প্রকাশ : ০৫ জুন ২০২৪, ০০:০০
আমি তাঁদেরই স্বজন ছিলাম
সালটি ছিলো ১৯৯৫। আমি তখন হাজীগঞ্জে। রামপুর স্কুলের কাছে আমার একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। নাম ছিলো ‘মায়াবী জেনারেল স্টোর’। সেখানে মাঝে মাঝে হাজীগঞ্জের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা দিয়ে যেতো ‘সোহেল’ নামের একজন। সে ওই পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলো। একদিন ওই পত্রিকাটি পড়তে গিয়ে দেখলাম সেখানে কবিতাও প্রকাশ হচ্ছে। সোহেলকে বললাম, সোহেল এই পত্রিকায় কবিতা দিতে চাই। সোহেল আমার স্নেহভাজন ছিলো। সে আমার ক'টি কবিতা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করে। একদিন একটি কবিতা ‘গলাকাটা’ হবার পর ওই পত্রিকায় আমি আর লেখা পাঠাইনি।
আমি মূলত ছোটকাল থেকেই লিখতাম। এর অনুপ্রেরণায় ছিলেন আমার বোন। তিনি উপন্যাস পড়তেন, লিখতেন ডায়েরিতে, দেয়ালিকায়। আমার লেখালেখিটা সেখানে থেকেই। যা-ই হোক, লিখে লিখে খাতার পাতা ভরে রাখতাম। কিন্তু লেখাগুলো কোথায় কীভাবে প্রকাশ করবো তা’ জানা ছিলো না।
অদৃষ্টের লিখনিতে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেছি। সেখানে ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। কুয়েত থেকে ২০০১ সালে আসার পর চাঁদপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করলাম। এ সময়ও লিখতাম। কিন্তু প্রকাশ করার মাধ্যম পাচ্ছিলাম না। একদিন তখনকার আমার এক পরিচিত ‘মানিক দাস’ আমার লেখা কবিতা স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশ করে পত্রিকাটা আমার কাছে দেন। এরপর ওই দৈনিকে অনেক লেখা প্রকাশ হয়। অন্যান্য স্থানীয় দৈনিকেও প্রকাশ হয়। কিন্তু আমার মনটা ভরে না। কেনো জানি বুকের ভেতর অপূর্ণতা রয়েই যায়।
মাঝে মাঝে চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমিতে যেতাম। গুণীজনদের মাঝে আমি এক সাধারণ ‘অজ্ঞান’ কবিতার আসরে মিলিত হতাম। এ সময় দুজন নক্ষত্র আমার ব্রেনের নিউরনে আলোড়ন তোলেন। এর মধ্যে একজন জনাব কাজী শাহাদাত সাহেব, অন্যজন জনাব আলকামা সিদ্দিকী সাহেব। আমি ওনাদের আচরণে, সাহিত্যপ্রিয়তায় মুগ্ধ হই। জনাব কাজী শাহাদাত সে সময় প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য একাডেমীতে সাহিত্য আসরে উপস্থিত হতেন, সাহিত্যপ্রেমীদেরকে সময় দিতেন। সেখান থেকেই পরিচয়--ব্যক্তিত্ব আর মুগ্ধতার। আর আলকামা সিদ্দিকীর কবিতা আমাকে বেশ মুগ্ধ করতো।
একদিন আমার প্রতিষ্ঠানে হঠাৎ করেই একজন নক্ষত্রের আবির্ভাব হয়। এটা ছিলো আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার একটা সন্ধিক্ষণ, যা পরবর্তী জীবনে উপলব্ধি করতে পেরেছি। মনে মনে চাইতাম দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্য পাতায় আমার লেখাগুলো প্রকাশ হোক। কিন্তু দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে লেখা দেওয়ার মতো মাধ্যম আমি পেতাম না। সাহস করে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সে সময়ের গুয়াখোলা রোডের মোড়ের অফিসে যেতে বেশ একটা ভয়-দ্বিধা অনুভব করতাম। তাই যাওয়া হতো না। সেই ভয়টা কাটিয়ে দেওয়ার জন্যেই হয়তো প্রিয় ব্যক্তিত্ব জনাব কাজী সাহেবের ‘গরিবের ঘরে ধনীর পাড়া’র মতো ঘটনা ঘটে। যেখানে আমিই ওনার অফিসে যেতে ভয় পেতাম, সংকোচ করতাম, সেখানে তিনিই আমার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আমারই সামনে উপস্থিত! কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। সালাম বিনিময়ের পর বেশ কথা হলো ওনার সাথে। যাহোক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের লেখাগুলো আমার প্রতিষ্ঠানে কম্পোজ করে মেইল করে পাঠাতাম। এভাবে কাজ করতে করতে আমার লেখাগুলোও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশ হতো। মাঝে মাঝে পুরস্কারও অর্জন করতাম। তবে লিখতে লিখতে ভাবতাম, কোনোদিন যদি ওই বিভাগের দায়িত্ব পেতাম তাহলে লেখকদের কল্যাণে কাজ করারও সুযোগ পেতাম।
