বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

হিমুর সঙ্গে বাস
ফরিদুল ইসলাম নির্জন

রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে যায়। চারদিক নীরব নিঃস্তব্ধতায় ঢেকে গেছে। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই। তবে মাঝে মধ্যে দূর প্রান্ত থেকে ভাসা ভাসা শব্দে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হৃদয়টা বিরহের মৌনতায় চৈত্রের মোহনার মতো হয়ে গেছে। বেশ কয়েকদিন হলো হিমুর কোনো খবর নেই। তার সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো কোনো ফোন নম্বর, ঠিকানা ও মাধ্যম নেই। মধ্য রাতে হিমুর ফোনের অপেক্ষায় থাকি। হৃদয়টা চাতক পাখির মতো হয়ে গেছে। হিমু যেন মেঘের এক ফোঁটা জল। তার একবার ফোন পেলেই সব তৃষ্ণা মিটে যাবে। মধ্যরাতে হিমু ফোন দিয়ে একেক রকম অদ্ভুত কথা বলত। লাস্ট হিমুর সঙ্গে যে রাতে কথা হয়, ফোন দিয়ে বলল- রূপা, আজ বৃষ্টি হচ্ছে। বড্ড বেশি খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি খিচুড়ির সঙ্গে টক সঙ্গে নিয়ে এসো রমনা থানায়। আমাকে পুলিশ রমনা থানায় নিয়ে যাচ্ছে।

তখনই আমি রমনা থানার ওসিকে ফোন দিলাম। সে জানাল, এমন নামে কাউকে ধরা হয়নি। হিমুর জন্য মায়া হচ্ছে। হিমু এমন কেন! যদিও হিমু এমন হবে এটাই স্বাভাবিক। বরং এমন না হওয়াটা বড্ড অস্বাভাবিক। আজ হিমুকে খুঁজতে এখন বের হবো। রাতে হিমুকে পাওয়াই সম্ভব। জুতাবিহীন পা, পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে গন্তব্যহীন বা উদ্দেশ্যহীন ছুটে চলে অজানা পথে। আজ রাস্তায় এমন কাউকে দেখলে কাছে গিয়ে কথা বলব। জড়িয়ে ধরব। জোর করে গাড়িতে নিয়ে চলে আসব। হিমুর কাজিন বাদলের নম্বর নেই। ঠিকানা নেই। তার বাসায় গিয়েছে কি-না জানা নেই। ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে নয়। আজ আমি এই মধ্যরাতে হিমুকে খুঁজে বেড়াব। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই দারোয়ান থামিয়ে দিল। বলল, আফা, এত রাতে একা বেরুতে বারণ আছে। আপনাকে গার্ড ছাড়া ছেড়ে দিতে নিষেধ আছে। আমার চাকরি চলে যাবে। সরি আফা! কথাটি শোনার পর দারোয়ানকে খুন করতে ইচ্ছে করল। কিন্তু তা না করে জোরে ধমক দিয়ে গেট খুলে দিতে বললাম। আমার অগ্নিমূর্তি দেখে গেট খুলে দিতে বাধ্য হলো। গাড়ি নিয়ে বেরুলাম উদ্দেশ্যহীনভাবে হিমুকে খুঁজতে। গাড়ি ধীরগতিতে ড্রাইভ করে যাচ্ছি আর রাস্তার ফুটপাত দেখছি। দেখছি হিমু যাচ্ছে কি-না। একাকী চলছে কি-না। আমাকে পাস করে অনেক গাড়ি যাচ্ছে। হিমুকে দেখছি না। কারওয়ান বাজার পার হতেই দেখি কয়েকজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি ব্রেক করতে করতে তাদের অতিক্রম করে ফেলেছি। গাড়িটি ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছুতে লাগলাম। বাইরে বেরিয়ে পুলিশদের আমার পরিচয় দিলাম। তাদের হিমুর সম্পর্কে বর্ণনা দিলাম। বলতে লাগলামণ্ড এমন কাউকে কয়েকদিনে দেখেছে কি-না রাতে ঘুরতে? গ্রেফতার করছে কি-না। তারা জানাল, এমন অদ্ভুত কাউকে দেখেনি এবং গ্রেফতার করাও হয়নি। তারপর গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ধানমণ্ডির হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বাসায় দখিন হাওয়ার দিকে। গেটে গিয়ে ব্রেক কষে ধরলাম। বারবার হর্ন দিলাম। দারোয়ান চোখ মুছতে মুছতে এসে বলল, 'কী চাই এত রাতে! একটু ঘুমিয়েও শান্তি নেই।'

