্যবস্থা পরিচালিত হতো। মহারাজার জমিদারির দ্বিতীয় রাজধানী ছিলো কুমিল্লা। কুমিল্লার রাজবাড়িতে যাতায়াতের জন্যে সে সময় আখাউড়া-আগরতলা সড়ক ব্যবহৃত হতো। এছাড়া আসাম বেঙ্গল রেলপথে চলাচলের জন্যে জমিদার সপরিবারে আখাউড়া কাচারীতে অবস্থান করতেন। তিনি এ অঞ্চলের রাধানগরে রাধামাধবের আখড়া, দুর্গাপুরে দুর্গাদেবীর আখড়া, মোগড়া হাওড়া নদীর পাড়ের আখড়া, মনিয়ন্দের আখড়া ইত্যাদি নিজ খরচে নির্মাণ করেছিলেন। সে সময়ে এ অঞ্চলে আখড়ার আধিক্যের কারণে এই অঞ্চল কালক্রমে আখাউড়া নামে পরিচিতি লাভ করে বলে প্রচলিত আছে। এছাড়া এটি সে সময়ের পূর্ববঙ্গের প্রবেশদ্বার বলে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমান আখাউড়া বাংলাদেশের সর্ব পূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা সীমান্তবর্তী স্থানে অবস্থিত। ব্রিটিশ আমলে আখাউড়া থেকে প্রচুর পাট সুদূর বিলেতের শিল্পনগরী ডাণ্ডিতে রপ্তানি হতো। ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে এই রেল স্টেশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।
ইংরেজ শাসনামলে কসবার ১০টি ইউনিয়ন আখাউড়া উপজেলার ছিলো। পরে কসবা উপজেলা হয় ১৯৭৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আর আখাউড়া উপজেলা হয় ১৯৮৯ সালের ২৩ এপ্রিল। আখাউড়া উপজেলা ব্রিটিশ আমলে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী ছিলো, পরে এটাকে কুমিল্লায় স্থাপন করা হয়। কসবা উপজেলা আগে আখাউড়া উপজেলার একটি সাধারণ ইউনিয়ন ছিলো। আখাউড়া উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ৫টি ইউনিয়ন রয়েছে।
আখাউড়া জংশন বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলওয়ে জংশন। এখানে সব আন্তঃনগর ট্রেন স্টপেজ দেয়। শুধু সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস স্টপেজ দেয় না। আখাউড়া বাইপাস আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে আছে। এখানকার উল্লেখযোগ্য স্থান ও স্থাপনা হলো-- আখাউড়া স্থল বন্দর, খড়মপুর মাজার শরীফ, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের কবর, ঘাগুটিয়া পদ্মবিল। এখানে বেশ কিছু মেলা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেলাগুলো হলো : খড়মপুড় ওরস, খড়মপুড় বান্নী, ধরখাড় মেলা ও ভাটামাথা কালীবাড়ির মেলা। আখাউড়ার বিখ্যাত কয়েকজন ব্যক্তি : শহীদ বুদ্ধিজীবী আতাউর রহমান খান খাদিম (পদার্থ বিজ্ঞানী), আবদুর রহমান (বীর প্রতীক), আবদুর রশিদ (বীর প্রতীক), প্রবোধ চন্দ্র সেন (ছন্দ বিশারদ), সাফিল মিয়া (বীর উত্তম), মঙ্গল মিয়া (বীর প্রতীক)।তাহিরপুরে
রাতের খাবার শেষে আমাদের গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অংশের বেশ কিছু রাস্তা খুবই খারাপ। রাস্তার কাজ চলমান। আমরা সকালে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় গিয়ে পৌঁছলাম। সুনামগঞ্জ জেলার দুটি উপজেলায় জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওর বিস্তৃত। ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর। ১১ নভেম্বর সকাল ৭টা ১০ মিনিটে আমাদের গাড়িটি তাহেরপুর সদরে পৌঁছে। গাড়ি পার্কিং করে গাড়ির চালকসহ আমরা আমাদের পূর্ব নির্ধারিত নৌকায় উঠি। এই নৌকাগুলোকে স্থানীয়রা বলে ‘হাউজ বোট’। আমি, জাহিদ, ফাহাদ, উজ্জ্বল এবং রুবেল বাজার করতে চলে গেলাম। বাকিরা নৌকায় রেস্ট নিচ্ছে। আমরা যে নৌকা ভাড়া করেছি তাতে কাপল রুম ৩টি, যেখানে ২ জন করে ৬ জন ঘুমাতে পারে, আর ওপেন বিছানা রয়েছে ২টি, যেখানে ৪ জন ঘুমাতে পারে।
