প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০
চোখ দুটি বড় বড় করে তাকায় ছেলেটির দিকে। অসম্ভব ভালো লাগে ওর হাসিটাকে, যেন প্রকৃতির একটা অংশ। ভেতর থেকে মা গলা ছেড়ে ডাকে চিত্রা, এই দিকে আয় বারান্দায় বসে নখ কাটছিল চিত্রা। পাশেই গরম কফির কাপ থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। দূরের আকাশটাকে মনে হচ্ছে অজানা কোনো সুখের মানচিত্র। বিকেলের এই সময়টা চিত্রার খুব ভালো লাগে, আবার বড্ড একাও লাগে। চারদিক কেমন পবিত্র মনে হয়। ভার্সিটিতে আজ মিলি খুব হাসাহাসি করেছে চিত্রাকে নিয়ে। হাসাহাসির কারণ, চিত্রার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই কেন? অবশ্য চিত্রা বরাবরের মতোই শান্ত মেয়ের মতো চুপ ছিল। কোনো কথার উত্তর জানা না থাকলে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। চিত্রা তাই করেছে, কেবল একটু খারাপ লেগেছিল যখন সব মেয়ে হাঁ করে তাকিয়ে হাসছিল। কাউকে যে ওর ভালো লাগেনি এমন নয়। কলেজ লাইফ থেকে শুরু করে অনেক ছেলেকেই ভালো লেগেছে, কিন্তু সেটা আর ভালোবাসাতে রূপান্তরিত হয়নি। চিত্রাদের ফ্যামেলি একটু অন্যরকম, এখানে মেয়েদের পছন্দের কোনো গুরুত্ব নেই। বাবা-মা যাকে পছন্দ করবে তাকেই মেনে নিতে হবে। হঠাৎ চোখ চলে যায় রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটার দিকে। ছেলেটি আজও বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে, পরনে সাদা শাট, চুলগুলো এলোমেলো। প্রায়ই এ সময়টাতে ছেলেটিকে দেখে ও। কোথায় থাকে, কী নাম কিছুই জানা নেই। মাঝে মাঝে চিত্রার খুব আপন মনে হয় ছেলেটিকে। ওর ইচ্ছা হয় এলোমেলো চুলগুলোকে সুন্দর করে আঁচড়ে দিতে। কেন এমন হয় সেটা বোঝার মতো বয়স চিত্রার হয়েছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলার মতো সাহস এখনও হয়নি। ঘরের ভেতর থেকে কাশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। চিত্রার বাবার বুকের ব্যথাটা সম্ভবত আবার বেড়েছে। এখনই যেতে হবে, চোখ দুটি বড় বড় করে তাকায় ছেলেটির দিকে। অসম্ভব ভালো লাগে ওর হাসিটাকে, যেন প্রকৃতির একটা অংশ। ভেতর থেকে মা গলা ছেড়ে ডাকে চিত্রা, এই দিকে আয়।
২.
ভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে অনেক খোঁজে ছেলেটিকে, কিন্তু পায় না। তারপরও আজ কিছুক্ষণের জন্য গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, অহেতুক সময় কাটানো ছাড়া কিছু করার নেই। আবার পরক্ষণেই মনে হলো, দাঁড়িয়ে থেকেই বা লাভ কী? ছেলেটির সঙ্গে তো আর কথা বলা যাবে না। সামনের ফার্মেসিতে বসে থাকা লোকটা বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত ওপরে উঠতে গেল চিত্রা। পা ফসকে গেল। চিৎকার দেওয়ার আগেই দেয়ালের সঙ্গে খুব জোরে ধাক্কা খেলো। তারপর আর কিছু মনে নেই ওর। যখন জ্ঞান ফিরল তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেছে। মাথায় ব্যান্ডেজ, বিছানার পাশে বসে আছেন মা, হাতে তসবি। একটা কাশি দিয়ে চিত্রার বাবা ঘরে ঢুকলেন। এসেই শাসনের ভঙ্গিতে বললেন, কী হয়েছিল বলত তোর? তিনতলার রোকেয়ার মা না দেখলে তো আজ সর্বনাশ হয়ে যেত। চিত্রার মা নিচুস্বরে বললেন, তুমি থামো তো, মেয়েটাকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। বাবা চলে গেলেন পাশের ঘরে। চিত্রা উঠে বসল বিছানায়। মা হাত নাড়িয়ে বললেন, উঠছিস কেন, গরম দুধ করে আনছি খেয়ে ওষুধ খাবি। চিত্রা ঠিক আছে। মা চলে গেলেন কিচেনে। চিত্রা আস্তে আস্তে উঠে বারান্দায় গেল। পুরো শরীর যেন ঝিম মেরে আছে ওর। বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখল ছেলেটি বন্ধুদের সঙ্গে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ দু'জনের চোখাচোখি হয়ে গেল। এতদিন চিত্রা একাই ছেলেটিকে দেখেছে। আজ প্রথম দুজন একসঙ্গে দুজনকে দেখল। লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল চিত্রা। তারপর যখন তাকাল তখন ছেলেটা আর নেই, রাস্তার বাঁক ঘুরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
৩.
