সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৬ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২২, ০০:০০

প্রবাসীদের ভোগান্তি
অনলাইন ডেস্ক

পরিবারের ভরণপোষণ মিটাতে ও দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান অভাবে নিজেদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তনের লক্ষ্য প্রতি বছর বহু বাংলাদেশী বিদেশ গমন করে থাকেন। সেখানে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে পরিবারের চাহিদা পূরণের ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল রাখেন। অর্থনৈতিক অনবদ্য অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের বিদেশ যেতে এবং ফিরতে পুরো প্রক্রিয়ায় দুর্ভোগ আর অবহেলার যেনো শেষ নেই। শুরুতেই পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ফর্ম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অন্তহীন হয়রানির শিকার হন সাধারণ প্রবাসগামীরা। অথচ সাধারণ পাসপোর্ট প্রক্রিয়ার বিপরীত দেখা যায় ভিন্ন চিত্র, পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের নিজস্ব দালাল বা স্থানীয় সিন্ডিকেটের হাতে ঘুষের টাকা তুলে দিলেই ত্বড়িত গতিতে হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান। বিদেশে গমনের পূর্বে মেডিক্যাল চেকআপ করতে এবং জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র পেতে গিয়েও প্রবাসীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।

দীর্ঘ বিড়ম্বনার পর ভিসা পেয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করে কাস্টমস্, ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে দালাল ও প্রতারক চক্রের হাতে পদে পদে হয়রানির চিত্র, কখনো স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসীদের তুচ্ছ ভুল বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাথে না থাকাকে কেন্দ্র করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। প্রবাসীদের বন্ধুসুলভ ব্যবহার্য সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে অশোভনীয় আচরণ, গায়ে হাত তোলার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দৈনিক মানবজমিনের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিমানবন্দরে প্রায় ১২ ধাপে হয়রানির শিকার হন প্রবাসগামী যাত্রীরা। বিমানবন্দরে যাত্রীসেবায় নিয়োজিত কাস্টমস্, ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা, বিমানবন্দর পুলিশ ও বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে যাত্রী হয়রানির অভিযোগ প্রতিদিন জাতীয় দৈনিক ও মিডিয়ায় প্রচার করা হলেও এর কোনো প্রতিকার মিলছে না, এমনকি প্রধানমন্ত্রী দফতর থেকে যাত্রী হয়রানির বন্ধে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তা কোনোভাবেই যেনো বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বিমানবন্দরের পরিস্থিতি এমন থাকে যে, প্রায় ফ্লাইট শিডিউল বিপর্যয়, অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ, করোনা টেস্টের জন্যে দীর্ঘ লাইন, যাত্রীদের স্ক্যানিং করার পরও কাস্টমস্ ও ইমিগ্রেশনে আলাদাভাবে তল্লাশি, মালামাল পেতে বিড়ম্বনা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের ফলে মশার উপদ্রব ও দুর্গন্ধ, দালালের উৎপাতসহ সবখানে প্রবাসীদের হয়রানি যেন নাভিশ্বাস হয়ে উঠার মতো অবস্থা। প্রবাসীখাত সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, বিমানবন্দরে নি- িদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও যাত্রীরা কেনো হয়রানি শিকার হন, বারবার কেনো মালামাল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং কিভাবে অবৈধভাবে চোরাচালান কারবার হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ছেদ করে, তা কারোই বোধগম্য হচ্ছে না। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসেও নিরাপদ যাত্রীসেবামূলক বিমানবন্দর ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি তা অবশ্যই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও সরকারি ব্যর্থতার সামিল হিসেবে অভিযুক্ত করছেন কূটনীতিক বিশ্লেষকেরা। অনেক বিশ্লেষক বিদেশি ট্যুরিস্ট না আসার পিছনে বিমানবন্দরের যত্রতত্র অব্যস্থাপনা ও অনুন্নত কার্যক্রমকেও দায়ী করেন। যদিও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ অব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তার বার্তার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেন। দেশ থেকে যাওয়া স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী যাত্রীদের নানা প্রশ্ন করে তাদের আটকে রাখাটা এখানে অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠে ইমিগ্রেশন পুলিশের দক্ষতা নিয়েও। লাগেজে দামি মালামাল থাকলে তো কথাই নেই। যাত্রীর মালামাল স্ক্যানিংয়ের নামে গ্রিন চ্যানেল অতিক্রম করতে অযথাই দেরি করানো হয়। এতে বিরক্ত হয়ে যাত্রীরা অনেক সময় টাকার বিনিময়ে মালামাল স্ক্যানিং ছাড়াই বেরিয়ে আসেন। অথচ বর্হিঃবিশ্বের প্রতিটি বিমানবন্দরে সুন্দর আপ্যায়নসুলভ ব্যবহার ও স্যার সম্বোধন করে যাত্রী সেবা নিশ্চিত করা হয়।