সময় ও সুযোগ এলো। প্রকৌঃ মোঃ দেলাওয়ার হোসেন সাহেব (মরহুম) একদিন আমাকে বললেন, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাহিত্য পাতা ও পাঠক ফোরামের বিভাগীয় সম্পাদক ক্ষুদীরাম দাস চাকুরির সুবাদে অন্যত্র (রাজবাড়ি) চলে গেছেন। তাই ওই বিভাগগুলোতে যদি আমি কাজ করি তাহলে ওনার কাছে ভালো লাগবে। কারণ উনিও দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে লিখেন।
আমি তাঁর কথায় বেশ খুশি হলাম। তিনি সম্পাদক মহোদয়ের সাথে কথা বললেন। এরপর আমি ধীরে ধীরে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের পাঠক ফোরাম, সাহিত্যপাতা ও প্রবাসী কণ্ঠের বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পাই। কাজ করার সুবাদে অনেক লেখক ও গুণীজনের সাথে পরিচয় হয়। এর মধ্যে সনতোষ বড়ুয়া, ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া, ফতেউল বারী রাজা, সামীম আহমেদ, নুরুন্নাহার মুন্নী, কবির হোসেন মিজি, রফিকুজ্জামান রণি, আশিক বিন রহিম উল্লেখযোগ্য।
আমার বিভাগীয় কাজ চলাকালে পাঠক ফোরামে লেখক ও পাঠকদের একটা সম্মিলন করার প্রয়াসে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু কাজটা শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত থেকে যায়। অন্যদিকে সাহিত্য পাতায় চাঁদপুরের যেসব গুণী লেখক চুপটি করে নিজকে আড়াল করে বসে থাকতেন, তাদেরকে জাগিয়ে তোলার কাজ করেছিলাম। তাঁদের সাক্ষাৎকার ও লেখাগুলো প্রকাশে অনড় ছিলাম। এক পর্যায়ে সাহিত্য একাডেমীতেও সব ধরনের লেখকদেরকে একত্রিত করার কাজ করেছিলাম।
যেভাবে আমি লেখক থেকে সাংবাদিক হলাম
সত্যিকার অর্থে কখনো ভাবিনি সাংবাদিকতা করবো। ছোটকাল থেকেই লেখালেখি পছন্দ করতাম। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠেও সাহিত্য নিয়ে লিখতাম। একদিন সম্পাদক মহোদয় আমাকে বললেন, ফরিদগঞ্জের একজন মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে একটা ফিচার নিউজ লিখতে। আমাকে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে স্মিতহাস্যে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘নিন। আপনাকে সাংবাদিক বানিয়ে দিলাম।’ সত্যিকার অর্থে এই বাক্যটিই আমার পরবর্তী জীবনে ব্রেনে জমায়েত হয়েছিলো। আমার ওই ফিচার নিউজটি লেখার পর দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে বক্স আকারে প্রকাশ হয়েছিলো। আমি অনুপ্রাণিত হয়ে পরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংবাদ লিখতে শুরু করি। যা-ই হোক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলাম। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারিনি সে সময়।
কিন্তু হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর মতো কিছুটা ভাগ্য বরণ করতে হয় আমাকে। ইউসুফ (আঃ)-এর বাবা নবী ইয়াকুব (আঃ) তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসার কারণে আল্লাহ বিচ্ছেদ দিয়েছিলেন। আমি একজন ক্ষুদ্র, নগণ্য ব্যক্তি। আমাকে সম্পাদক মহোদয় এতোটাই স্নেহ করতেন যে, তিনি অনেক মানুষের কাছেই আমার কাজের সুনাম করতেন। লোকেরা মাঝে মাঝে তা’ আমাকে বলতো। তো ভালোবাসার বিচ্ছেদ অনিবার্য! আমি হয়তো তখন তা’ বুঝতে পারিনি। আমার অদৃষ্ট ছিলো অন্যরকম। তাই আমাকে আমার প্রিয় স্থানটি ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে পুরোপুরি সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করি। প্রেসক্লাবের কল্যাণে ও উদ্যোগে টিআইবির অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, পিআইবির বুনিয়াদী সাংবাদিকতায় প্রশিক্ষণ নেই। এরপর চাঁদপুরের প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি স্থানীয় পত্রিকায় বিভিন্ন পদে কাজ করেছি। কিন্তু আমি আপাদমস্তক তাদের হতে পারিনি। আমার মনটি সব সময় পড়ে থাকতো দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে। কারণ এখানে শেখার কিছু আছে, আর অন্যদের কাছে শেখার কিছু তো তেমন একটা পাইনি বরং তারা আমার কাছে শেখার জন্যে চেষ্টা করতেন। তাদের আচার-ব্যবহার আমাকে খুব কষ্ট দিতো। তারা মানহীন হয়েও অনেক দম্ভ দেখাতেন, যা আমাকে খুব পীড়া দিতো। সে কারণে আমি অন্য কোনো পত্রিকায় ভালোভাবে কাজের চেষ্টা সত্ত্বেও আঁকড়ে পড়ে থাকিনি।
