প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০
সালাম রিকশা চালায় সেই কৈশোরকাল থেকেই। সেদিন সন্ধ্যা থেকে, যেদিন ওর বাবা মারা গেছেন। ঘরে চাল, ডাল ছিলোনা। দিন আনে দিন খায় ওরা। বাবার কাফনের কাপড় কেনার টাকা ছিলোনা। এজন্য, রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলো কাপড় কেনার টাকা জোটানোর জন্য। বাবা বেঁচে থাকতে রিকশা চালাতে দিতোনা। বারবার বলতেন, "আমার মতো তোদের ভাগ্যেটা যেন না হয়। "
তবুও বাবার চোখ এড়িয়ে শখ করে কখনো কখনো রিকশা চালাতো। সেই শখটাই আজ দায় হয়ে গেছে ওর। দুই ছেলেমেয়ে আর ওদের মায়ের মুখের অন্ন জোগাতে রোজ ভোরবেলায় রিকশা নিয়ে পথে নামা। শীত হোক, বৃষ্টির দিন হোক, হোক বা মধ্যরাত, সালামকে রিকশা চালাতেই হয়। শরীর সুস্থ থাকুক আর নাই থাকুক, ক্ষুধা ঠিকই বাড়ে, সাথে মনের কষ্টও। অসংখ্য অপূর্ব চাহিদার কষ্ট। অবস্থাপন্নদের সন্তানদের স্কুলে যেতে দেখলে, নিজের সন্তানদের জন্য আফসোস হয়। নিজের ভাগ্যেকে দোষ দেয় শুধু।
প্রতিদিনের মতো আজও প্রায় মধ্যরাতে রিকশা নিয়ে ঘুরছে সালাম। একজন যাত্রী দেড় কিলোমিটার যাবেন বলেছেন। সালাম রাজি হলো। হারিকেনটি রিকশার নিচে বাধা আছে। আল্লাহর নাম নিয়ে প্যাডেলে চাপ দেয় ও। ঠিকমতো পৌছে দিতে পারায় যাত্রীটি খুশি হয়ে ১০ টাকা বেশি দেয়। সালাম আবার ঘুরতে থাকে মিশন রোড ধরে। দুজন লোক রাস্তার ওপাশ থেকে যেন হাত নেড়ে ডাকছে সালামকে। সালাম ভাবলো হয়তো কোথাও যেতে চান ওনারা। কাছে গিয়ে দেখলো, দুইজন কালো কোর্ট পরা লোক। হাতে বড় একটা ব্যাগ একজনের। আরেকজনের হাতে ছোট আরেকটা ব্যাগ। একজন গম্ভীর গলায় বললেন, "যদি আমাদের এই ছোট ব্যাগটা একটা ঠিকানায় পৌছে দিতে পারো, তাহলে বড় ব্যাগের সব টাকা তোমার। "সালাম গরীব হলেও অনেক সৎ এবং আত্মমর্যাদাবান। সবসময়ই ও ভাবে, যতদিন বেঁচে থাকবে, খাবার খেয়ে থাকুক বা না থাকুক, অনাহারে মরে গেলেও লোভী হবে না। লোকটিকে সালাম প্রশ্ন করলো, "কেন ভাই? আপনারা কি পাঠাতে চান এই ব্যাগে করে? কী আছে এতে?মাদক বা অস্ত্র-সস্ত্র নেই তো? আমার টাকা চাইনা ভাই, ন্যায্য ভাড়া দিবেন, আপনারা যদি কোথাও যেতে চান, তাহলে আমি রিকশায় করে পৌছে দিতে পারি। ‘দুইজন লোক আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা বললো। তারপর একজন বললেন, ‘তুমি এতো সৎ! এ যুগেও এতো সৎ মানুষ আছে, ভাবতেও পারিনি। আচ্ছা, আমাদের পৌঁছে দাও। পথ বলে দেবো আস্তে আস্তে। ‘সালাম রাজি হলো। সালাম রিকশা চালাচ্ছে। দুইজন লোক ডানে বামে বলে দিচ্ছে। প্রায় আধ-ঘণ্টা পর, একটা কাঁচা পথের ধারে ওনারা নামতে চাইলেন। দু’জনে সালামের হাতে টাকা গুঁজে রেখে দিয়ে দ্রুত নেমে