তাহিরপুর সুনামগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত লাউড়ের পাহাড়ের নামানুসারে পৌরাণিক যুগের লাউড় রাজ্যের কালের সাক্ষী এই তাহিরপুর উপজেলা। যেটি বাংলাদেশের নির্বাচনী এলাকা ২২৪, সুনামগঞ্জ ০১। এই উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে জামালগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা, পশ্চিমে মধ্যনগর উপজেলা। তাহিরপুর উপজেলায় বর্তমানে ৭টি ইউনিয়ন রয়েছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, সুনামগঞ্জের লাউড় পাহাড়ে রাজা ভগদত্তের উপরাজধানী ছিল। জনশ্রুতি ও পুরাকীর্তির ভিত্তিতে বলা হয় লাউড় সিলেটের প্রাচীন রাজ্য। পুরাকীর্তিসূত্রে ধারণা করা হয়, মহাভারত যুদ্ধে নিহত রাজা ভগদত্তের পরে তাঁর বংশীয় ১৯ জন ঐতিহাসিক নৃপতি লাউড় অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। নিধনপুরের তাম্রলিপি সূত্রে বলা হয়, ভাস্কর বর্মন খ্রিস্টিয় ৬৫০ অব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চলের রাজত্ব করেন। পৌরাণিক যুগে শ্রীহট্ট ভূমি এ রাজ্যে গণ্য ছিল। লাউড় রাজ্যের সীমা ছিলো পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদ, পূর্বে জৈন্তিয়া, উত্তরে কামরূপ সীমান্ত ও দক্ষিণে বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত। খ্রিস্টয় সপ্তম
শতাব্দীর পরবর্তী সময়ে সিলেট অঞ্চলের ভৌগোলিক রূপরেখার পরিবর্তন ঘটলে লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা, হবিগঞ্জ জেলা এবং ময়মনসিংহ জেলার কিয়দংশে সীমা বিস্তার হয়। বঙ্গের রাজা হর্ষবর্মনের (রাজত্বকাল, ৭৩০-৭৫০) রাজত্বকালে ব্রহ্মপুত্র পরবর্তী সমস্ত রাজ্যসমূহে বিরাট ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করেন। এ সময় সমস্ত বঙ্গদেশ ভিন্ন ভিন্ন খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হয় এবং তখন সিলেটের প্রাচীন লাউড় রাজ্য কামরূপ থেকে বিভক্ত হয়ে একটি পৃথক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। দশম শতাব্দীতে লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তীয়া এই তিন রাজ্যে বিভক্ত ছিল সিলেট। পরবর্তীকালে (দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে) বিজয় মাণিক্য নামে জনৈক হিন্দু রাজা লাউড় রাজ্যে রাজত্ব করেন। এ সময় রাজা বিজয় মাণিক্যের লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিলো। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে রাজা বিজয় মাণিক্য জগন্নাথপুর উপজেলার পান্ডুয়ায় (বর্তমানে পেরুয়া) একটি শাখা রাজ্য স্থাপন করেন। যার নামকরণ করা হয় পান্ডুয়া রাজ্য। চৌদ্দশ সালের প্রথমার্ধে লাউড় এবং জগন্নাথপুর রাজ্যে অনেক জ্ঞানী পুরুষের জন্ম হয়। রাজ্যের রাজমন্ত্রী কুবেরাচার্য ছিলেন একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি। যার জ্ঞানের চর্চা ভারতবর্ষের অন্যতম বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ছিল। এছাড়া উক্ত রাজ্যের নবগ্রামে মাধবেন্দ্রপুরী নামে আরেকজন জ্ঞানী সাধু পুরুষ বসবাস করতেন। এই মাদেবন্দ্রপুরির কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে লাউড়ের যুবরাজ রমানাথ বা রামা ও মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যেচার্য সারা ভারতবর্ষে স্মরণীয় হয়ে আছেন। রমানাথ সিংহ উপযুক্ত হলে রাজা দিব্য সিংহ রাজ্যভার তাঁর পুত্র রমানাথকে দিয়ে, শান্তি সাধনায় তিনি তাঁর মন্ত্রীতনয় অদ্বৈত্যের আখড়া শান্তিপুরে চলে যান। সেখানে থেকে অদ্বৈত্যের উপদেশে বৈষ্ণবীধর্ম গ্রহণ করেন এবং সাহিত্য চর্চায় মনোযোগী হয়ে বাংলা ভাষায় বিঞ্চুভক্তি শাস্ত্র গ্রন্থ সহ আরও কয়েকটি গ্রন্থের অনুবাদ করেন। অতঃপর অদ্বৈত্য বাল্যলিলা গ্রন্থ রচনা করে কৃষ্ণদাস নামে আখ্যাত হন। মহাভারতের প্রথম বাংলায় অনুবাদকারী মহাকবি সঞ্জয়ের নিবাসও এই এলাকার। মহাকবি সঞ্জয় তার লেখায় বারবার রাজা ভগদত্তের কথা লিখেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনিন্দ্র বসু যে গবেষণা করেছেন, সেখানে তিনি বারবার ভগদত্ত ও লাউড়ের রাজার কথা উল্লেখ করেছেন।
লেখক সৈয়দ মুর্তজা আলী তাঁর রচিত ‘হযরত শাহ্জালাল ও সিলেটের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তার জ্ঞাতি ভ্রাতা জগন্নাথপুরের রাজা বিজয় সিংহের সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়েছিলেন। পরে রাজা বিজয় সিংহ গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হন। তখন ঐতিহাসিক লাউড় রাজ্যের রাজধানী সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার ‘হলহলিয়ায়’ ছিল, এখানকার ধ্বংসাবশেষও তা-ই জানান দিচ্ছে। প্রায় শতের শ শতকের শেষের দিকে গোবিন্দ খাঁ কর্তৃক শ্রীহট্ট ভূমির প্রাচীন রাজ্য ‘লাউড়’ ইহার অধিকার ভুক্ত হয়। যেটি মূলত তৎকালে জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজ বংশের অধিকারে আসার কথা ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জগন্নাথপুর রাজ্যের রাজ বংশ তাদের অধিকার হারায়। ঐ সময়ে বানিয়াচং রাজা গোবিন্দ খাঁ দিল্লীর সম্রাটদের দ্বারা মুসলমান হয়ে হাবিব খাঁ নাম ধারণ করে দেশে ফিরেন। সতেরো শ’ শতকের পরে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোঘলরা এর নিয়ন্ত্রণ নেন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুর জমিদারি এস্টেটের অধীনে ছিলো তাহিরপুর। অতীতে তাহিরপুর নামে কোনো গ্রাম ছিলো না। নিম্ন বর্ণের হিন্দুরাই এই এলাকার বাসিন্দা ছিলো।
