মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষা

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষা

দিনে দিনে বাংলা ভাষার ব্যবহার, পরিধি এবং প্রচার সম্প্রসারণ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বর্তমানে বিশ্বের সেরা ১০-১১টি ভাষার মধ্যে বাংলা অন্যতম। এথনোলগের বিংশ সংস্করণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ছয় হাজার থেকে আট হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান এখন বিশ্বে পঞ্চম। জনসংখ্যার বিবেচনায় এবং ব্যবহারের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্য প্রধান ভাষাগুলো হলো- মান্দারিন (চীনা), ইংরেজি, হিন্দি, স্প্যানিশ, রুশ, আরবি, বাংলা, পর্তুগিজ, মালয়-ইন্দোনেশিয়ান ও ফরাসি। বাংলা ভাষায় এখন বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলে। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে ৩১ কোটি ৬০ লাখে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা ও আসামের কাছার জেলায় বিপুলসংখ্যক বাংলাভাষী মানুষ বসবাস করে। ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ ও কাছার জেলার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষা বাংলা। মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশে অসংখ্য বাংলাভাষী বসবাসকারী আছে, যারা নিজ উদ্যোগে বাংলা ভাষা চর্চা, গবেষণা ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বের প্রায় শতাধিক বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার গবেষণা ও চর্চা আছে। এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ও কানাডা থেকে বাংলা ভাষায় বর্তমানে একাধিক সংবাদপত্র প্রকাশ হচ্ছে। বেতার ও টিভিতে বাংলা ভাষায় নিয়মিত অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে। আন্তঃআন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষা সম্প্রসারণের অন্যতম কারণ হচ্ছে বাংলাকে ইন্টারনেট ও প্রযুক্তিমুখী করা। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেম (আইডিএন)’ বাংলাদেশকে ডটবাংলা ডোমেইন ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার ফলেই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বাংলা ভাষার এই অগ্রযাত্রা।

বিশ্বের অন্য ভাষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো ‘ডিজিটাল ডায়েরি’ আর ‘সিটিজেন জার্নালিজম’ ধারণাকে আঁকড়ে রাখলেও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তা ব্লগ, জার্নালিজম, বই, উপন্যাস ও সাহিত্যচর্চার উৎকর্ষ সাধনে বহুমাত্রিক বৈচিত্র্য নিয়ে বিকশিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি একাডেমিক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলা ভাষায় বৃহত্তম ব্লগিং সাইট সামহোয়্যারইন ব্লগের ৩৬ শতাংশ লেখাই ছিল সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম। মাত্র দেড় দশক আগে ইন্টারনেটে ব্যক্তিগত ডায়েরি লেখার ধারণা থেকে ব্লগের সূচনা হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই আজ এটি একটি বহুমাত্রিক ডিজিটাল মিডিয়া হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মত, পথ, পেশা, বয়স, সমাজ আর ভাষাভাষী মানুষকে একটা কমন প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসার কৃতিত্ব এই ব্লগ মিডিয়ার। বিপরীতে বলা যায় প্রযুক্তির কল্যাণে যেহেতু সবই অনলাইনে পাওয়া যায়, তাই প্রিন্টিং জগতে বাংলা প্রকাশনায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই মুদ্রণ শিল্পের অনেকেই এখন অন্য পেশায় নিযুক্ত। এক্ষেত্রে তাই সাহিত্যচর্চায় ডিজিটাল যন্ত্রপাতিসহ প্রযুক্তিগত সুবিধা আরও সহজলভ্য করা দরকার। যেহেতু এখন আর কেউ বই পড়তে চায় না, তাই হাঁটতে-চলতেও যাতে শুনতে পারে এমন ডিজিটাল কনটেন্ট বা অডিও বই বেশি করে প্রকাশ করা উচিত। অনলাইন লাইব্রেরির ধারণা এবং সুবিধা বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ ঘরে বসেই যে কোনো তথ্য বা বই অনায়াসে এক্সেস করতে পারে।

সম্প্রতি ‘বানান আন্দোলন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলা শব্দের সুবৃহৎ ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার সবার জন্য উন্মুক্ত করেছে। গুগল প্লে স্টোরে রাখা অ্যাপটি বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। অ্যাপটিতে প্রায় ১ লাখ বাংলা শব্দ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রতিটি শব্দ সম্পর্কে ৭টি করে তথ্য আছে। প্রতিটি শব্দের শুদ্ধ বানান, অর্থ, উচ্চারণ, ব্যুৎপত্তি, পদণ্ডপরিচয়, ভাষা-উৎস ও পরিভাষাসহ প্রায় ৭ লাখ তথ্যবিশিষ্ট এটি একটি সমৃদ্ধ ডিজিটাল তথ্যভান্ডার। যে কেউ বিশেষ করে বিদেশে বড় হওয়া বাঙালিরা এই প্ল্যাটফর্ম থেকে অনায়াসেই শুদ্ধ বাংলা শিখতে পারেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, আজকের প্রজন্ম বাংলা লেখায় যেমন ভুল করে, তেমনি বলতে গেলেও উচ্চারণ সঠিক করতে পারে না। বাংলা-ইংরেজির মাঝামাঝি অর্থাৎ বাংলিশ উচ্চারণের একটি অদ্ভুত সংস্কৃতি ধারা চালু করেছে, যা শুদ্ধ বাংলার ধারেকাছেও নেই। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় বিদেশী সংস্কৃতির আধিপত্যের কারণে এবং বাংলা চর্চার অনভ্যাসের কারণে বাংলা বানান ও শব্দের সঠিক ব্যবহারে তারা এত উদাসীন। সে জায়গাটিতে ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডারের এই প্রচেষ্টা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। পৃথিবীব্যাপী বাংলা ভাষার শুদ্ধাচার ছড়িয়ে দিতে এবং বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ তৈরিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের কাজ আরও বেশি হওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রযুক্তিবিদ ও ভাষা বিশেষজ্ঞরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ করার নিমিত্তে কাজ করছে একসঙ্গে।

