প্রকাশ : ১১ জুলাই ২০২৩, ০০:০০
সারা পৃথিবীতেই শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করেন শিক্ষকরা। নার্সারি থেকে সর্বোচ্চ শিক্ষা এবং উচ্চতর গবেষণা পর্যন্ত পরিচালিত হয় শিক্ষকদের তত্ত্বাবদানে। সুতরাং শিক্ষক ছাড়া কোনো শিক্ষাকার্যক্রমই চলতে পারে না। এই শিক্ষকদের মধ্যে রকমফের আছে। কেউ অতি উত্তম শিক্ষক, কেউ উত্তম শিক্ষক, কেউ মাজারি মানের শিক্ষক এবং কেউ বা নিম্নমানের শিক্ষক। আর শিক্ষকদের এই মানের ওপর নির্ভর করে গুণগত শিক্ষা। এখন খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ভালো শিক্ষক বা সর্বোত্তম শিক্ষক বলতে আমরা কী বুঝি? এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের পাণ্ডিত্য অর্জনের দরকার নেই। আপনার স্কুলপড়ুয়া শিশুকে জিজ্ঞেস করুন, ‘তোমার প্রিয় শিক্ষকের নাম কী?’ অবলীলায় সে তার প্রিয় শিক্ষকের নাম বলে দেবে। তার পরে যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘ওই শিক্ষক কেন তোমার প্রিয়?’ তাহলে শিশু কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। কারণ শিশুদের মনের গড়নটাই এমন যে, সে মনে করে, প্রিয় তো প্রিয়ই, তার আবার ‘কেন’ থাকবে কেন! তবুও এই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যেই সে বলতে চেষ্টা করবে, ওই শিক্ষক ক্লাসে খুব ভালো বোঝান, রাগ করেন না, চিৎকার-চেঁচামিচি করেন না, খুব আদর করেন। দুষ্টুমি করলে বকেন।
এভাবে আপনি আপনার শিশুর কাছ থেকেই ভালো শিক্ষকের বা সর্বোত্তম শিক্ষকের কিছু বৈশিষ্ট্য পেয়ে যাবেন। আর যদি ওই শিশুকেই আপনি জিজ্ঞেস করেন, ক্লাসে তোমার সবচেয়ে অপছন্দের শিক্ষকের নাম কী? এবারও সে বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। কারণ শিক্ষককে অপছন্দ করার বোধ তার মধ্যে তৈরি হয়নি। সে শুধু পছন্দ করতেই শিখেছে, ভালোবাসতেই শিখেছে। তবুও সে একটি বা দুটি নাম বলবে। এবারও যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন, ওই শিক্ষক তোমার অপছন্দের কারণ কী? তাহলে আগে যে কথাগুলো সে বলেছিল, সেই কথাগুলোই উলটো করে বলবে, ওই শিক্ষক ভালো পড়াতে পারেন না, ক্লাসে খুব রাগারাগি করেন, খুব চিৎকার-চেঁচামিচি করেন এবং তাদের মাঝেমধ্যে শাস্তিও দেন। এখান থেকেও বোঝা যায় যে, একজন খারাপ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্যগুলো কী।
ভালো শিক্ষক ও খারাপ শিক্ষকের সঙ্গে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের সম্পর্কের অনুপাত নির্ধারিত হয়েছে পৃথিবীর অনেক তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণায়। ১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসে উইলিয়াম এল সেন্ডার্স এবং জন সি রিভার্স ‘কমুলেটিভ অ্যান্ড রিসিডুয়াল ইফেক্টস অব টিচার্স অন ফিউচার স্টুডেন্ট একাডেমিক এসিভমেন্ট’ বিষয়ে একটি গবেষণা করেন। ওই গবেষণায় তারা দেখিয়েছেন, সাধারণ মানের দুজন শিক্ষার্থীকে যদি ভালো ও খারাপ শিক্ষকের নিকট শিখন-শেখানো কার্যক্রমে পাঠানো হয়, তাহলে তিন বছরে তাদের সামগ্রিক ফলাফলের মধ্যে ৫০ ভাগ ডিভিয়েশন বা তারতম্য সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী অন্যজন থেকে কৃতিত্বের মাপকাঠিতে ৫০ ভাগ পিছিয়ে পড়বে। তারা আরও দেখিয়েছেন, শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের ওপর শিক্ষকদের প্রভাব একদিকে যোজনীয় (additive) এবং অন্যদিকে ক্রমবর্ধিষ্ণু (cumulative)। অর্থাৎ শিক্ষকের প্রভাবে একদিকে শিক্ষার্থীর ওপর কিছু সদগুণাবলি সংযুক্ত হয় এবং অন্যদিকে ওই গুণগুলো বিস্তৃত হতে থাকে।
ভালো শিক্ষকদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় কোন শিক্ষার্থীরা? এর জবাবে অনেকেই বলবেন, ভালো বা মেধাবী শিক্ষার্থীদের কথা। কিন্তু ওই গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভালো শিক্ষকদের সান্নিধ্যে সব শিক্ষার্থী উপকৃত হলেও সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় দুর্বল শিক্ষার্থীরা এবং এই শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের পরিমাণও অধিক। এই পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে তাপর্যপূর্ণ।
