প্রকাশ : ০৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
আমার দিন চলে যায় দিনের সনে
ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে ‘মাদ্রাসা শিক্ষার অন্তরালে’। একটি দুটি নয়, একাধারে ১১টি পর্ব! পত্রিকাটি সাপ্তাহিক এবং পত্রিকার নাম চাঁদপুর কণ্ঠ। তখনকার বিষয় বর্তমান সময়ের মতো ছিলো না। নিউজপ্রিন্টে সংবাদ লিখে জমা দেয়া লাগতো। সম্পাদক যদি মনে করতেন এটা যাবে তখন তিনি সেটা কম্পিউটার অপারেটরের কাছে পাঠাতেন। কয়েক দফা প্রুফ দেখার পর তা চূড়ান্ত হয়ে প্রেসে যেতো।
মাদ্রাসা শিক্ষার অন্তরালে লেখাটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট। মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে তোলপাড় চলছে। বেশ ক’জন শিক্ষকের অপকর্ম আর দুর্নীতি প্রকাশ হয়েছে। তাতেই টনক নড়েছে সবার।
এই সেক্টরের লোকজন খোঁজ করছে কে এই সাংবাদিক। আমি নাম দিচ্ছি না। নিজস্ব প্রতিনিধি হিসেবে লেখা যাচ্ছে। যেহেতু সেনসেটিভ সেহেতু আমি লেখা দেই গোপনে সম্পাদকের কাছে।
একদিন আমি বসে আছি। তখন চাঁদপুর কণ্ঠের অফিস হকার্স মার্কেটে। বেশ ক’জন তাগড়া জোয়ান এসে এই রিপোর্টারের খোঁজ করছে। তাদের ভাবখানা এমন, পেলে এখনই চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। সম্পাদক কোনোমতেই নাম বললেন না।
কালাম স্যার ছিলেন বিষ্ণুদী মাদ্রাসার শিক্ষক। আমার পরিচিত। তিনি খুব অনুরোধ করলেন, রিপোর্টার কে যেনো জানাই। কারণ এই রিপোর্টারের কারণে তার চাকুরি চলে যাচ্ছে। আমি নিরীহদের মতো ভান ধরে থাকি।
এই দৃঢ়চেতা সম্পাদকের নাম কাজী শাহাদাত। এগারোটা পর্ব চললেও অনেকে অনেক চেষ্টা করে নাম জানতে পারেননি। সম্ভবত আজ আমিই তা প্রকাশ করলাম।
চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার যাত্রা শুরু এর আঁতুড়ঘর থেকেই। অর্থাৎ নাম নির্বাচন, লোগো নির্বাচন সময় থেকে। আমি খেলাঘর করতাম। সে সুবাদে মির্জা জাকির ভাই আমার সিনিয়র সংগঠক। তাঁর সাথে বিভিন্ন জায়গায় যাই। তিনিই একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন অ্যাডভোকেট ইকবাল ভাইয়ের চেম্বারে। তখন জজকোর্ট ছিলো বর্তমান সদর হাসপাতালের জায়গায়। উল্টো দিকে মসজিদের পাশেই ছিলো ইকবাল ভাইয়ের চেম্বার।
সেই শুরু। পত্রিকা যখন অনুমোদন পেলো, তখন সংবাদ দিয়ে যাই। কিন্তু ভয় পেতাম কাজী শাহাদাত ভাইকে (পরে তিনি অবশ্য আংকেল হন তাঁর পরিবারের সদস্যের সাথে আমার পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে)।
প্রথম যেদিন আমার নামে (বাইলাইন স্টোরি) সংবাদ প্রকাশ হয়, সেদিন যেন পুরো আকাশ আমার হাতের মুঠোয়। এখনও স্পষ্ট মনে আছে হেডলাইন ছিল ‘ত্রি-চক্রে চলে জাটকা বাণিজ্য’। আট কলামে হেডিং। সেদিন মাস্ট হেড থেকে এটাই বেশি জ্বলজ্বল করছিলো আমার চোখে।
তখন শাহাদাত ভাই আমাকে ডাকলেন। একটি কথা পরিষ্কার মনে আছে, আমি সাধারণত মানুষের সামনে প্রশংসা করি না, তোমার লেখাটি চমৎকার হয়েছে। দেখো প্রশংসায় আবার নষ্ট হয়ে যেও না’। এটা ছিলো আমার জন্যে ট্যাগ লাইন। আমি যতো পরিণত হয়েছি ততো বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করেছি।
শুধু ভয় দিতেন সে রকম না। শেখাতেন দারুণভাবে। পত্রিকা যখন দৈনিক হলো, আমাদের নিয়মিত ক্লাস নিতেন। বর্তমানে দৈনিক যুগান্তরের মহিউদ্দিন সরকার, প্রথম আলোর আলম পলাশ ভাই, ইল্শেপাড়ের সুমন ভাই, বন্ধু কাউসার আমরা ছিলাম শিক্ষার্থী। বানানজ্ঞান থেকে শুরু করে শিরোনাম, ইন্ট্রো- এসব আমরা হাতে-কলমে শিখেছি।
মির্জা জাকির ভাই তখন ব্রুনাই। আমার পদোন্নতি হয়ে ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক হলাম। গিয়াস উদ্দিন মিলন ভাই, রোকনুজ্জামান রোকন ভাই, বিএম হান্নান ভাই, শাহাদাত হোসেন শান্ত, নাজমুস শাহরিয়ার মিরণ (ভালো ছবি আঁকতো)সহ আমাদের একটা প্রাণবন্ত অফিস ছিলো। বিদ্যুৎ চলে গেলে আমরা কোরাশ গাইতাম। সন্ধ্যায় চলতো মুড়ি-চানাচুরের কমন নাস্তা।
