প্রকাশ : ৩০ মে ২০২৪, ০০:০০
চাঁদপুর কণ্ঠের ৩০ বছর ও আমার সাংবাদিকতা
চাঁদপুর কণ্ঠ সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে উন্নীত হলো। বিভিন্ন সাংগঠনিক কার্যক্রমের খবর দিতে ছুটে যেতাম চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে। চাঁদপুর ললিতকলা, ইন্টার্যাক্ট ও রোটার্যাক্ট ক্লাব পরবর্তীতে মিঠুন ফ্রেন্ডস্ অ্যাসোসিয়েশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবিসহ নিউজ, প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আসতাম। পরের দিন যখন ছবিসহ নিউজ হাতে পেতাম তখন মনে খুব আনন্দ ও উৎসাহ সৃষ্টি হতো।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে ৫২-এর ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে মিঠুন ফ্রেন্ডস্ অ্যাসোসিয়েশনের ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের ছবি সাংবাদিক রহিম বাদশা চাঁদপুর কণ্ঠে বেশ বড় করে প্রকাশ করে দিলেন। সেই স্মৃতির আনন্দ ভুলবার নয়।
চাঁদপুর শহরের সিনিয়র সাংবাদিক এবং পত্রিকার সম্পাদকগণের স্নেহ-ভালোবাসায় আমি সত্যিই ধন্য ও কৃতজ্ঞ। সংস্কৃতি চর্চা ও সমাজসেবা এবং ক্রীড়ামূলক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে খবরের কাগজে ছাপানো এই চিন্তা থেকে মুক্ত হতে উৎসাহসহ স্নেহ পেয়েছি বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত, মির্জা জাকির, বিএম হান্নান, শহীদ পাটোয়ারী, মাহবুবুর রহমান সুমন ও প্রয়াত সাংবাদিক দৈনিক চাঁদপুর দর্পণ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক শ্রদ্ধেয় ইকরাম চৌধুরীর।
আমার অবশ্য সাংবাদিকতা করবো এমন চিন্তা মনে ছিলো না। বিভিন্ন নিউজ দিতে গিয়ে সকলের সাথে পরিচিতি লাভ করায় হঠাৎ একদিন শ্রদ্ধেয় ইকরাম চৌধুরী ‘সাংবাদিক হও, কাজ করো, নিউজ পাঠাও’ ইত্যাদি বলে উৎসাহিত করেন। কিন্তু আমি মনের ভয়ে কখনোই ইকরাম চৌধুরী ভাইয়ের কথা মতো নিউজ পাঠাতাম না। তিনি আমাকে দেখলেই শুধু বলতেন, চাঁদপুরে আছো, সংগঠন করো, পাশাপাশি সাংবাদিকতা করলে সমস্যা কোথায়? ইকরাম ভাইকে তাঁর কথার উত্তরে বললাম, না ভাই আমাকে দিয়ে সাংবাদিকতার মতো কঠিন কাজ করা সম্ভব নয়। পরে একদিন ইকরাম ভাই তাঁর দর্পণ অফিসে এক বিশেষ প্রয়োজনে গেলে সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় লক্ষ্মণ চন্দ্র সূত্রধর দাদাকে ডেকে বললেন, পলাশকে সাংবাদিক কীভাবে হবে তার নিয়মকানুনগুলো শিখিয়ে দাও। তিনি আমাকে ইকরাম ভাইয়ের কথামতো হাতেকলমে সাংবাদিকতার বিষয় মোটামুটি বুঝিয়ে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে সাহস নিয়ে সাংবাদিকতায় এগোতে শুরু করলাম। অসুস্থতার কারণে এবং উন্নত চিকিৎসার জন্যে ভারতে আসা-যাওয়ায় সাংবাদিকতার কাজ থেকে বিরত থাকলাম। এর ফাঁকে বর্তমানে চাঁদপুর জেলা পরিষদে কর্মরত শেখ মহিউদ্দিন রাসেল ভাইয়ের মাধ্যমে আঃ রহমান স্যারের সম্পাদিত পত্রিকা দৈনিক চাঁদপুর সংবাদে অল্প কিছুদিন নিউজ দেই। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া জীবন ওই অফিসে সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আমি তখন সেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলাম। অবশ্য তখন সাংবাদিক হিসেবে কেউ আমাকে জানতেন না এবং চিনতেন না।
যদ্দুর মনে পড়ে, ২০০২ সালের শেষের দিকে বাবুরহাটে আমরা ক’জন বন্ধু আড্ডায় আছি। বন্ধু শামীম আমায় বললো, পলাশ! তোকে শহীদ পাটোয়ারী ভাই জরুরি দেখা করতে বলেছেন। তো একদিন কালীবাড়ি মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ শহীদ পাটোয়ারী ভাইয়ের সাথে কথা হয়। তিনি আমাকে উৎসাহিত করে বলেন, তুমি চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে আসো, কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সাথে দেখা করো। তারপর শহীদ ভাইয়ের কথা মতো চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে গিয়ে প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত ভাইয়ের সাথে দেখা করলাম। তিনি অবশ্য পূর্ব থেকে আমাকে চিনতেন, যেহেতু প্রায়ই সাংগঠনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশ করতে তাঁর অফিসে যাওয়া-আসা করতাম। তিনি আমাকে বললেন, তুমি সম্পাদক ও প্রকাশক বরাবর পত্রিকায় নিয়োগের জন্যে আবেদন লিখে নিয়ে আসো। তিনি যেদিন বলেন, ঠিক সেদিনই বন্ধু রহমত উল্লাহ খানের কম্পিউটার টুমরো থেকে দরখাস্ত অতি সংক্ষিপ্তভাবে তৈরি করে চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে কাজী শাহাদাত ভাইয়ের ডেস্কের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম। দরখাস্তখানা দেখে কাজী শাহাদাত ভাই খুব হাসলেন। তখন যুগ্ম সম্পাদক শ্রদ্ধেয় গিয়াসউদ্দিন মিলন ভাইকে ডেকে বললেন, মিলন দেখো তো পলাশের দরখাস্ত ঠিক আছে কি না। তখন মিলন ভাইও হাসি দিয়ে বললেন, সংক্ষিপ্তভাবে লেখা, আচ্ছা ঠিক আছে, চলবে।