এই যে ভালো শিক্ষকের কথা বলা হলো, তার কি কোনো সুনির্দিষ্ট গুণাবলি আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে অধিকাংশ গবেষণায় মিশ্র পর্যবেক্ষণ ও অভিব্যক্তি পাওয়া গেছে। প্রথমত, একজন শিক্ষক একটি দেশের ভৌগোলিক সীমানায় ও তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ধর্মীয় পটভূমিতে শিক্ষকতা করেন। এই পটভূমি নিঃসন্দেহে ইউনিক। সুতরাং গুণগত শিক্ষা এই পটভূমির ওপর নির্ভশীল হলেও ব্যক্তি-শিক্ষকের ওপর এর উৎকর্ষ অনেকাংশে নির্ভর করে।
শিক্ষকতার পেশা আর দশটি চাকরির মতো নয়। এখানে তিনি অন্য চাকরির মতো কোনো দাপ্তরিক কাজকর্ম করেন না, কোনো নথিপত্র নিয়েও তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় না, নাগরিকদের সেবা প্রধানের বিষয়ও এখানে নেই। শিক্ষককে কাজ করতে হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। এই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ প্রতিবছরই নতুন এবং আরেকটি অংশ বিদ্যালয় থেকে বিদায় নেয়। সুতরাং শিক্ষককে প্রতিনিয়ত একটি প্রাণবন্ত ও প্রচণ্ড গতিশীল তরুণ জনসমাজের সঙ্গে কাজ করতে হয়। অনিবার্যভাবেই একজন শিক্ষককে প্রবল প্রাণশক্তির অধিকারী হতে হয় এবং জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে, বিদ্যাবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে তাকে প্রতিনিয়ত হালনাগাদ থাকতে হয়। তিনি প্রতিনিয়ত মুখোমুখি হন কোমলমতি তরুণ-তরুণীদের, যাদের কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, জীবনাকাঙ্ক্ষা ও জীবনতৃষ্ণা প্রবল। এই তরুণ জনগোষ্ঠী খুবই স্পর্শকাতর, আবেগপ্রবণ, সহজ-সরল এবং মনোদৈহিক দিক থেকে প্রচণ্ড রকম চঞ্চল। এদের সামাল দেয়া এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি প্রত্যয়নিষ্ঠ করে তোলা দুর্বল শিক্ষকদের দ্বারা সম্ভব নয়। এবং যেসব শিক্ষক এই তরুণ প্রজন্মের মনোদৈহিক অবস্থার সঙ্গে পরিচিত নন, যারা এদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে অক্ষম এবং যারা এদের যথার্থ সম্মান, মর্যাদা, স্নেহ, ভালোবাসা ও তাৎপর্যপূর্ণ শাসন করতে পারেন না, তারা কিছুতেই এদের জন্য কার্যকর কোনো কৃতিত্ব বয়ে আনতে পারেন না। সুতরাং একজন শিক্ষক এদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য এবং সর্বতোভাবে সুনাগরিক হিসেবে তৈরি করার জন্য নিরন্তর নিজেকে প্রস্তুত রাখেন।
নানা রকম গবেষণায় এই প্রস্তুতির বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথমেই হলো শিক্ষকের যোগাযোগ ক্ষমতা। বিষয়জ্ঞান থেকে শুরু করে বিদ্যায়তনিক জীবনে একজন শিক্ষককে তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হয়। এমনটা আর কোনে পেশায় নেই। এই যোগাযোগ যেমন ক্লাসরুমের ভেতরে, তেমনি ক্লাসের বাইরে। যে শিক্ষক ওই পরিস্থিতিতে প্রযোজ্য যোগাযোগব্যবস্থা যতটা সাফল্যের সঙ্গে নির্বাহ করতে পারেন, তিনি শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব অর্জনে তত বেশি সফল।
আমাদের দেশে অধিকাংশ শিক্ষক অনেক কথা বলেন। ক্লাসরুমের ভেতরে কথা বলেন, ক্লাসের বাইরে কথা বলেন। ফলে শোনার ক্ষমতা তাদের অনেকাংশেই লোপ পায়। তারা শুধু বলতে চান, শুনতে চান না। কিন্তু ভালো শিক্ষকের কার্যকর বলার ক্ষতার মতো নিবিড়ভাবে শোনার দক্ষতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্লাসরুমের ভেতরে তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কথা শুনবেন এবং ক্লাসরুমের বাইরেও প্রতিমুহূর্তে তিনি শিক্ষার্থীদের কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকবেন- এই গুণ একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের নিকট মহৎ মানুষে এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে।
