বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২২ মে ২০২৪, ০০:০০

মায়েরা হাসলে হাসে বিশ্ব

রহিমা আক্তার মৌ
মায়েরা হাসলে হাসে বিশ্ব

‘মায়েরা হাসলে হাসে বিশ্ব’ মায়ের হাতে রত্নগর্ভা সম্মাননা, এই বিষয়ে লিখতে এসে আমি থমকে যাই। কোন বাক্যটা দিয়ে শুরু করবো সেই দ্বিধায় পড়ি। ১৩ মে ২০২৪ সোমবার রাত আনুমানিক ৮টা ৩০ মিনিটে ধানমন্ডি ২৭-এর ২০নং ভবনের ডব্লিউভিএ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে আমি গাড়িতে উঠি মা-বাবাকে নিয়ে। মায়ের হাতে উনার সম্মাননার ক্রেস্ট। ক্রেস্ট হাতে পাওয়ার পর থেকে মা এক মুহূর্তের জন্যও এটা হাতছাড়া করেননি। গাড়ি চলতে শুরু করলেই মা বলেন,

‘যাক ভালোয় ভালোয় সব শেষ হলো। আজ তুই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস, তুই আমাকে কলেজে (১৯৯১) নিয়ে গেছিস। আমাকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নিয়েছিস, চীন মৈত্রী সম্মেলনে নিয়ে গেছিস। তোরা যখন কলেজে ভর্তি হয়েছিস খুব ইচ্ছা করতো কলেজ কেমন তা দেখার, তুই দেখাইছিস’।

মা বলেন আর আমার চোখ ভারি হয়ে আসে। আমি নিজেকে আড়াল করে হাতের টিস্যু দিয়ে চোখ মুছি। ভাবি মায়েরা কত অল্পতেই খুশি হয়, সত্যিই মায়েরা হাসলে হাসে বিশ্ব। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্ব মা দিবস হিসাবে পালিত হয়। বিগত কয়েক বছর থেকে দেখে আসছি মা দিবসে রত্নগর্ভা মায়েদের সম্মাননা দিয়ে আসছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বছর যায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে। প্রায় বছর দশ আগে আমার মাথায় আসে যদি আমার মা রত্নগর্ভা হিসাবে সম্মাননা পেতো। এর মাঝে দীর্ঘদিন নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত তার সাথে অপেক্ষা আমার একটা জায়গা তৈরি করা। যদিও আমি ছাড়া আমার বাকি তিন ভাইবোন সবাই নিজ নিজ জায়গায় শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত। অল্পবয়সে বিয়ে, আমার তেমন সফলতা ছিলো না বলে মাকে বলতাম, "আপনার চার সন্তানের মাঝে তিনজনই শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু আমি সে পর্যায়ে নেই’।

বাংলার বীর ফাউন্ডেশন ও সিইও বীর ডিজিটাল পয়েন্টের আয়োজনে বাংলার বীর ফাউন্ডেশন মা দিবসে রত্নগর্ভা হিসাবে সম্মাননা দেয়ার ঘোষণা দেয়। সেখানে লেখা থাকে, ‘অন্তত ২ সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মায়েদের দেয়া হবে রত্নগর্ভা সম্মাননা আর অন্তত ১ সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া মায়েদের দেয়া হবে সুপার মম সম্মাননা। আমি রত্নগর্ভা হিসাবে আমার মায়ের জন্য আবেদন করি। কর্তৃপক্ষ আমার মাকে মনোনিত করেন। উক্ত আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসাবে ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট ডিভিশনের মাননীয় বিচারপতি এসএম মজিবুর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবঃ) এম. হারুন অর রশিদ (বীর প্রতীক) সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রদূত। অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান উপাচার্য গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ, সাবেক উপাচার্য, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অধ্যাপক ড. জিনবোধি ভিক্ষু, সাবেক চেয়ারম্যান, পালি বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আলহাজ্ব ড. শাহানারা বেগম, গভর্নমেন্ট প্যানেল অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনাল ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালস্, ঢাকা। সভাপতিত্ব করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব ড. মোঃ আবদুর রহিম, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালস, ঢাকা সদস্য আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশন (আইবিএ), লন্ডন, ইউ.কে। অনুষ্ঠান পরিচালনায় থাকেন মোঃ মাসুদ রানা- প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক বাংলার বীর ফাউন্ডেশন ও সিইও বীর ডিজিটাল পয়েন্ট। বাংলার বীর ফাউন্ডেশন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও মাদক বিরোধী একটি সংগঠন।

