শনিবার, ১৪ জুন, ২০২৫  |   ২৯ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫, ০৯:২১

বাজেট কতোটা প্রবীণবান্ধব?

হাসান আলী
বাজেট কতোটা প্রবীণবান্ধব?

সাধারণ অর্থে বাজেট হলো সরকার এক বছরে জনগণের কাছ থেকে কতো টাকা কর হিসেবে নেবে এবং জনগণের কল্যাণে কোন্ কোন্ খাতে কতো ব্যয় করবে তার হিসাব। রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে। সরকারের কাজ হলো বৈষম্যহীন পরিবেশে জীবন জীবিকার নিরাপত্তা দিয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ করা।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় দু কোটি প্রবীণের বসবাস। বয়স্ক ভাতার আওতায় এখন ৬০ লাখের অধিক প্রবীণ মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা পান। ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে জনপ্রতি ৫০ টাকা বৃদ্ধি করে ৬৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৫০ টাকা হারে বৃদ্ধি ছাড়া প্রবীণদের জন্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় বাজেট বক্তৃতায় পেলাম না।

পুরো বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টার নিচের বক্তব্যটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘’প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই। প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবার বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবন জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ--এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। দুর্বল হয় সমাজের ভিত।”

এবারের বাজেটে দেশের দু কোটি প্রবীণ ভোটার অর্থ উপদেষ্টার গভীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি বলে মনে হয়েছে। বাজেটে আলাদা করে নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্যে বরাদ্দ রয়েছে। দেশের প্রায় ১১শতাংশ প্রবীণের জন্যে আলাদা মন্ত্রণালয় না থাকায় প্রবীণরা বাজেট বৈষম্যের শিকার হয়েছে বলে মনে করি।

বাজেটে আলাদা করে প্রবীণ মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাব থাকলে প্রবীণদের কল্যাণ বৃদ্ধি করা যেতো।

যৌবনে যাঁরা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরা বার্ধক্যে পৌঁছে সম্মান, মর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সুন্দর জীবনযাপনের নিশ্চয়তা চান। এই চাওয়াটা দয়া নয়, রাষ্ট্রের এবং সমাজের দায়।

আমাদের সমাজে প্রবীণ বিষয়ে কোনো কথা উঠলেই অধিকাংশ মানুষের চোখে ভেসে উঠে নির্ভরশীল অসহায় কতোগুলো প্রবীণ মানুষের মুখ। আমরা ভুলে যাই যে, সরকার পরিচালনায় যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদের অধিকাংশই প্রবীণ।

প্রবীণরা কারো দয়া, কৃপা ও করুণার পাত্র হতে পারে না।

প্রবীণের অস্বীকৃত ও অবৈতনিক সেবামূলক কাজের কোনো সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। তাঁদের শ্রম ও সময় উৎসর্গ করেছেন পরিবার ও সমাজের জন্যে। প্রবীণের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে যথাযথ মূল্যায়ন করে আর্থিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে জিডিপিতে যোগ করতে হবে।

প্রবীণ কৃষি কাজে, মৎস্য উৎপাদনে, পোল্ট্রি শিল্পে, জিনিসপত্র বেচাকেনায়, বাড়িঘরের তত্ত্বাবধানে, শিশু লালন পালনে, সেবা-যত্নে, বাড়ি ঘরের তত্ত্বাবধানে, জমি জমার বিলি বন্টনে, বাজার সদাই, বাড়ি ঘরের পাহারায় সহায়কের ভূমিকা পালন করছে।

সামর্থ্যবান প্রবীণরা পরিবারের আয় রোজগারে সহায়তা করে। সামর্থ্যহীন প্রবীণরা বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সমাজের সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে পরিবারকে সহায়তা করে। প্রবীণরা সামাজিক উন্নয়নে, সচেতনতা সৃষ্টি করতে, বিরোধ মীমাংসায়, অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

বাজেটে নিচের বিষয়গুলো যুক্ত করার প্রস্তাব করছি--১. নতুন করে পাঁচ লাখ দরিদ্র প্রবীণকে বয়স্ক ভাতার আওতায় নিয়ে আসা। ২. বয়স্ক ভাতা গ্রহণকারী প্রবীণদেরকে অসংক্রামক ব্যাধি উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তের চর্বি, শ্বাস কষ্টের ওষুধ হাসপাতাল/কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বিনামূল্যে পাওয়ার সুযোগ রাখা। ইপিআই’র টিকা কর্মসূচিতে প্রবীণদের জন্যে নিউমোনিয়ার টিকা দেবার প্রস্তাব করছি। ৩. বাস, রেল ও লঞ্চে প্রবীণদের জন্যে ২০% কম ভাড়ায় চলাচল করার সুযোগ রাখা। ৪. প্রবীণের সার্বিক কল্যাণে একটি প্রবীণ মন্ত্রণালয় গঠনের উদ্যোগ নেয়া। ৫. উন্নতমানের কেয়ার গিভার তৈরি করার জন্যে প্রত্যেক বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত জেরিয়েট্রিক হাসপাতাল নির্মাণ অথবা বড়ো বড়ো মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে জেরিয়েট্রিক ওয়ার্ড চালু করা; প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কেয়ার গিভারদের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে লাইসেন্স নেবার সুযোগ রাখা। ৬. পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ঝুঁকির শীর্ষে অবস্থান করছে। বায়ু, মাটি, পানি ও শব্দ দূষণ প্রতিরোধে প্রবীণদের সম্পৃক্ত করা।৭. বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার প্রশ্নে প্রবীণ ব্যক্তিদের যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে প্রতিকার প্রদান করা। আসামি হলে পুলিশের চার্জশিট দেয়ার আগ পর্যন্ত জামিনে থাকার সুযোগ দিতে হবে।জেলে রাখতে হলে সর্বোচ্চ সম্মান মর্যাদা নিশ্চিত করা। নিজের কল্যাণে মতামত দিতে অক্ষম হলে আদালত প্রবীণের কল্যাণে কাউকে নিয়োগ দিতে পারবে। ৮. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের জন্যে প্রবীণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সারা দেশে পাঁচ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আইসিডি ল্যাব স্থাপন করা এবং প্রায় ৩৬ হাজার শিক্ষককে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সারাদেশে ৪৯১ টি উপজেলায় তরুণ-তরুণীদের জন্যে তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে একজন প্রবীণকে তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিবে। ৯. নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবার উন্নয়নের প্রশ্নে প্রবীণদের জন্যে ‘জরুরি প্রবীণ সেবা’ নামে একটি সম্পূর্ণ টোল ফ্রি ফোন নাম্বার লাগবে, যাতে করে নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে/জানমাল রক্ষায় জরুরিভাবে পুলিশের সহায়তা পায়।

উপরের প্রস্তাবগুলো বিবেচনা করার আহ্বান জানাই।

লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়