আমি রেগে বললাম, তোমাদের ঘুমিয়ে রাখার জন্য এই বাসায় রাখা হয়নি। গেট খুলে দাও। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সঙ্গে দেখা করব। তার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। হুমায়ূন আহমেদ স্যার হিমুকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে।

স্যার নেই। তিনি গত হয়েছেন অনেক আগেই। হিমুর খবর জানি না।

মিথ্যা বলছ তোমরা। এত রাতে ঢুকতে না দেওয়ার পাঁয়তারা করছ। শাওন ম্যাডামকে ডাকো।

শাওন ম্যাডাম নিউইয়র্কে। তিনি কবে ফিরবেন জানি না।

তুমি এসব বলে আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ। আমাকে ফাঁকি দিচ্ছ। গেট খুলে দাও, আমাকে হিমুর খোঁজ দাও। আমি মারা যাব হিমুকে ছাড়া... বলেই গাড়িটি জোরে ড্রাইভ করতে লাগলাম। কেন জানি বুকের ভেতর হুহু করে আর্তনাদ করে উঠল। চোখ ভিজে গেল। স্টিয়ারিং ভিজে যাচ্ছে। সোজা বাসায় রওনা করলাম। গাড়ি রেখে হেলতে হেলতে রুমে প্রবেশ করলাম। দরজা বন্ধ না করে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।

বেড পুরো অশ্রুতে সাগর-মহাসাগর হয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর রূপা, রূপা বলে ডাক শুনলাম। আমি ভয়ে আঁতকে লাফিয়ে উঠলাম। কে কে কে বলে চিৎকার দিলাম। দেখলাম হলুদ পাঞ্জাবি পরে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে বলছে, রূপা, এই জগৎটা বড্ড বেশি মায়ার। মায়া ছেড়ে সবাইকে প্রস্থান করতে হয়। তবে তার স্মৃতির মাঝেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তুমি আমাকে কেন খুঁজছ? আমি তো তোমার সারাক্ষণ সঙ্গে থাকি। যখন আকাশ থেকে বৃষ্টি নামবে হাত বাড়িয়ে দিয়ো। জল হয়ে ছুঁয়ে দিব তোমাকে। যখন আকাশজুড়ে ধবল রঙের জোছনা উঠবে, তখন তুমি তাকিয়ে থেকো। তোমার জিহ্বা ভিজে যাবে আমার শীতল উষ্ণতায়, আলোর মায়ায়। তোমার নিঃসঙ্গতায় আমাকে নিয়ে লেখা বইগুলো পড়ো। আমাকে খুঁজে পাবে। রাত্রির নির্জনতায় যখন চারপাশে কেউ থাকবে না, সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন তুমি আমাকে পাশে পাবে। দেখবে তোমার পাশে কেউ জুতাবিহীন পায়চারি করছে, পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরে ছুটে চলছে। রূপা, আমার জন্য মন খারাপ কর না। হিমুরা এমনই... কথাগুলো বলেই মিলে গেল। কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি হিমু হিমু বলে চিৎকার করতে লাগলাম। সিঁড়ি দিয়ে চলতে লাগলাম। গেটে দারোয়ানকে বলতে লাগলাম, কেউ কি ভেতরে এসেছিল। সে জানাল, আপনার ডাক্তার দেখানো দরকার আপা। এত রাতে কার সাহস আছে আপনার বাসায় প্রবেশ করবে?

রুমে ফিরলাম। চোখ মুছলাম। বেলকনি দিয়ে তাকিয়ে জোছনা দেখতে দেখতে হিমুকে ইশারা করলাম। হিমু যেন আমার অশরীরী ভালোবাসায় সাড়া দিল। নিজের ভেতরে হিমুকে খুঁজতে লাগলাম। ভাবলাম আমি তো নিজেই হিমু। আমার বসবাস, চলাচল হিমুর মতোই। হিমু না হলে কি মধ্যরাতের নির্জনতায় নিজেকে নিয়ে হারিয়ে যেতাম! এখন আমার সঙ্গে আমি বসবাস করব, যা হবে হিমুর সঙ্গে বসবাস।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়