ইতোমধ্যে তাদের প্রচেষ্টায় বাজারে এসেছে ডিজিটাল ডিকশনারি, যা ইংরেজি থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংরেজিতে অর্থ প্রকাশ করে দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম। সঙ্গে রয়েছে বানান মুখস্থ করার সুবিধা এবং উদাহরণ দেখার ব্যবস্থা। রয়েছে প্রতিটি শব্দের সমার্থক শব্দ এবং বিপরীত শব্দের তালিকা। বাংলা শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ, উচ্চারণ, বানান এবং উদাহরণও আছে এখানে। আছে প্রতিটি শব্দের সমার্থক শব্দ এবং বিপরীত শব্দের তালিকা। বিভিন্ন বিষয়ে হাজার হাজার ইংরেজি কথোপকথন ছাড়াও রয়েছে ব্রিটানিকা কনসাইজ এনসাইক্লোপিডিয়া এবং অ্যাডভান্সড লার্নার্স ইংলিশ ডিকশনারি। এতে ইংরেজি ব্যাকরণের সব শাখা সম্বন্ধে উদাহরণসহ বিস্তারিত বর্ণনা আছে। গান উপভোগের জন্য রয়েছে এমপিথ্রি। এমনিভাবে প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের কল্যাণে বাংলা ভাষা প্রচারে যেমন সমৃদ্ধি এসেছে, তেমনি এই ভাষায় লেখালেখি করার জন্য তৈরি হয়েছে হাজার হাজার বাংলা ফন্ট। ব্লগ, পত্রিকা, লিফলেট-ব্যানার ও পোস্টারে দেখা যায় বাংলা ফন্টের সৌন্দর্য ও কারুকার্য। বহুল ব্যবহৃত এরকম কতক ফন্ট হলো- সুতনী, সোলায়মান লিপি, অভ্র, নির্মালা, কালপুরুষ, মুক্তি বাংলা, সোনার বাংলা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী ইত্যাদি। বাংলাদেশে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলা ফন্টের এই বিপ্লব শুরু হয়েছে বিজয় সফটওয়ারের স্বত্বাধিকারী মোস্তাফা জব্বারের হাত ধরে। তাই তাকে কম্পিউটারের বাংলা ফন্টের জনক বলে অভিহিত করা হয়। তার আবিষ্কৃত কম্পিউটারের বাংলা কি বোর্ড হলো বিজয়। আর বিজয় কীবোর্ড হলো মাইক্রোসফট উইন্ডোজ, ম্যাক ওএস এবং লিনাক্স এ গ্রাফিক্যাল লে আউট পরিবর্তক এবং ইউনিকোড ও এএনএসআই সমর্থিত বাংলা লেখার সফটওয়্যার।

সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, আইসিটি ডিভিশন বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাংলা ভাষা- প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট গবেষণা ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে কার্যক্রমে নিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তরুণ গবেষক ও ডেভেলপারদের উৎসাহিত করার জন্য নিয়মিতভাবে আয়োজন করছে ‘বাংলার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ প্রতিযোগিতা। এদিকে বাংলা ভাষা প্রযুক্তিকে বিশ্বমানের করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ (ইবিএলআইসিটি) প্রকল্প নিয়েছে নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের নানা সফটওয়্যার/টুলস উদ্বোধন হয়েছে। এগুলো হলো- বাংলা কার্পাস, বাংলা ওসিআর, বাংলা স্পিচ টু টেক্সট, টেক্সট টু স্পিচ, জাতীয় বাংলা কি বোর্ড, বাংলা স্টাইল গাইড, বাংলা ফন্ট, বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর ইত্যাদি।

অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ ইবিএলআইসিটি প্রকল্পের স্টলে ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন সফটওয়্যার হাতেকলমে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এখানে বাংলা ভাষার জন্য তৈরিকৃত অনেক সফটওয়্যারের প্রদর্শনী চলছে। অনলাইন যোগাযোগের দুনিয়ায় স্পষ্ট ও সঠিকভাবে লেখাটা খুব জরুরি, তা সে মেল, ব্লগ পোস্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আপডেট- যাই হোক না কেন। লিখিত বার্তাটা হতে হবে সংক্ষিপ্ত, মিথস্ক্রিয়ামূলক এবং নির্ভুল। এই কাজকে সহজ করতে বাজারে এসেছে মেশিন লার্নিং এবং মোবাইল ফোনভিত্তিক ভুল বাংলা ঠিক করার অ্যাপ ‘সঠিক’। আছে এআইভিত্তিক বাংলা সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস সফটওয়্যার ‘জনমত’, বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বাংলা শব্দ ভাঙা রোধ করতে প্ল্যাটফর্ম ‘রূপান্তর’। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাসহ সকল ভাষা লেখার স্মার্ট ইউনিভার্সাল কি বোর্ড ‘ইউবোর্ড’। প্রযুক্তির দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলা ভাষাও আর পিছিয়ে থাকছে না। মাথা উঁচু করে বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠিত হবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়