ছেলেটির সবকিছুই ভালো লাগে কেবল শেষ মুহূর্তের সিগারেট খাওয়াটা ছাড়া। শাসন করতে ইচ্ছা করে খুব। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে চিত্রা। ছেলেটা এলো বন্ধুদের সঙ্গে। এসেই একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। রাগে গজগজ করতে থাকে চিত্রা। সিঁড়ি দিয়ে সোজা নিচে নেমে এলো, একেবারে চায়ের দোকানটার সামনে। ছেলেটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিত্রা বলল, আর কখনও সিগারেট খাবেন না। যদি খান তাহলে...! রাগে চিত্রার সুন্দর মুখ লাল হয়ে গেল। অপ্রস্তুত ছেলেটি মুখ ভর্তি ধোঁয়া আর বাইরে ছাড়তে পারল না, ভয়ে গিলে ফেলল। সঙ্গে থাকা বন্ধুদের অবস্থাও তাই। যেভাবে দ্রুত চিত্রা এসেছিল ঠিক সেভাবেই বাসায় ঢুকে পড়ল। পেছনে রোবটের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইল ছেলেটি।
রাতে খাবার টেবিলে চিত্রার বাবা জানালেন চিত্রাকে দেখতে আগামী সপ্তাহে ছেলে পক্ষ আসবে। ব্যবসায়ী ছেলে মেয়েকে সুখী রাখবে, বুঝলে চিত্রার মা। চিত্রা কিছুই বলল না, মনের কোথাও যেন কষ্টের বৃষ্টি নামছে। বাইরে থেকে সেই বৃষ্টি দেখা যায় না, অনুভব করতে হয়। কিছু না খেয়ে উঠে গেল। নিজের রুমে গিয়ে অনেক করে ভাবতে লাগল। সেলফোনটা হাতে নিল, মিলিকে বিষয়টা জানানো উচিত। আবার ভাবল যদি ও সবাইকে বলে দেয়। চিত্রার বড় বোনেরও বিয়ে হয়েছে বাবার দেখা পাত্রের সঙ্গে। সুখে আছে, স্বামী ডাক্তার, মাঝে মাঝে আসে। চিত্রার বেলাতেও এমনটা ঘটবে, সেটা জানা কথা; কিন্তু মাঝখানে ছেলেটি এসে সব এলোমেলো করে দিল। সারারাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি চিত্রা। সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটিকে সব বলে দেবে। তারপর যা হওয়ার হবে। দেখা যাক ভাগ্যে কী আছে ওর। সেদিনের ঘটনার পর থেকে চিত্রা খেয়াল করল, ছেলেটি আর চা খেতে আসে না। প্রথমে ভাবল হয়তো শরীর খারাপ, কিন্তু কয়েক দিন কেটে যেতেই চিত্রার খারাপ কিছু মনে হতে লাগল। কথাগুলো যে ছেলেটিকে বলা প্রয়োজন খুব। ছেলেটি না এলেও সঙ্গের কয়েকটি বন্ধু প্রায়ই আসত। একদিন সাহস করে চিত্রা মুখোমুখি হয় ওদের। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারল ছেলেটির নাম রাতুল। কাছের এক হোস্টেলে থাকত, প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়াশোনা করত সবাই একসঙ্গে। দুদিন হলো ছেলেটি স্কলারশিপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। কথাটা শুনে কতটা খারাপ লেগেছে তা চিত্রা কাউকে বোঝাতে পারবে না। যেভাবে নীরবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই নীরবে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। বারান্দার শিক ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ভালোবাসি শব্দটি বলার আগেই মানুষটি হারিয়ে গেল। পেছন থেকে মা এসে বললেন, কাল ছেলে পক্ষ আসবে তোমায় দেখতে। চিত্রা কিছুই বলল না, চুপ করে রইল।
এরপর প্রতিটি বিকেল আসে পবিত্র হয়ে, কিন্তু ছেলেটি আর আসে না। খুব মিস করে চিত্রা ছেলেটিকে। ভালোবেসে যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে। হয়তো একই আকাশের নিচে এখনও দু'জন আছে তাই। চিত্রার ইচ্ছা করে চিৎকার করে বলতেথ আকাশের ওই সুখের মানচিত্রটা তোমার জন্য, আমার ডায়েরির পাতার সব আবেগ-কল্পনা তোমার জন্য, তোমাকে না বলতে পারা ভালোবাসি নামক এই গল্পটা তোমার জন্য।