ব্যক্তি-শিক্ষার্থী খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আজকের যুগে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একজন আলাদা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সেই বিবেচনার পটভূমিতে তাকে মূল্যায়ন করা হয়। এই অভিজ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একজন শিক্ষককে মনে রাখতে হয় যে, কোলাবোরেশন বা যুথবদ্ধ প্রচেষ্টার ভেতর দিয়েও ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব। দুই বা ততোধিক শিক্ষার্থী মিলে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিমত্তা ও সহযোগিতার মাধ্যমে কোনো কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করার দক্ষতাও একজন ভালো শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কেননা বাস্তব জীবনে আমাদের প্রত্যেককেই প্রতিনিয়ত অন্যের সঙ্গে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে হয়। এবং এ সময় কাজের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ তৈরি হয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরি হয়।
একজন শিক্ষককে প্রতিনিয়ত নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। নতুন যে শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হয় তাদের ক্লাস থেকে শুরু করে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের অনেক পরিস্থিতি একজন শিক্ষকের কাছে নতুন মনে হওয়ার স্বাভাবিক। এই নতুন পরিস্থিতিতে শিক্ষক তার সহজাত মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে চমৎকারভাবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি নতুন শিখন-শেখানো সংস্কৃতি তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্মগত ব্যবধান সব সমাজেই থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে প্রজন্মগত এই ব্যবধান একটি বাস্তব ঘটনা। কিন্তু সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে এই ব্যবধান নানা রকম দুর্গতি সৃষ্টি করলেও বিদ্যায়তনিক জগতে প্রজন্মগত ব্যবধান থাকা কিছুতেই উচিত নয়। কারণ, বিদ্যালয়ে যদি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রজন্মগত ব্যবধান থাকে তাহলে শিখন-শেখানো কার্যক্রম অচল হয়ে পড়বে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের খুব ভালোভাবে অনুধাবন করার, তাদের অনুভূতিগুলোকে বোঝার এবং তাদের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করার যোগ্যতা থাকতে হয়। যে শিক্ষকের এই সহমর্মিতা যত বেশি, তিনি তত ভালো শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। শিক্ষককে সহনশীল হতে হয়। তিনি কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেজাজ হারাবেন না- এ হলো একজন ভালো শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কারণ, এ ধরনের শিক্ষকরা ভালো করেই জানেন যে, নানা রকম পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মনের গড়ন, আচার-আচরণ, রুচিবোধ, কথা বলার ধরন ও ব্যবহার মোটেই এক রকম নয়। কারও কারও আচরণ খুবই বিরক্তিকর ও বেয়াদবি বলে মনে হতে পারে। এমন ক্ষেত্রেও শিক্ষককে মাথা ঠান্ডা রেখে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার যোগ্যতা থাকতে হয়। যে শিক্ষক এমন কোনো বিরূপ পরিস্থিতির ভেতরেও নিজেকে ঠান্ডা রেখে শিক্ষার্থী-সংশ্লিষ্ট ওই সব পরিস্থিতিকে সুষ্ঠুভাবে সামাল দিতে পারেন, তিনি উত্তম শিক্ষক হিসেবে পরিগণিত হন।
এই শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি হলো, জীবনভর শিক্ষার মধ্যে নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। জীবনভর শিক্ষা একজন শিক্ষককে পেশার প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল ও আকর্ষণীয় করে তোলে। বিচিত্র বিষয়ে তিনি যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, সেই প্রশিক্ষণ কী করে শিখন-শেখানো কার্যক্রমে ফলিয়ে তোলা যায়, তার চেষ্টা করেন একজন ভালো শিক্ষক। এভাবে গুণগতভাবে সমৃদ্ধ শিক্ষকই গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন। এর কোনো বিকল্প নেই।