প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২১
ফরিদগঞ্জে বর্ষাকালের প্রিয় হা-ডু-ডু খেলা এখন বিলুপ্তির পথে

ফরিদগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালের ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় হা-ডু-ডু খেলা কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। বর্ষাকালে আবালবৃদ্ধবনিতার রোমাঞ্চ উপভোগের অন্যতম মাধ্যম ছিলো এ হা-ডু-ডু খেলা। বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় এই খেলাটি এখন শুধু ঐতিহ্যের বাহকে পরিণত হয়েছে। ফরিদগঞ্জের মানুষের কাছে চিরচেনা এই খেলাটির প্রাণ ফিরে আনতে উপজেলা প্রশাসনের একটু সুনজর প্রয়োজন।
একটা সময় ফরিদগঞ্জের আনাচে কানাচে মাইক বাজিয়ে বিভিন্ন মিনি মার্কেট, বিদ্যালয়ের মাঠ ও জনবহুল এলাকায় এ হা-ডু-ডু খেলা হতো। তখন বিজয়ী দলকে গেঞ্জি, গামছা, ছাগল বা মোরগ বাজি ধরে অথবা বিভিন্ন ধরনের মেডেল বাজি ধরে দেয়া হতো।মনের আনন্দে এক গ্রামের সঙ্গে আরেক গ্রাম, অথবা এক ইউনিয়নের সঙ্গে আরেক ইউনিয়ন এবং এক বাড়ির সাথে আরেক বাড়ি অথবা বিবাহিত ও অবিবাহিত, এক স্কুলের সাথে আরেক স্কুল এবং প্রবাসী ও দেশীদের মধ্যে এই খেলার প্রতিযোগিতা হতো। এছাড়া তৎকালীন সময়ে ফরিদগঞ্জের সাথে পার্শ্ববর্তী হাজীগঞ্জ, রামগঞ্জ, চাঁদপুর সদর অথবা রায়পুর উপজেলার সাথেও খেলা হতে দেখা গেছে। তখনকার সময়ে হাজীগঞ্জ, রামগঞ্জ, চাঁদপুর সদর, রায়পুর সহ হা-ডু-ডু খেলা হলে এই উপজেলাগুলোর মানুষের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠতো। কালের বিবর্তনে মানুষ আজ ভুলতে বসেছে এই খেলা। হা-ডু-ডু খেলা আজ ফরিদগঞ্জে বিলুপ্তির পথে।
খেলাটি বিলুপ্ত হওয়ার কারণে পুরোনো খেলোয়াড়েরা আজ সংখ্যায় কমে যাচ্ছে এবং তৈরি হচ্ছে না নতুন কোনো খেলোয়াড়। পুরোনো ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রাও অর্থাভাবে প্রসার ঘটাতে পারছেন না এই খেলার। হা-ডু-ডু বাংলাদেশের অতি পুরোনো এবং জাতীয় একটি খেলা। ফরিদগঞ্জে হা-ডু-ডু খেলা বর্ষাকালে প্রিয় খেলা হবার কারণ ছিলো, বর্ষাকালে মাটি নরম থাকে। যে মাটিতে খেলতে গিয়ে খেলোয়াড়রা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। শুধু ফরিদগঞ্জ নয়, একটা সময় এই হা-ডু-ডু খেলাটি গ্রামীণ জগতের সেরা খেলা হিসেবে থাকলেও বর্তমানে তার জায়গা দখল করে নিয়েছে টেলিভিশনের পর্দায় ক্রিকেট খেলা এবং মোবাইল ফোনে বিভিন্ন গেম খেলা।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার হা-ডু-ডু খেলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলোয়াড়দের মধ্যে খাঁড়খাদিয়া গ্রামের আব্দুল কাদির খান, সকদিরামপুরের মোস্তফা কামাল বাবুল, পশ্চিম সকদিরামপুরের রফিক, কৃষ্ণপুরের মন্নান ভূঁইয়া, হুমায়ুন কবির খান বলেন, হা-ডু-ডু খেলা বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। এই খেলাটি একটি জনপ্রিয় খেলা। খেলাটি এক সময় ফরিদগঞ্জে বর্ষাকালে খুব জনপ্রিয় ছিলো। খেলাটি এলাকার যারা শক্তিশালী ও সুচতুর মানুষ ছিলেন, তারাই বেশি খেলতেন। তারা বলেন, এই খেলাটি খুব রিস্কি খেলা