একদিন শাহাদাত ভাই আমাকে ডেকে বললেন, শিশুদের জন্যে একটা পাতা বের করতে চাই। তুমি কি পারবা বাড়তি সময় দিতে? আমি একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। নিজের ডেস্কে এসে একটি ঘোষণা লিখলাম। শাহাদাত ভাই একটি বর্ণও কাটেননি এবং এতোটা খুশি হয়েছিলেন যে, সেই ঘোষণা প্রথম পাতায় বক্স করে ছেপে দিলেন।
এরপর বিরাট ইতিহাস হয়ে গেলো। প্রতিদিন প্রায় বস্তায় করে পোস্ট অফিস থেকে চিঠি আসতো। পাতাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেলো। চাঁদপুর কন্ঠের ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদকের চেয়ে শিশুকণ্ঠের বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে নাম বেশি ছড়িয়ে পড়লো। দলে দলে শিশুরা আসতো তাদের ভাইয়াকে দেখার জন্যে।
একবার এক মজার ঘটনা ঘটলো। শাহাদাত ভাই ঢাকা যাবেন। আমাকে তাঁর রুমে থাকতে হবে। রোজার মাস ছিলো। সেহেরির সময় ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার শার্ট-প্যান্ট কিছুই নেই। পকেটে টাকা ছিলো। নিরূপায় হয়ে গেলাম। এই রাতেই হাবিব চেয়ারম্যানের বিল্ডিং থেকে গুয়াখোলার ভেতরে সুমন ভাইদের বাসায় গেলাম। শরীরে টাওয়াল পেছানো।
সুমন ভাই তার লুঙ্গি দিলেন। একটা শার্ট দিলেন। সেহেরি খেলাম সুমন ভাইদের বাসায়। এরপর সুমন ভাইসহ এসে দেখি জানালার বাইরে আমার শার্ট-প্যান্ট-মানিব্যাগ সবই আছে। শুধু পকেটে ৫ হাজার টাকার মত ছিল সেটা নেই।
লেডী প্রতিমা স্কুলে ফরম ফিলাপে বেশি টাকা নিচ্ছিলো। সেটা নিয়ে সংবাদ করলাম। জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি করলো। এডিএম ছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। আমাকে অফিসিয়াল চিঠি দিয়ে ডাকলেন। আমি ভালোই ভয় পেলাম। কারণ চিঠির ভাষায় হুমকি ছিলো। এ রকম লেখা ছিলো ‘তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত না হলে আপনার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে’।
আমি ভয়ে ভয়ে গেলাম। তখন বর্তমান সদর হাসপাতালের স্থলে ডিসি অফিস ছিল। এডিএমের আসার জন্যে অপেক্ষা করছি। অফিসের লোকজন বলছে, স্যার খুব কড়া। বলবেন, আপনি ভুলে নিউজ করেছেন, ক্ষমা চাইবেন। না হয় সাজা দিবে।
আমি তাদের বললাম, আমার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। আমি ভুল করে নিউজ করিনি। আমার দৃঢ়তায় বেঞ্চ সহকারী কী বুঝলো কে জানে! তিনি খাস কামরায় গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললেন, আপনাকে স্যার চলে যেতে বলেছে। প্রয়োজন হলে আবার ডাকবেন। তখন জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটগণ কোর্ট পরিচালনা করতেন। এডিএমগণ এখনো কোর্ট পরিচালনা করেন।
একবার ইউএনওর কাছে গেলাম। তখন সদর উপজেলার ইউএনও ছিলেন মিকাইল শিপার। পরে তিনি সচিব হয়েছিলেন। আমি পরিচয় দিয়ে কিছু জটিল প্রশ্ন করেছি। ভদ্রলোক বিব্রত হলেন। তিনি চাঁদপুর কণ্ঠে ফোন দিয়ে আমার পরিচয় নিশ্চিত হলেন (তখন মোবাইল ছিল না)। এরপর ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
এ রকম হাজারো স্মৃতি চাঁদপুর কণ্ঠকে ঘিরে। জীবনের বাঁক পরিবর্তনে অনেক বড়ো নিউজরুমে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। দেশি-বিদেশি মানুষের সাথে কাজ করেছি। তবে আমার কাছে এখনো চাঁদপুর কণ্ঠের নিউজরুম সেরা। তাই তো গুণগুণিয়ে বলি, আমার এইদিন চলে যায় সেদিনের পাশে।
লেখক : সম্পাদক, স্বদেশ বাংলা; সাবেক ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ; সাবেক বিভাগীয় সম্পাদক, শিশুকণ্ঠ (চাঁদপুর কণ্ঠের সাপ্তাহিক প্রকাশনা)।