বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

একটি গবেষণার স্মৃতি

সরকার আবদুল মান্নান
একটি গবেষণার স্মৃতি

গবেষণার নাম শুনলে আমরা অনেকে আতকে উঠি। ভাবি, ওরে বাপ রে! গবেষণা কি চাট্টিখানি কথা, যারতার কাজ? যারা এমফিল করে, পিএইচডি করে তাদের জন্য গবেষণা। উচ্চতর ডিগ্রি ও বিশাল কোনো আবিষ্কারের জন্য হলো গবেষণা। এই ধারণা ঠিক নয়। গবেষণা যে এমন কোনো কঠিন ও কালাপহাড়ি বিষয় নয়, তা আমরা অনেকেই জানি না। আর এই গবেষণা যে-কোনো শ্রেণির শিক্ষার্থীরাই যে করতে পারে, এ ধারণাও আমাদের একেবারেই নেই। একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করি।

আজ থেকে ১৩-১৪ বছর আগের কথা। তখন আমি দেশের বিখ্যাত সব স্কুল-কলেজের আমন্ত্রণে ধারাবাহিক মূল্যায়নের উপর শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য যেতাম। এসব স্কুল-কলেজের মধ্যে ক্যাডেট কলেজগুলো ছিল অন্যতম। প্রায় প্রতি শুক্র ও শনিবার কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের বিভিন্ন পথ, পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে হতো আমাকে। কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে যখন শিশুদের গবেষণা নিয়ে কথা বলছিলাম, তখন একজন সহকর্মী বলেছিলেন, “গবেষণা তো বড়দের কাজ এবং উচ্চতর ডিগ্রি লাভের বিষয়। শিশুরা আবার কিসের গবেষণা করবে!” আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, তার ছেলে-মেয়ে আছে কি না এবং থাকলে তারা কোন ক্লাসে পড়ে? জানলাম, তার ছেলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। ওই অধিবেশনে এমন আরও কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন, যাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়ে। আমি শিক্ষকদের ছেলে-মেয়েদের জন্য ছোট একটি গবেষণার কাজ বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।

গবেষণার কাজটি ছিল এরকম : শিক্ষার্থীরা স্কুলে যে ক্লাসেই পড়ুক না কেন, তারা তাদের বাংলা বইয়ের দশটি পাতা নির্বাচন করবে। বলেছিলাম, এই হলো তাদের গবেষণার ক্ষেত্র নির্ধারণ করা। আশা করি সব শিক্ষার্থী এটা করতে পারবে। এরপরে ওই দশটি পাতা তারা পড়বে। এ হলো গবেষণার তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া। দশটি পাতা পড়ে তারা মূর্ধন্য ‘ণ’ যুক্ত শব্দগুলোকে নিচে নিচে লিখবে। অর্থাৎ তাদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হলো। তারপর যেসব শব্দে র-এর পরে মূর্ধন্য আছে সেই শব্দগুলোকে আলাদা করবে। তেমনিভাবে ‘র্ ’ (রেফ), ‘ ্র’ (র-ফলা), ‘ঋ’, ‘ ৃ’, ‘ষ’ ইত্যাদির পরে ‘ণ’ থাকা শব্দগুলোকে আলাদা করবে। তথ্য শ্রেণিকরণের কাজ শেষ হলো। আরও অনেক বিষয় আছে। সেগুলো এখন তাদের না করলেও চলবে। এরপর তারা ছোট একটি প্রতিবেদন রচনা করবে। ওই প্রতিবেদনে তারা তাদের মতো করে লিখবে, কোথায় কোথায় ‘ণ’ হয়েছে। এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে বয়স ও শ্রেণির তারতম্য অনুযায়ী চিন্তারও তারতম্য ঘটবে। তবে শিক্ষকদের অনুরোধ করেছিলাম যে, তারা যেন কোনো অবস্থাতেই সহযোগিতা না করেন। কারণ অনেক গবেষণায় অভিভাবকদের সহযোগিতা করার সুযোগ থাকে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে থাকে না। যে ক্ষেত্রে থাকে সেখানে শিক্ষকগণই শিক্ষার্থীদের বলে দেন যে, অন্যের সহযোগিতা নেওয়া যাবে। প্রতিবেদনের শেষে তারা যে বইটি থেকে লিখেছে, সেই বইয়ের তথ্য দেবে। অর্থাৎ বইয়ের নাম, সম্পাদকের নাম (একাধিক সম্পাদক থাকলে একজনের নাম লিখে ‘ও অন্যান্য’ লিখবে। সবার নাম লেখা দরকার নেই।), বাইটি যে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ও প্রকাশের তারিখ লিখবে। তারপর লিখবে পৃ. (মানে পৃষ্ঠা) --- পৃষ্ঠা থেকে --- পৃষ্ঠা। আরও বলেছিলাম, উপরে একটি সাদা কাগজ সংযুক্ত করবে। সেখানে তাদের নাম, স্কুলের নাম, রোল নম্বর ও তারিখ লিখবে। পাতার এক পৃষ্ঠায় লিখতে হবে। উভয় পৃষ্ঠা ব্যবহার করা যাবে না।