কাজী শাহাদাত ভাই আমাকে পত্রিকায় কাজ করার দরখাস্ত রেখে নিয়োগ দিয়ে দিলেন। দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করলাম। কাগজে সংবাদ লিখে অফিসে গিয়ে জমা দিয়ে আসতাম। তবে খুব বিলম্ব হতো ছবি ওয়াশ নিয়ে। ছবি প্রিন্ট করতে অনেক সময় লাগতো। এর মধ্যে লোডশেডিং হলে তো কথাই নেই, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ল্যাবে অপেক্ষা করতে হতো। মনের ভয়কে জয় করে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে রিপোর্ট দিয়ে আসতাম, পরের দিন প্রকাশ পেতো। তাতে যে কী আনন্দ উপভোগ হতো তার কথা আর বলে-লিখে বোঝানো যাবে না কিছুতেই।
চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসে আমার দেয়া বা পাঠানো নিউজগুলোর ভুলগুলো খুব সযত্নে শুদ্ধ করে গুছিয়ে দিতেন পারভেজ খান, মির্জা জাকির ভাই ও শাহআলম মল্লিক ভাই। তাঁদের কাছ থেকেও অনেক শিখেছি এবং জেনেছি।
শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত ভাইয়ের ডেস্কে সাপ্তাহিক প্রুফ পড়ার দায়িত্ব পালন ছিলো খুব আনন্দের, যদিও গভীর রাতে চাঁদপুর শহর থেকে বাবুরহাট আসতে কোনো যানবাহন পাওয়া যেতো না। তাই মাঝে মাঝে কাজী শাহাদাত ভাই যতো দ্রুত সম্ভব আমাকে ছেড়ে দিতেন। আমি অনেক সময় রাত ৩টায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া নাইট কোচের বাসে উঠে বাবুরহাট চলে আসতাম।
খুব মনে পড়ে, রাতের ডিউটিতে সবাই সবাইকে নিয়ে খুব মজা করতো, খোশগল্প হতো। তবে দুষ্টুমি হতো কাজী শাহাদাত ভাইয়ের অগোচরে। কোনো রূপ ভুল হলে শাহাদাত ভাই ভয়ঙ্কর রেগে যেতেন।
রাতের নাস্তা ও লাল চা সবাই মিলেমিশে খেতাম। অনেক উদারতার সাথে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে কাজ করেছি।
শ্রদ্ধেয় কাজী শাহাদাত ভাইয়ের স্নেহ-আদর-ভালোবাসা এবং রাগ-বকায় অনেক শিখেছি, যা জীবন পথের চলায় খুবই প্রয়োজন ছিলো। যতোটুকুই জেনেছি শিখেছি তা সততার সঙ্গে পালন করার চেষ্টা করছি।
শুধু মনে কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় এ ভেবে কিংবা কখনোই ভাবিনি যে, চাঁদপুর কণ্ঠ অফিস থেকে বের হবো বা বের হয়ে যাবো! কাজী শাহাদাত ভাইয়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবো কোনো এক নিষ্পাপ অভিযোগে! ২০১৩ সালের মার্চ মাসে চোখের জল সংবরণ করতে হবে তা ছিলো কল্পনাতীত। সেদিন কী এমন অপরাধ ছিলো জানি না। তবুও অপরাধটুকু নিজ মাথায় নিয়ে জীবনের আনন্দময় সময় ও অফিসের লাল চায়ের মায়া ত্যাগ করে অপরাধী হিসেবে স্মৃতিময় হয়ে বের হয়ে চলে আসি। যেটি ভাবলে আজও আমাকে পীড়া দেয়।
চাঁদপুর কণ্ঠের ১৭তম জন্মদিন উপলক্ষে সংবাদকর্মী হিসেবে একটি ক্রেস্ট উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম, যেটি সযত্নে রেখে দিয়েছি।
সংবাদকর্মী হিসেবে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে এখন আমার নাম প্রকাশিত না হলেও, প্রথম ভালোবাসা যায় না ভোলা, সেই প্রেমের টানে চাঁদপুর কণ্ঠে জড়িয়ে আছি বিভাগীয় পাতায় পাতায়। আর আমার এই দূরত্বটা গুছিয়ে দিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠের মেলবন্ধনে বিনি সুতোর মালা জড়িয়ে দিয়েছেন কবি-সাহিত্যিক তরুণ গবেষক মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। ধন্যবাদ প্রিয় ফরিদ হাসান। অফুরন্ত ভালোবাসা ও শুভ কামনা রইলো। সত্যিই তো মানুষ স্মৃতিকাতর এবং স্মৃতিতেই যুগের পর যুগ বেঁচে থাকে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মিঠুন ফ্রেন্ডস্ অ্যাসোসিয়েশন, চাঁদপুর জেলা শাখা; সাবেক বাবুরহাট প্রতিনিধি, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।