জনশ্রুতি আছে, স্থানীয় পঞ্চায়েতের বিচারে তাহির আলী নামক একজন মুসলমান ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হন এবং নিজ এলাকা ত্যাগ করে বর্তমান তাহিরপুর এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। কালের প্রবাহে তাহির আলীর নামেই এলাকার নামকরণ করা হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জকে মহকুমায় উন্নীত করা হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রসারে ১৯২৪ সালে তাহিরপুর থানা ও পরবর্তীতে উপজেলা গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে তাহিরপুর সংলগ্ন খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে শরণার্থী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১৯৯৭-৯৮ সালে ভাসান পানি আন্দোলনে ১০ জন কৃষক প্রাণ হারায় এবং আরও অনেকে কারারুদ্ধ হয়। এ উপজেলায় জনসংখ্যা ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৮৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮০ হাজার ৫৩৭ জন আর মহিলা ৭৪ হাজার ৬৫১ জন। এর মধ্যে মুসলিম ১ লাখ ৪০ হাজার ১১১ জন। হিন্দু ১৪ হাজার ৩৬২জন, বৌদ্ধ ৫৭৮ জন, খ্রিস্টান ২৩ এবং অন্যান্য ১১৪ জন। এ উপজেলায় আদিবাসী গারো, হাজং প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
কথায় আছে, মৎস্য-পাথর-ধান হলো সুনামগঞ্জের প্রাণ। আর এই মৎস্য-পাথর-ধানের অন্যতম যোগানদাতা হলো তাহিরপুর উপজেলা। বিশেষ করে হাওড়ের বোরো ধান হলো প্রধান উৎস। আর এর পরে রয়েছে হাওরের মাছ। নদীতেও প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। তাহিরপুর উপজেলার ফাজিলপুরের বালি দেশ বিখ্যাত ও দেশের একমাত্র চুনাপাথর খনি রয়েছে এ উপজেলায়। এক কথায় তাহিরপুর উপজেলাটি মৎস্য, পাথর, বালু ও ধানের জন্যে বিখ্যাত। এছাড়াও বেশ কয়েক বছর ধরে এখানকার কয়লা অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।
এই উপজেলার প্রধান নদী : বাউলাই, রক্তি ও পাটনাল। বিলগুলো হলো : টাঙ্গুয়ার হাওড়, মতিয়ান বিল, সংসার বিল, আরবিয়াকোনা বিল, রাউয়ার বিল, সোনার বিল, চিপতি বিল, সোনাতলা বিল, পালাইর বিল, ঘরিয়াকুরী বিল, বটকাই বিল, শৈলদিঘা বিল, নাবাই বিল, কুপাউড়া বিল, গোলাঘাট বিল উল্লেখযোগ্য।
এ উপজেলার বিখ্যাত ব্যক্তিরা হলেন : বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈত আচার্য, কালজয়ী কথা সাহিত্যিক ও ভাষাসৈনিক শাহেদ আলী।
দর্শনীয় স্থানসমূহ : পনাতীর্থ স্নান, হাওলি জমিদার বাড়ি, শহীদ সিরাজ লেক, টাঙ্গুয়ার হাওর, যাদুকাটা নদী, বারেক টিলা, শিমুল বাগান, শনির হাওর, হাওর বিলাস, পাহাড় বিলাস, হাসন রাজা মিউজিয়াম, হযরত শাহ আরেফিন রহ.-এর আস্তানা।
কাঁচা বাজার করতে গিয়ে তো মাথায় হাত। ফরিদগঞ্জ থেকেও এখানে পণ্যের দাম বেশি। ফরিদগঞ্জের বিখ্যাত সেই উক্তিটি মনে পড়ে গেলো- ‘কাউ তলায় কাউ মাঙ্গা।’ মাছের দেশে এসে মাছ পেলাম না। এখানে প্রচুর হাঁস পালন করা হয়, কিন্তু হাঁসের দাম দেখে অবাক হলাম। পণ্যের দর কষাকষি করতে করতে নাস্তার সময় হয়ে গেলো। আমরা নাস্তা খেয়ে নিলাম আর যারা নৌকায় আছেন তাদের জন্যে নিয়ে নিলাম। ৯টার পর নৌকা ছেড়ে দিলো। নৌকার মধ্যে রান্নাবান্না, নৌকার মধ্যেই ঘুম, নৌকার মধ্যে খাওয়া-ধাওয়া, নৌকায় থেকেই গোসল, নৌকার ছাদে শুয়ে শুয়ে জোছনা দেখা অন্যরকম এক অনুভূতি। টাঙ্গুয়ার হাওরের সৌন্দর্যে আমি অভিভূত। তবে আফসোস হচ্ছে সঠিক সময়ে না আসতে পেরে। যদি আরো ১৫/২০ দিন আগেও আসতে পারতাম, তাহলে হাওরের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে পারতাম। বড্ড অসময়ে আসলাম। এখানে আসতে হবে ভরা বর্ষায়, না হয় বসন্তে অথবা শীতে। তিন ঋতুতে তিন রূপ দেখতে পাবে পর্যটকরা।টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রুপ জলমহালগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের ২য় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাংগুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬ হাজার ৯১২ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার একর। টাংগুয়ার হাওর প্রকৃতির অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ। এ হাওর শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারি। হিজলের দৃষ্টি নন্দন সারি এ হাওরকে করেছে মোহনীয়। এ ছাড়াও নলখাগড়া, দুধিলতা, নীল শাপলা, পানিফল, শোলা, হেলঞ্চা, শতমূলি, শীতলপাটি, স্বর্ণলতা, বনতুলসী ইত্যাদি সহ দুশ’ প্রজাতিরও বেশি গাছগাছালি রয়েছে এ প্রতিবেশ অঞ্চলে। জেলা প্রশাসনের কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থাগ্রহণের ফলে এ হাওরে রয়েছে ছোট-বড় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি এবং ২১ প্রজাতির সাপ। শীত মৌসুমে ব্যাপক পাখির আগমন ও অবস্থানে মুখরিত হয় টাঙ্গুয়ার হাওর। বিলুপ্ত প্রায় প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে-কিংস্টর্ক, শকুন এবং বিপুল সংখ্যক অতিথি পাখি ছিলো টাঙ্গুয়ার হাওরের অবিস্মরণীয় দৃশ্য। স্থানীয় জাতের পাখি পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক নানা প্রকার বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সারস প্রভৃতির সমাহারও বিস্ময়কর। সাধারণ হিসেবে বিগত শীত মৌসুমের প্রতিটিতে ২০/২৫ লাখ পাখি টাঙ্গুয়ার হাওরে ছিলো বলে অনুমান করা হয়। কোনো কোনো স্থানে কিলোমিটারের বেশি এলাকা জুড়ে শুধু পাখিদের ভেসে থাকতে দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওর মাছ-পাখী এবং উদ্ভিদের পরস্পর নির্ভরশীল এক অনন্য ইকোসিস্টেম।
নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল নামেও পরিচিত এই টাঙ্গুয়ার হাওর। এই হাওড় বাংলাদেশের অন্যতম মিঠাপানির জলাভূমি, যা আন্তর্জাতিকভাবেও বহুল সমাদৃত। এই হাওরে প্রায় ৪৬টি গ্রাম রয়েছে। বর্ষায় হাওরের সব কিছু ডুবে যাওয়ায় এই গ্রামগুলোকে তখন দ্বীপ গ্রাম বলেই মনে হয়। হাওর থেকে যে দৃষ্টিনন্দন পাহাড়গুলো দেখা যায় সেগুলোর অবস্থান ভারতের মেঘালয়ে। সেখান থেকেই নেমে আসে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি ঝর্ণার স্রোত। পাহাড় বিধৌত জল এসে মিশে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
প্রকৃতির আপন খেয়ালেই বেড়ে উঠেছে বিশাল এই জলাভূমি। প্রতিটি মৌসুমেই হাওর তার রূপের পরিবর্তন করে। টাঙ্গুয়ার হাওর কখনো আয়নার মতো স্বচ্ছ আবার আকাশের মতো নীল। নীল আকাশের সাদা মেঘের খেলা দেখা যায় স্বচ্ছ জলের মাঝে।