বিদেশে গিয়েও হয়রানি যেনো প্রবাসীদের পিছু ছাড়ে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের যথাযথ সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে বাংলাদেশী দূতাবাসগুলো। বিশেষ করে বিদেশে শ্রম উইংগুলো। দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, পাসপোর্ট করতে অতিরিক্ত টাকা দাবি, অসহযোগীমূলক মনোভাবের কারণে শত সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও প্রবাসীরা দূতাবাসমুখী হতে চান না। প্রবাসীদের অভিযোগ, নতুন শ্রমবাজার তৈরি, করোনার দুর্দিনে যথাযথ দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং পুরো বছরজুড়ে আপদে-বিপদে বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কূটনৈতিক মিশনগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কঠোর নীতি অবলম্বন না করায় দূতাবাসের কর্মকর্তারা প্রবাসীদের সমস্যা গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করেন না। আইএলও’র ‘দ্য হোমকামিং : প্রফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে দূতাবাসগুলোর অসহযোগী কর্মকাণ্ডের ফলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশই কোনো সমস্যায় পড়লে স্থানীয় দূতাবাসের সহায়তা নেন না। প্রবাসীখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের ২৫টি দেশে বাংলাদেশের ২৯টি শ্রম উইং রয়েছে। তবে এসব শ্রম উইংয়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় বাংলাদেশিরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না। পাশাপাশি কিছু অসাধু কর্মকর্তা প্রবাসীদের নানাভাবে ভোগান্তিতে ফেলেন।

প্রবাসীদের সর্বশান্ত করার আরেকটি নাম হলো দালাল চক্র। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক ভিসায় বিদেশে যেতে মোটা দাগে মাথাপিছু খরচ হয় ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। বড় অঙ্কের এই ব্যয়ের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ যায় মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের পকেটে। এইসব দালাল চক্রের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে অবৈধ অভিবাসন। এই দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের নির্দিষ্ট কাঠামো ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে নানা সময় নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিছু বেসরকারি উন্নয়নমূলক সংস্থাও কাজ করছে। কিন্তু অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। এখনো প্রতারিত হচ্ছে শ্রমিক। অবৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করা যায়নি। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, মধ্যস্বত্বভোগী প্রতারণার শিকার ৫১ শতাংশের মধ্যে ১৯ শতাংশ মানুষ টাকা দেয়ার পরও বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি ৩২ শতাংশ প্রতারণার শিকার হয়েছে বিদেশে যাওয়ার পর।

প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে বর্তমান সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে যা প্রশংসনীয়। এই ঋণ প্রক্রিয়া সহজ ও ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সরকারি বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ করলে তা শতকরা ২.৫% লাভাংশ পাওয়া যায়। এই লাভাংশের পরিমাণ বৃদ্ধি করে শতকরা ৮-১০% করা প্রয়োজন। এতে দেশে অবৈধ পথে অর্থ লেনদেন কমে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

প্রবাসীরা পরিবার থেকে দূরে করে হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত থাকায় তাদের মৃত্যুর পরিমাণও বেড়েছে অনেক। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর এই বিষয়গুলোতে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। প্রবাসে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের লাশ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা সমন্বিত খরচে দেশে আনার ব্যবস্থা করা প্রবাসীদের অনবদ্য অর্থনৈতিক অবদানের দাবি। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণের উপর ভিত্তি করে তাদের জন্য এককালীন পেনশন স্কিম ও ইন্স্যুরেন্সের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এতে বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ যেমন বাড়বে তেমন প্রবাসজীবন শেষে পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে থাকার সম্ভাবনাও থাকবে না।

তবে বিদেশগমনের পূর্বে শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে পাঠানোর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাতে তারা বিদেশ গিয়ে বেকার বা অদক্ষতার কারণে দেশে ফিরে না আসতে হয়। অনেকক্ষেত্রে ভাষাগত দক্ষতার অভাবে ভালোভাবে কমিশন করতে না পারায় বহু বাংলাদেশি যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ভালো কোনো চাকুরি পান না। বাংলাদেশ সরকার যত বেশি দক্ষ শ্রমিক প্রেরণ করবে ততো বেশি রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।

বিদেশগামী শ্রমিকরা কোন্ দেশে কিভাবে যাবে, কি ধরনের কাগজপত্র ও কোন্ ধরনের দক্ষতা থাকা প্রয়োজন, তার জন্য করণীয় কী তা সরকারি বা বেসরকারি বিশ্বস্ত সংস্থার ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে জানিয়ে ও লিখিত নোট দিলে প্রবাসগামীরা হয়রানি ও প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রগতির এই সময়ে বাংলাদেশের শ্রম বাজারকে ঠিক রাখতে ও নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে কিছু গবেষণা ইউনিট প্রয়োজন। যারা বৈশ্বিক শ্রমবাজার পর্যবেক্ষণ করে সরকারকে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে পরামর্শ দিবে। যাতে সেই বিষয়গুলো সামনে রেখে চাহিদানুযায়ী লোকবল প্রস্তুত করতে পারে। প্রবাসীদের যেকোনো সমস্যার সমাধানে প্রবাসী কল সেন্টারের কার্যকারিতা আরো বৃদ্ধি করা দরকার।

সেই সত্তরের দশক থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৬২টি দেশে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ কোটি শ্রমিক গেছেন। শ্রমিকদের পাঠানো অর্থে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি বেঁচে আছে তাদের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ পরিবার। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির যে খাতগুলোর অবদান অন্যতম তার মধ্যে প্রধান একটি হচ্ছে, প্রবাসী আয়। কাঁচামাল আমদানির খরচ বাদ দিলে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে তিন গুণ বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই শ্রমিকদের অভিবাসন প্রক্রিয়াকে এখনো নিরাপদ করা যায়নি। অবসান হয়নি তাদের দুর্ভোগ ও বঞ্চনার।

মোঃ মুরাদ হোসেন : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়