গেলেন। সালাম হঠাৎ খেয়াল করলো, ওই দুজন লোক তাদের বড় ব্যাগটা রেখে চলে গেছেন, তাই ওনাদের ডাকতে লাগলো পিছন থেকে। কাঁচা সড়ক দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন তারা। সালাম রিক্সা রেখে হাতে ব্যাগ নিয়ে ওনাদের ডাকতে ডাকতে পিছু পিছু যাচ্ছে। ভীষণ অন্ধকার রাস্তা, তবুও অনেকটা পথ চলে এসেছে সে। লোক দুটো সাড়াই দিচ্ছে না। সামনে কিছুই দেখা যায় না এতো অন্ধকারে, তাই থমকে দাঁড়ালো সালাম। হঠাৎ, ক্ষীণ আলোয় দুজন লোকের একজন লোক বলতে লাগলো, "তুমি সৎ, এইসব টাকা তোমার পুরস্কার। তোমার সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে দিও। আর পূর্ণ করো তোমার অপূর্ণ ইচ্ছে গুলো। ভালো থেকো তুমি।’
‘কে আপনারা? আমায় কেন শুধু শুূধু এতো টাকা দিতে চাচ্ছেন? আপনাদের টাকা চাই না আমার। আমার সন্তানদের কথা জানলেন কিভাবে?’
কালো কোর্ট ওয়ালা লোকটা উত্তর দিলো ‘আমরা অদৃশ্য শুভশক্তি, আর এই ছোট ব্যাগে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, ওই বড় ব্যাগে তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, টাকা। দুনিয়ায় চলতে যেটার খুব দরকার। তাইনা? কাফনের কাপড় কিনতেও।’
এসব শুনে সালাম হতবাক হয়ে রইলো। যখন ঐ লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেলো ওর সামনে, সালাম মুহূর্তেই তার চেতনা হারালো।
চোখ খুলে দেখলো সকাল হয়ে গেছে। আর রিকশার পাশে বড় ব্যাগটার উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। কাল রাতের কথা মনে পড়তেই উঠে বসলো সে। দেখলো, কাঁচা সড়ক বলতে কিছুই নেই। কিন্তু কাল রাতে তো ওই দুজনের পিছু পিছু অনেকক্ষণ হেঁটেছিলো। পরিষ্কার মনে আছে ওর। ব্যাগ খুলে দেখলো ব্যাগ ভর্তি টাকা আর টাকা। আল্লাহ কে ধন্যবাদ দিলো সালাম। বাড়ি ফিরলো আরো একঘণ্টা রিকশা চালিয়ে। ওর স্ত্রী সন্তানরা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে ওর জন্য। টিনের ঘরের দরজায় টোকা দিতেই ওর স্ত্রী তাড়াতাড়ি দরজা খুললো। স্ত্রী কে সব বললো সালাম। খুশিতে গদগদ হয়ে বারবার আল্লাহর শুকরিয়া জানাতে লাগলো ওরা।
প্রায় একমাস পর, এখন আর সালাম রিকশা চালায়না। ওর সন্তানরা এখন নিয়মিত স্কুলে যায়। শুধু ওর সন্তানরা নয়, বাকি রিকশাওয়ালাদের সন্তানরাও স্কুলে যায়। সালাম এখন অনেক টাকার মালিক। একটা কারখানা চালায় সে। অনেকেই কাজ করে ওর কারখানায়। সালামের অবস্থা বদলে গেলেও ওর সততা এখনো আছে। অদৃশ্য শক্তির ঐ দুইলোকের জন্য অনেক দোয়া করে প্রতিদিন। মধ্যরাতে অচিনপথে সালাম সৌভাগ্যের দিশা পায়। লোক দুটি ওর জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছে। এতেই ও খুশি।