যান্ত্রিকতায় মোড়ানো শহুরে জীবনকে দুই তিনদিনের জন্যে বিদায় জানিয়ে চলে যান টাঙ্গুয়ার হাওরে। নৌকায় থাকার দিনগুলো আপনার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। নৌকার উপরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করতে পারবেন মেঘালয়ের পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য। ভোজন রসিকদের জন্যে হাওর ভ্রমণ খুবই পছন্দের। হাওরের নানান জাতের তাজা মাছ আর হাঁস দিয়ে হয় প্রতিবেলার উদরপূর্তি। নৌকার ছাদে বসে খাবেন আর উপভোগ করবেন হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সব চাইতে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। ভারতের মেঘালয় থেকে বয়ে আসা পানিতে হাওর কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। তখন হাওরের বিশালতা আপনাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করবে। মনে হবে কোনো এক সাগরে এসে পড়েছেন আপনি। বর্ষা ছাড়াও শীতেও যেতে পারেন হাওর ভ্রমণে। তখন দেখবেন দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ। যতদূর চোখ যাবে শুধু সবুজ আর সবুজ। হাওরের মাঝ দিয়ে সাপের মত এঁকে বেঁকে চলা নদী এবং সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা অতিথি পাখি আপনাকে বিমোহিত করবে। শীতে শিমুল ফুল ফোটে বলে হাওরের শিমুল বাগান তখন রক্তিম আভা ধারণ করে।
আমাদের নৌকার মধ্যে যে ছেলেটি শেফের দায়িত্ব পালন করেছে, তার রান্না অসাধারণ। এগারোটার দিকে আমাদেরকে একটা মুড়ির ভর্তা তৈরি করে দিলো। মনে হচ্ছে তার স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে। যে স্থানে ওয়াচ টাওয়ার আছে সেখানেই প্রথম নৌকা থেকে নামলাম। এ স্থানটিতে পূর্ণ বর্ষায় পানি থৈ থৈ করে। লোকজন হিজলের বাঁকে বাঁকে নৌকা নিয়ে ঘুরে। আমরা ঘুরলাম পায়ে হেঁটে। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পুরো হাওর দেখার চেষ্টা করলাম। নৌকা চালক আমাদের এখানে গোসল করার পরামর্শ দিলো। পানি স্বচ্ছ না হওয়ার কারণে এখানে গোসল করিনি। নৌকায় উঠে বসলাম। নৌকা আবার চলতে লাগলো। হঠাৎ নিরিবিলি একটি স্থান পছন্দ হলো। এখানকার পানি স্বচ্ছ আছে। মাঝিকে বললাম, এখানে নৌকা থামাও। এটা মূলত একটা নদী। ফাহাদ ছাড়া আমরা সবাই পানিতে নেমে পড়লাম। যাতে অনেকক্ষণ পানিতে থাকতে পারি, তাই মাঝি সবাইকে একটা করে লাইফ জ্যাকেট দিলো। কত বছর পর এভাবে নদীতে গোসল করছি মনে নেই। আমি, জাহিদ আর আনোয়ার ভাই অনেকক্ষণ সাঁতার কাটলাম। প্রায় আধা ঘণ্টার মতো আমরা পানিতে ছিলাম। নতুন পরিবেশ, নতুন স্থান এবং নতুন পানি; শরীর খারাপ করতে পারে তাই উঠে গেলাম। রিপন ভাইয়ের আনন্দ দেখে অভিভূত হলাম। এই বয়সে আমাদের সাথে যেভাবে মিশলেন এবং আনন্দ করলেন সত্যিই আমি অভিভূত। জাহাঙ্গীর ভাই সম্পূর্ণ বিপরীত। একেবারে চুপচাপ একজন মানুষ। গোসল শেষে শেফ আমাদের দুপুরের খাবার খেতে বললেন। আমরা বললাম না এখানে না। নতুন একটা স্থানে। যেখানে হালকা ভূমি এবং গাছ থাকবে। যে কথা সেই কাজ। আরেকটি সুন্দর স্থানে নৌকা থামানো হলো। আমরা সেখানে দুপুরের খাবার খেলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে আমাদের নৌকা চলতে থাকলো বারেক টিলার দিকে। (চলবে)