প্রোগ্রাম ও সম্মাননার খবরটা দিই মাকে। মা অনেক অনেক খুশি হন। মা প্রকাশ করেন কম কিন্তু মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারি মা কতটা খুশি আছেন। মা আমায় জিজ্ঞেস করেন যে, মঞ্চে উঠে তিনি কি বলবেন? আমি ও বলে দিয়েছি, আপনার যা বলতে ইচ্ছে করে তাই বলবেন। ছোট করে আমাদের ভাইবোনদের পরিচয়- বড় বোন নুরজাহান বেগম নাজমা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স প্রথম শ্রেণীতে পাশ করে বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় আছেন সাভার এসেড স্কুলে। পরপর কয়েকবছর তিনি সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হন। এই বোন দীর্ঘ ২৭ বছর যাবৎ কিডনির সাথে যুদ্ধ করছে। বর্তমানে সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালসিস করছে। পাশাপাশি শিক্ষকতা করে যাচ্ছে। আমি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১ টি। ভাইয়ের মাঝে বড়জন মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান, Occupational Therapy Manager, Government Health Sector in the UK. ছোটভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল, সিএফও, ব্যাংক এশিয়া।

আমার মা সেতারা বেগমসহ অন্য যেসব মায়েরা রত্নগর্ভা ও সুপার মম সম্মাননা পান তারা হলেন : শিক্ষিকা লতিফা পারভীন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা খন্দকার গুল নাহার গোলজারি, ডাঃ রাজিউন সালমা লাবনী, গৃহিণী মনোয়ারা বেগম, চিকিৎসক হোমাইরা সুলতানা, গৃহিণী শাহনাজ রহমান, গৃহিণী দিলরুবা হক, গৃহিণী কামরুন নাহার, গৃহিণী শাহনাজ বেগম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা বেগম নূর-ই ফেরদৌস, শিক্ষিকা নুজহাত নূয়েরী কোরাইশী টুম্পা, গৃহিণী ফিরোজা আক্তার, ড. শাহানারা বেগম, ব্যবসায়ী ঝর্ণা কস্তা, নারী উদ্যোক্তা সাইমা ইসলাম মুক্তা। গৃহিণী মোফিদা হোসেন, স্মার্ট উদ্যোক্তা ফোরামের প্রেসিডেন্ট কামার আফজা লিজা, গৃহিণী জিরা রায়, শিক্ষিকা সেহেলী বিল্লাহ, উদ্যোক্তা শামীমা আক্তার, বনানী রংধনু কচি-কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা আঞ্জুমান আরা রুমা, গৃহিণী শাহনেওয়াজ বেগম চৌধুরী, গৃহিণী মাধুরী বিশ্বাস, গৃহিণী লাভলী দেব রায়, নারী উদ্যোক্তা নাদিরা পারভীন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক ড.নাজমা বেগম নাজু, নারী উদ্যোক্তা নাসরিন আক্তার, ব্যবসায়ী সামসুন নাহার, গৃহিণী মমতাজ বেগম, ব্যবসায়ী মনিরা আক্তার, ডাঃ কবরী চক্রবর্তী, মমতাজ বেগম।

‘মা’ বাংলা বর্ণমালার সবচেয়ে ছোট কিন্তু বিশাল অর্থবোধক শব্দ। সবার কাছে তার মাই সেরা। আমার কাছেও তাই। তবে আমার জীবনের সেরা বন্ধু আমার মা, আমার জীবনের সেরা মানুষ আমার মা, আমার আদর্শ আমার মা। ছোটবেলায় আমি আমাকে নিয়ে তেমন কোন স্বপ্নই দেখিনি। কিন্তু মা চাইতেন আমি পুলিশ হই, আমি ওকালতি পেশায় যাই। তার একটাই কারণ আমি সত্য বলি, মায়ের ধারণা এই দুই পেশার ব্যক্তিদের সত্য বলতে হয়। কিন্তু আমি মায়ের স্বপ্নপূরণ করতে পারিনি। আমার মা কত ধরনের কুঠির শিল্পের কাজ জানেন তার হিসাব নেই। সর্বশেষ মা কাগজের মন্ড দিয়ে চেয়ার, টেবিল, টুল, বাটি ইত্যাদি বানান। ২০১১ সালে মায়ের সেই কাজ নিয়ে আমি পত্রিকায় মায়ের ছবি সহ জিনিসপত্রের ছবি নিয়ে একটা ফিচার করি। পত্রিকায় নিজের কাজ আর ছবি দেখে মা অনেক খুশি হন। এখন আমি লেখালেখি করি এতে মা অনেক খুশি। মা আমার সামনে তেমন কিছু বলেন না, তবে আমার সব বই তিনি পড়েন। পড়ে অনেক খুশি হন। অন্যদেরকে বলেন, ‘আমার মেয়ে লেখালেখি করে, ওর অনেক বই বের হয়েছে’। আমি আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে বই লিখেছি। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে আমার মায়ের জন্য একটা কিছু করবো। আজ মায়ের হাতে একটা সম্মাননা এনে নিতে পেরেছি, মাকে মঞ্চে ডায়াসের সামনে দাঁড় করিয়েছি। হল ভরা অনেক অনেক মায়েদের ও সবার সামনে মা কথা বলেছেন। মায়ের বলার পর মুক্তিযোদ্ধা বাবা মঞ্চে আসেন, মায়ের পাশে দাঁড়ান, কিছু কথা বলেন। আনন্দে আমার চোখ ভারি হয়ে আসে।