শেষ পর্যায়ে চাঁদপুর থেকে প্রকাশিত একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদকও হয়েছিলাম। ওই অনলাইন নিউজ পোর্টালের নামটিও আমি দিয়েছিলাম। দিনরাত প্রায় ১৮ ঘণ্টাই আমি দায়িত্ব পালন করে ওই নিউজ পোর্টালটিকে একটি মানদ-ে স্থাপন করেছিলাম। কিন্তু সুখ তো আর চিরস্থায়ী নয়। আমার পেছনে কালো একটা ছায়া ঘুরতে থাকে। যাকে আমরা ওই অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রকাশক বানালাম ভালোবেসে, তাঁর মনেই স্বপ্ন জাগলো যে তিনি সম্পাদক ও প্রকাশ হবেন। আমাকে বলা মাত্রই আমি বলে দিলাম, আমি নিতে আসিনি, দিতে এসেছি। সুতরাং আমি সম্পাদক থেকে নিচে নেমে গেলাম, প্রধান সম্পাদক হলাম। বিধিবাম, পরদিনই ওই নিউজ পোর্টাল থেকে আমার নামটি মুছে দেয়া হলো। শুধু ঝিকমিক করছে তারই নাম, যাকে আমরাই প্রকাশক হিসেবে নিয়োগ দান করেছিলাম। আমি দুঃখ-কষ্ট আর যাতনায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম। আল্লাহতায়ালা আমাকে ১৫ দিনের মধ্যেই চাঁদপুর রিপোর্ট অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক ও প্রকাশক বানালেন, যা আজও আছে। শুধু তাই নয়, প্রিয় সময় নামে জাতীয় একটা নিউজ পোর্টালও আমি ক্রয় করে এখনো মালিক হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া চার বছর ইউনানী ডিপ্লোমা কোর্স (ডিইউএমএস) করে একজন হাকীম হিসেবে হাজীগঞ্জের রামপুর বাজারে নিজস্ব চেম্বার স্থাপন করে সারাদেশে অনলাইনের মাধ্যমে ও চেম্বারে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বলা প্রয়োজন, ডিপ্লোমা কোর্স শেষ হওয়ার তিন বছর পর ২০২৩ সালে ইউনানী চিকিৎসক হিসেবে সরকারি নিবন্ধন পাওয়ার পর আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব জনাব কাজী শাহাদাত সাহেবই ওই চেম্বার উদ্বোধন করে আমাকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।
সবদিক বিবেচনায় আমার মনে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে একটা মায়া থেকে যায়। এই মায়াটা আমাকে শেষ পর্যন্ত আবারো আমার এই লেখালেখি ও সাংবাদিকতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। সেজন্যে আমি সম্পাদক মহোদয়ের কাছে বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
একটা কথা বলা প্রয়োজন, আমি ওই সময়টাতে উপলব্ধি করেছি, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে অন্যদের কাজের বিশাল ব্যবধান। অন্যরা কাজ করে কর্মচারী-কর্মকর্তা হিসেবে। কিন্তু দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান এবং তাঁর অধঃস্তনরা কাজ করেন ভালোবেসে আন্তরিকতায়। আসলে সে কারণেই বেশিরভাগ অন্তঃপ্রাণ, যারা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ছেড়ে যায়, আবারও ওইসব বিষয় অনুধাবন করে ফিরে আসে। আর কেউ কেউ গিয়েছেন, বড়ো হয়েছেন, ভালো অবস্থান তৈরি করে ফেলেছেন, সেটা ভিন্ন কথা।
তবে আমিও ভালো অবস্থান তৈরি করেছি। কিন্তু তারপরও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে পুনরায় মিশে আছি। আমি চাই মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের সাথে যাতে আমার অস্তিত্ব বিরাজমান থাকুক। মৃত্যুর পরও যাতে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ মনে করতে পারে, আমি তাঁদেরই স্বজন ছিলাম।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় সম্পাদক, পাঠাক ফোরাম, সাহিত্য পাতা ও প্রবাসী কণ্ঠ; বর্তমান বিভাগীয় সম্পাদক, তথ্য-প্রযুক্তি কণ্ঠ, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।