প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
একজন শিশুর সমগ্র শিক্ষাজীবনে তার সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নিত্যসঙ্গী হচ্ছে তার স্কুল ব্যাগ। স্কুলের ব্যাগটি নিজে পছন্দ করে কিনলেও মার্কিন কনজ্যুমার প্রোডাক্ট সেফটি কমিশনের তথ্য মতে, প্রতি বছর ১৪০০০ এরও বেশি শিশু ভারী স্কুল ব্যাগের কারণে ইনজুরির শিকার হয়। যখন একটি শিশু সবেমাত্র জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করে তখনই তার পিঠে চাপিয়ে দেওয়া হয় রাজ্যের বোঝা। তখন আর প্রিয় স্প্রাইডার ম্যান বা ফ্রোজেনের ব্যাগটি ভালো লাগে না কারও। প্রিয় ব্যাগটি হয়ে উঠে বোঝা, যার জন্য শিশু মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। আর শিশুদের এই পিঠের বোঝাটাই হয়ে উঠেছে আমাদের 'ভবিষ্যতের বোঝা '। যাদের সাজিদণ্ডসৌরদীপের মতো কিংবা নীল আর্মস্ট্রং-এর মতো বিশ্বসেরা হওয়ার কথা, সেইসব 'ব্যাগবোঝাই' কচিকাঁচারা 'গিনিপিগ' হচ্ছে 'বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই' বানানোর ল্যাবরেটরিতে। ভারী স্কুল ব্যাগ নতুন প্রজন্মকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে শরীরে ও মনে।
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্যারন জেকবস মনে করেন, ভারী স্কুল ব্যাগ অস্বস্তি, অবসাদ, কাঁধে ও মেরুদণ্ডের ব্যথার ঝুঁকি তৈরি করে। চিকিৎসকদের মতে, শরীরে ভারী স্কুল ব্যাগ সরাসরি প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে শিশুর মেরুদণ্ডের গঠনে প্রভাব ফেলার পাশাপাশি শিশুর মেরুদণ্ডে দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা ও ইনফেকশনের জন্য ভারী স্কুল ব্যাগ অনেকাংশে দায়ী। এই ব্যাকপেইন গুলো থেকেই শুরু হয় ক্রনিক ব্যাকপেইন। তাছাড়া, প্রতিনিয়ত ভারী স্কুল ব্যাগ বহনের ফলে শিশু মানসিক বিষাদে ভোগে ও লেখাপড়ার প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
আমেরিকার একাডেমি অব অর্থোপেডিক সার্জনের মতে, শরীরের মোট ওজনের ১০-১৫ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ কোন ভাবেই শিশুদের বহন করতে দেওয়া যাবে না। তা না হলে দিল্লির 'বরুণ জৈন'-এর মতো কাঁধের প্রকাণ্ড স্কুল ব্যাগের চাপে প্রাণ দিতে হবে আরও অনেক শিশুর। কিংবা ইস্কাটনের এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কেজি ক্লাসের শিশুটির মতো আরও অনেক শিশু ব্যাগের ভারে নামতে পারবে না দ্বিতীয় তলা থেকে নিচতলায়।
প্রাইমারি লেভেলের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিশুকে চৌদ্দ -পনেরটি বই নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়। তার সাথে খাতাণ্ডকলম সহ রয়েছে ভারী পানির বোতল। স্কুলের পর আবার কোচিং এর বই-খাতা। একটি বাচ্চার ওজনের চেয়ে ব্যাগের ওজন হয় বেশি। এটা কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা?