পৃথিবীর সব মা নিজের সন্তানের জন্যে অনেক কিছু ত্যাগ করেন। আমার মা জীবনে এমন কিছু ত্যাগ করেছেন এমন ধৈর্য ধরেছেন তা ভাবতেই আমি অবাক হই। মা বাবার বিয়ে হয় ৩ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে। আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান মতিন। মা সেই সময়ে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। মায়ের অনেক ইচ্ছা ছিলো লেখাপড়ার, কিন্তু হয়নি। আজও মা বলেন, ‘আমি যদি মেয়েদের সাথেও পড়তাম, মেয়েদের সাথেই পড়ে যদি এসএসসি পরীক্ষা দিতাম’।

আমাদের সব ভাইবোনের লেখাপড়ার হাতে খড়ি মায়ের কাছেই। আমার বয়স প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই, এখনও যে কোন কাজ করার আগে মায়ের সাথে আলোচনা করি। আমি জানি মা সেই পরামর্শই দিবেন যা আমার জন্য ভালো হবে। তবে এটাও ঠিক জেনারেশন এর কারণে কিছুকিছু ক্ষেত্রে আমাদের মতের ও অমিল হয়ে থাকে। সেই ৯১ সালের কথা, মা কে আমি আমার লালমাটিয়া কলেজে নিয়ে যাই। ঘুরেঘুরে কলেজ দেখাই, ক্যান্টিনে বসে খাওয়াই। ২০১০ সালে প্রথম আলোর গোল্লাছুট থেকে আমার বড় মেয়ে গল্প লিখে পুরস্কার পায়, প্রোগ্রামটি হয় চীনমৈত্রী সম্মেলনে। আমি সেদিন মাকে সাথে নিয়ে যাই। মা প্রায় বলেন, ‘ও আমাকে চীন মৈত্রীতেও নিয়ে গেছে’। আসলে মায়েরা এমনিই, খুব অল্পতেই আকাশ সমান আনন্দ উনাদের। সত্যিই মায়েরা হাসলে হাসে বিশ্ব।

‘মা দিবসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেখানে প্রতি বছরের মে মাসের ২য় রোববার পালিত হয় এটি। এই চিন্তাটা প্রথম আসে ফিলাডেলফিয়ার আনা জারভিসের মাথা থেকে। তিনি ১৯০৭ সালে ১২ মে তার মাকে নিয়ে এক ছোট্ট স্মরণসভার আয়োজন করেন। আনা জারভিসের মা নারীদের একসঙ্গে করে বন্ধুত্ব ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতেন। মায়েদের সন্তান মানুষ করাটা যে অনেক পরিশ্রমের কাজ সেটা সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন তিনি। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্র্যাফটনে আনা জারভিসের মা, আনা রিভস জারভিস মায়েদের একটা ‘ডে ওয়ার্ক ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন যার লক্ষ্য ছিল শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনা। কারণ মিজ জারভিস নিজেও তার নয়টি সন্তান হারিয়েছিলেন। তিনি মারা যান ১৯০৫ সালের ৯ মে। আর তার স্মরণসভার জন্য আনা জারভিস ১২ মে বেছে নেন কারণ ওটাই ছিল তার মা মারা যাবার কাছাকাছি একটা রোববার। তার মা যে চার্চে যেতেন সেখানে তার মার উদ্দেশ্য একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান করেন। এরপরের পাঁচ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সবকয়টি রাজ্যে মা দিবস পালনের চল শুরু হয়। আর ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এ দিনটাকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। এরপর থেকে প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বেশিরভাগ জায়গায় মা দিবস পালন হয়ে আসছে’। (তথ্যসূত্র : ১২ মে ২০২৪, বিবিসি নিউজ)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়