ছিলো। খেলতে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় লাগতো। বর্ষার সিজনে প্রায় তিন চার মাস ফরিদগঞ্জ উপজেলার সাথে পার্শ্ববর্তী হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর সদর, রামগঞ্জ এবং রায়পুরের সাথে খেলা হতো। অনেক শক্তিশালী খেলোয়াড় আসতো। তবে তারা বলেন, হা-ডু-ডু খেলায় বুদ্ধির চাইতে শক্তির দরকার হতো বেশি। এই খেলায় প্রতিনিয়তই কারো হাত, কারো পায়ে নয়তো অন্যান্য জায়গায় ব্যাপক সমস্যা দেখা দিতো। উপরোল্লিখিত সকল খেলোয়াড়ই বলেন, হাজীগঞ্জের বাকিলা এলাকা থেকে রবি দাস এবং মহামায়া হতে আলী আজগার নামে দুজন খেলোয়ার আসতেন। তাদের সাথে আমরা অনেকেই ভয়ে খেলতে নামতাম না। তারা দুজন অত্যন্ত দুর্র্ধষ খেলোয়াড় ছিলেন। মোট কথা, ফরিদগঞ্জ উপজেলায় একসময় হা-ডু-ডু খেলা নিয়ে ব্যাপক গল্প ছিলো।
এ উপজেলার হা-ডু-ডু খেলায় নামকরা খেলোয়াড়দের মধ্যে রাজিব খান, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য তরিকুল্লা মিজি, আ. রহিম মিজি, মাহাবুবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, হা-ডু-ডু খেলা কোনো যেনতেন খেলা নয়। এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং জাতীয় খেলা। খেলাটিকে হারিয়ে যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। জাতীয় মানের এই খেলাটিকে ধরে রাখতে একেবারেই সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করলেই যথেষ্ট। তারা বলেন, একটা সময় ঘনবসতি ছিলো না, জায়গা জমিনের উপর কারো লোভ লালসা ছিলো না। আমরা যখন হা-ডু-ডু খেলা খেলতাম তখন এতো রাস্তা ফাঁকাও ছিলো না। তাই আগেরকার দিনে যেখানে সেখানে এই খেলার আয়োজন করে জমিয়ে দেওয়া যেতো। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। খেলাটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বর্ষার সিজনে এই খেলাটির ওপর প্রতিযোগিতার আসর বসাতে পারেন। প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসকে অবহিত করে স্কুলে স্কুলে খেলা দিলেই এই খেলাটি প্রাণ ফিরে পাবে বলে তাদের বিশ্বাস। প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে এই খেলার আয়োজন করা যেতে পারে বলেও তারা জানান।
‘বিলুপ্তির পথে এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে হারিয়ে যাওয়া এবং ফরিদগঞ্জের আপাময় জনসাধারণের উপভোগের খোরাক বর্ষার সিজনের একমাত্র খেলা হা-ডু-ডুকে নিয়ে কী ভাবছেন’ এমন প্রশ্ন করলে ফরিদগঞ্জ উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বর্তমান এডহক কমিটির অন্যতম সদস্য নুরুন্নবী নোমান বলেন, হা-ডু-ডু বা কাবাডি খেলাটি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। এক সময় এই খেলাটি বর্ষার সিজনে ফরিদগঞ্জের জন্যে একটি প্রিয় খেলা ছিলো। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজ এই খেলাটি বিলুপ্তির পথে। তিনি বলেন, এই খেলাটিকে আগামীতে উপজেলার বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই খেলার উপর প্রতিযোগিতা দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে আগামী সভায় তুলে ধরবো।