বাংলাদেশ হাইকোর্ট শিশুদের ভারী স্কুল ব্যাগ বহনে নিরুৎসাহিত করতে ও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুদের ভারী স্কুল ব্যাগ বহন নিষিদ্ধ করতে ২০১৫ সালে একটি আইন প্রণয়ন করলেও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ আজ পর্যন্ত দেখা যায় নি।
কিন্তু স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিলে শিশুদের সমস্যা হয় বললেও তো আর স্কুল ব্যাগ বাদ দেয়া যাবে না। ব্যাগের ওজন কমাতে হবে। শিশুদের পিঠের বোঝাটিকে হালকা করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে-
(১) অনেকে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের জন্য আলাদা করে খাতার ব্যাবস্থা করে। সেগুলো ভারী করে তুলে স্কুল ব্যাগটিকে। সব বিষয়ের জন্য আলাদা খাতার ব্যবস্থা না করে একটি খাতার ব্যবস্থা করা, আবার সব বিষয়ের বাড়ির কাজের জন্য একটি খাতার ব্যবস্থা করা।
(২) প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে রুটিন দেখে প্রয়োজনীয় বই খাতাগুলো নিয়ে যাওয়া।
(৩) স্কুল ও কোচিং এর সব বই-খাতা এক ব্যাগে নিলে ব্যাগের ভার বেড়ে যায় কয়েকগুণ। যদি স্কুল ও কোচিং এর জন্য আলাদা ব্যাগ ব্যবহার করা যায় তাহলে ব্যাগের ওজন অনেকাংশে কমে যায়।
(৪) শিশুদের স্কুল ব্যাগ বা বই খাতা রাখার জন্য স্কুলে আলমারির ব্যবস্থা রাখা উচিত।
(৫) অনেক শিশু এক কাঁধে ব্যাগ বহন করলে কাঁধে ও মেরুদন্ডে বেশি চাপ পড়ে। তাই স্কুল ব্যাগ দুই কাঁধে নেয়ার জন্য শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে।
(৬) আমাদের দেশের অনেক বিদ্যালয়ে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নেই। স্কুল ব্যাগে পানির বোতল নিলে ব্যাগের ওজন কিছুটা বেড়ে যায়। স্কুলে বিশুদ্ধ পানির ব্যাবস্থা করলে শিশুদের আর পানির বোতল বহন করতে হবে না।
(৭) স্কুল ব্যাগ কেনার সময় হালকা ওজনের ব্যাগ কেনার চেষ্টা করা।
(৮) বিদ্যালয়ের পাঠদানের ক্ষেত্রে পাঠ্যবইয়ের বদলে যথাসম্ভব ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
(৯) কোন্ বয়সে, কোন্ উচ্চতায় সর্বাধিক কত ওজনের স্কুল ব্যাগ বহন করা উচিত তা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য সরকারকে একটি কার্যকরী আইন প্রয়োগ করতে হবে। চিকিৎসকদের মতে ক্লাস অনুযায়ী শিশুদের ব্যাগের ওজন হওয়া উচিত -
১ম ও ২য় শ্রেণী-১ কেজি
৩য় ও ৪র্থ শ্রেণী-২ কেজি
৫ম থেকে ৭ম শ্রেণী-৪ কেজি
৮ম ও ৯ম শ্রেণী-৫কেজি
১০ম -১২ শ্রেণীর -৬কেজি।
ওহে মহামান্য রেসে ঘোড়া অভিভাবক, এবার তুমি থামো। ওহে অসামান্য রাষ্ট্র, এতদিন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, এবার তুমি জাগো। ওহে শিক্ষার দোকানিরা, এবার তোমাদের দোকানপাট একটু সাড়াই কর। তোমাদের সন্তানরা রাত শেষ হওয়ার প্রতীক্ষায়। বই পড়তে পড়তে, কাঁধের বোঝা বইতে বইতে শিশুরা আজ বড্ডো পরিশ্রান্ত। শিশুকে শুধু বিদ্যার সাবমেরিন বানানোর স্বপ্নে বিভোর না থেকে ওর পিঠের বোঝাটাকে হালকা করার কথা ভাবো। স্কুল কর্তৃপক্ষ তোমার টনকটা এবার নাড়াও, রাষ্ট্র এবার তোমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবো, বাবা-মা এবার তোমার সন্তানের পিঠের উপর যে বোঝা চাপিয়েছ তার পেট হালকা কর। কোনো শিশুকে যেন আর বলতে না হয়-
''স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী
আমরা কী আর বইতে পারি?"