প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২২, ০০:০০
রাজার খেলা ক্রিকেটকে আমজনতার খেলায় যারা পরিণত করেছেন, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে যাদের নাম থাকবে, শেন ওয়ার্ন তাদের অন্যতম। দীর্ঘ সময়ের খেলা বলে যারা ক্রিকেটের প্রতি কখনো অনুরাগ পোষণ করেননি, শেন ওয়ার্ন তাদেরকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন মাঠে, তার জাদুর অনন্ত মায়ার বলে। হেটারোক্রোমিয়ায় ভোগা এক চোখ নীল আর এক চোখ সবুজ দৃষ্টি নিয়ে মাথাভরা সোনালি কেশে ক্রিকেটের বাইশগজী ক্রিজে যখন বল হাতে আবির্ভূত হতেন অজি শেন ওয়ার্ন, তখন মাঠের জীবন্যাস হতো, মাঠ হয়ে যেতো প্রাণবন্ত। বল তার কথা শুনতো আর তিনি শুনতেন পিচের কথা। বোলিং যে একটা নান্দনিক শিল্প, তা কেবল শেন ওয়ার্নই আধুনিক দর্শকদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। মুখে সাদা সানস্ক্রিন মেখে আগ্রাসী এক স্বর্ণকেশি রহস্যময় মানুষ যখন তার তূণ থেকে বলের বান মারে ব্যাটসম্যানকে উদ্দেশ্য করে, তখন মনে হয় মাঠজুড়ে রচিত হয়ে গেছে এক কাক্সিক্ষত মহাকাব্য। জাত ক্রিকেটারের সূতিকাগার অস্ট্রলিয়ার গর্ভ হতে যে শিল্পী জাদুকর জন্ম নিয়েছে, তার হাতেই জন্ম হয়েছে আধুনিক ক্রিকেট ইতিহাসের। অনেকের চোখের বিষ ওয়ার্নি আবার তাদের হৃদয়েরই মধ্যমণি ছিলেন তার বোলিং-প্রজ্ঞার কারণে। ব্যাটসম্যানদের ধ্রুপদী বৈরী শেন ওয়ার্ন আজ জীবনের সকল মায়া কাটিয়ে অনন্তলোকে দীপ্যমান। তার ক্রিকেটদীপ্তির প্রভায় প্রগাঢ় অন্ধকারেও বাইশগজে জ্বলে উঠবে নান্দনিক আলোর ফোয়ারা।
ঊনিশশো ঊনসত্তর সালের আনলাকি তের জুলাই একদিকে মানুষ চাঁদ বিজয় করে তাতে পা রেখেছে আর একই সালের সেপ্টেম্বরের আনলাকি তের তারিখে জন্ম হয়েছে ভিক্টোরিয়ার 'গুল্লি ' এলাকায় ক্রিকেট কিংবদন্তি শেন ওয়ার্নের। ক্রিকেটে লেগ স্পিনারের সংখ্যা এমনিতেই কম। এই বনেদী শিল্পকে ইতিহাস করে রাখা শেন ওয়ার্নের বল যখন ক্রিজে ভেল্কি দেখাতো তখন আমোদিত হতো সারা বিশ্ব। বল অফ দ্য সেঞ্চুরিতে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংয়ের সাথে হতবাক হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। ওভারের ছয়টা বল ছয় রকমের ডেলিভারী দিয়ে ব্যাটসম্যানকে সবসময় অনুমানের ওপর রাখতেন লেগস্পিনের কিংবদন্তি। কোন্টা যে গুগলি, কোন্টা লেগস্পিন তা বুঝতে বুঝতেই ব্যাটসম্যান ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন।
যে ভারতের বিপক্ষে ওয়ার্নের অভিষেক, সে ভারতই ওয়ার্নকে ভুগিয়েছে জীবনভর। শেন তার নিজের ভাষ্যে বলেছেন, ঘুমের মধ্যে তিনি মাঝে মাঝেই শচীনকে ক্রিজ ছেড়ে ড্যান্সিং ডাউন দ্য ট্র্যাকে তেড়ে আসতে দেখে নির্ঘুম বিছানায় উঠে বসতেন। ঊনিশশো আটানব্বই সসলে সারজাহর মাঠে শচীনের হাতে যে বেধড়ক মার তিনি খেয়েছিলেন, তা তার খ্যাতিতে কোনো কালিমা লেপন করেনি, বরং শচীনের প্রতি তার শ্রদ্ধা যেমন বাড়িয়ে তুলেছে, তেমনি তার প্রতিও সবার ভালোবাসা বেড়ে গেছে। ঊনিশশো বিরানব্বইতে যে স্বর্ণালি যাত্রার সূচনা হয়, সে যাত্রায় ছেদ পড়ে দুহাজার পাঁচের শেষ টেস্ট। এরপর হতেই নিভে গেছে ক্রিকেটের অর্ধেক জৌলুস।
বর্ণিল জীবনে শেন বহুল কাক্সিক্ষত খেলোয়াড় যেমন ছিলেন, তেমনি নিষিদ্ধ হওয়ার খড়গেও পতিত হয়েছেন। ডোপ টেস্টে আটকে কেলেংকারির কালিমা নিজের গায়ে মাখলেও মহাতারকার জ্যোতি তাকে ছেড়ে যায়নি কখনো। পারিবারিক জীবনে ছেদ টানা শেন মাঠের মাঝে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে মাতিয়ে রাখতেন মাঠ। কোন না কোনভাবে বিনোদিত হতো দর্শক। সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের তালিকায় ঢুকে যাওয়া, আইসিসির হল অব ফেমে স্থান পাওয়া ওয়ার্নির কাঁধে বর্তেছিল ক্যাঙারুদের ওয়ানডে ক্রিকেটের দায়িত্ব। অধিনায়ক হিসেবে সে দায়িত্ব পালন করে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠা ওয়ার্নি সেই সুবাদেই আইপিএল-এ রাজস্থান রয়্যালসকে চ্যাম্পিয়ান করে তুলেছিল। নিজের তেইশ নম্বর জার্সিকে মিথ বানিয়ে তোলা শেন ওয়ার্ন আগামী প্রজন্মের মধ্যে স্পিনের প্রতি প্রেম ঢুকিয়ে দেয়া এক হ্যামিলনের বাঁশিঅলা, যে ডেকে নিয়ে গেছে তারুণ্যকে মাঠের বাইশ গজে। নিরীহ বাঁকের বলে স্পিনের বিষ মাখিয়ে ওয়ার্ন একের পর এক বধ করে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে নিজের দলকে।
ওয়ার্ন এক আগুনের পরশমণি। রেকর্ডের বরপুত্র শেন ওয়ার্ন আমাদের কালের এক জ্বলন্ত কিংবদন্তি। আমাদেরকে ধন্য করে আকাশের তারা হয়ে যাওয়া শেন মনের জ্যোতিষ্ক হয়ে আলো বিলিয়ে যাবেন অনন্ত কাল।