ওই দিন ছিল শুক্রবার। আমি তাদের বলেছিলাম, শনিবারে ওই শিক্ষার্থীরা গবেষণার কাজটি করে এখানে নিয়ে আসবে এবং উপস্থাপন করবে। পরদিন দেখা গেল, ওই শিক্ষার্থীরা খুব যত্নসহকারে কাজটি করে নিয়ে এসেছে। তাদের উপস্থাপনের সময় দেখলাম, আমি যা প্রত্যাশা করেছিলাম, তারা তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে। কোথায় ‘ণ’ হয়েছে সেসব তো তারা লিখেছেই আরও লিখেছে “শব্দের শুরুতে ‘ণ’ হয় না। ‘প্রমাণ’ লিখতে কেন ‘ণ’ হয়েছে তা বুঝতে পারিনি। র-এর পরে ‘ণ’ হয়েছে। কিন্তু ‘করবেন’, ‘করুন’ লিখতে ‘ণ’ হয়নি। কেন হয়নি জানি না। শিক্ষকরা খুবই বিস্মিত হয়েছিলেন। তাদের সন্তানেরা এতটা আনন্দের সঙ্গে এবং এতটা যত্নের সঙ্গে কাজটি করেছে, যা তারা ভাবতেও পারেননি। আমি বলেছিলাম, “এই হলো গবেষণা”। এখন আপনারাই বলুন, মুখস্থ করে ণ-ত্ব বিধান শেখা ভালো, নাকি এই পদ্ধতি ভালো? অনেকেই তখন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, মুখস্থ করে শেখার যে যন্ত্রণা তা থেকে এই পদ্ধতি আনন্দদায়ক, সহজ ও স্থায়ী।

তারপর সকল শিক্ষককে তাদের পড়ানোর বিষয়ের উপর একটি তালিকা প্রস্তুত করতে বলেছিলাম, যেখানে শিক্ষার্থীদের এই ধরনে ছোটখাটো গবেষণার কাজ দেওয়া যায়।

শিক্ষকগণ আমাকে ওই তালিকা প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। আমিও বিস্মিত হয়েছিলাম। এত বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাজ দেওয়া যায়, তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। এই কাজগুলো অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে, স্বতঃস্ফূর্ত ও ক্লান্তিহীনভাবে শিক্ষার্থীরা করতে পারে এবং তাদের ভাবনার জগৎ খুব সক্রিয় থাকে। আর তাদের ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিংয়ের জগৎ অনেক বেড়ে যায়। এভাবে অর্জিত জ্ঞান মুখস্থ করার মতো ঠুনকো ও অস্থায়ী হয় না। বর্তমানে যে শিখন-শেখানো কার্যক্রম প্রবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে এভাবে শেখানোর সুযোগ রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়