প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৪
মোজগান ফারামানেশ-এর কবিতা

যদি না প্রেমিক হও
যদি না হও এক নিমগ্ন প্রেমিক
বৃষ্টির স্নিগ্ধতা ছোঁবে না তোমায়
জানবে না-খাঁচা আর পথের ফারাকযদি না হও প্রেম-উন্মাদ
শহরের পথ বেঁয়ে হেটে যাবে অবিরাম
শুনবে না-ঝরাপাতার আর্তনাদ।যে হৃদয়ে প্রেম নেই-- বর্ণহীন এক সত্তা
বোঝে না চোখের ভাষা
দেখে না মানুষের বিষাদ চোখ!কবিতার ভাঁজে লুকানো এক পৃথিবী
নির্বাক ভাষার কথামালা
দুর্বোধ্য থেকে যাবে-
যদি না হও প্রেমিক।যদি না হও এক নিমগ্ন প্রেমিক-
শরতের দাহ, বসন্তের গান-নিষ্ফল,
কিংবা নিঃসঙ্গ শীতের বিমূর্ততা
থেকে যাবে তোমার অচেনা!আগলে রাখি গহীনে
করতল জুড়ে ধরে রাখি এক নিঃশব্দ স্বর্গ
তোমার ছায়া জড়িয়ে এক বিস্তীর্ণ পৃথিবী
আমার এই পথচলা-—বিলীন করে না আমায়
নাম ও খ্যাতির মুখচ্ছবি
রেখে দেই আঙুলের রেখায়।রাত্রির কালো আয়নায় নিজেকে দেখি-
বিধ্বস্ত কোলে রঙধনু ঘুমায়।
কেঁদে উঠি ধ্বংসের ছাই দেখে
মগজের অন্তঃপুরে পড়ে আছে
ধূলিধূসর জিন্দা জান-
পৃথিবীর ভুলে যাওয়া মুখ।ছিটকে পড়েছি মানচিত্র থেকে—
বিচ্ছিন্ন-বিরান এক বিন্দুতে
তবু বিস্তৃত বুক বয়ে বেড়ায়
আদি-অনন্ত উপাখ্যান।নির্বিকার পড়ে আছি-ভয়ের শহরে
এখানে দুঃস্বপ্ন জেগে থাকে
বেজে উঠে অগণিত নারীর আর্তনাদ!নামহীন অস্তিত্বে জেগে থাকি,
তবু আমি-এক নিঃশব্দ আফগানিস্তান
নিজেকে নিজেই বুকে জড়িয়ে রাখি!হয়তো আরেকবার
একদিন সবুজ ফিরবে আবার
নোনা জলের স্রোত মাড়িয়ে
ফোটাবে নতুন কুঁড়ি-
আমাদের বিষণ্ণ বুকের পাটাতনে।যদি একবার বৃষ্টি নামে-
এই পিপাসার্ত রৌদ্রদগ্ধ প্রান্তরে,
নিশ্চুপ স্রোত জেগে উঠবে উদ্দাম নৃত্যে!হয়তো আমরা বেঁচে থাকি —
ঘুমন্ত স্ফিংস জাগবে বলে
একদিন উবে যাবে এই শ্বাসরোধ-দহকালআমরা সেই বিষণ্ণ-বিপন্ন বইয়ের পাতা
পড়েনি দুনিয়া অবহেলায়
অথচ কেটে গেছে শতাব্দী অবলীলায়!হয়তো একদিন-বেজে উঠবে সেইসব গান
ফোটাবে ফুল আমাদের রক্ত সরোবরে,
আমাদের সমাধি ছুঁয়ে যাবে গোলাপের ঘ্রাণ।কবি পরিচিতি : মজগান ফারামানেশ আফগানিস্তানের খ্যাতিমান কবি ও সাংস্কৃতিক কর্মী—১৯৯০ সালের ২৩ আগস্ট হেরাত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০১৪ সালে হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি-দারি ভাষা ও সাহিত্য অনুষদ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে ইয়াজদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিষয়ে ছয় বছর ধরে গবেষণা ও চর্চা করে আসছেন। তিনি হেরাত সাহিত্য সংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবেও যুক্ত।
২০০৯ সাল থেকে কবিতাকে তিনি গ্রহণ করেছেন এক আত্মিক ও শিল্পিত দায়বদ্ধতা হিসেবে। নারীর দৃষ্টিভঙ্গি, ভালোবাসা, সমাজের অসংগতি ও বিদ্রূপ—এই সবই মজগানের কবিতায় গাঁথা থাকে এক অনাড়ম্বর কিন্তু গভীর ভাষায়। নিজেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ বা স্বনিয়ন্ত্রণমূলক সেন্সরের বেড়াজালে না ফেলে, তিনি শব্দকে ব্যবহার করেন মুক্তির উপকরণ হিসেবে-যেন শব্দের শরীরে গুঁজে দেন বিদ্রোহী নারীর আত্মজীবনী।
মোজগানের কবিতায় নারী শুধু বিষয় নয়-নারী নিজেই হয়ে উঠে ভাষা, বর্ণনা ও প্রতিবাদের আখ্যান। তাঁর কবিতাগুলোর প্রতিটি লাইনে নারীত্ব প্রবাহিত হয় এক মৃদু কিন্তু স্থায়ী বেদনার সুরে, যা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় নীরবে। এই বেদনা ও নারীত্বের মিশ্রণে গঠিত হয়েছে তাঁর কাব্যিক পরিচিতির অনন্যতা।
মোজগান ফারামানেশের কবিতা ইংরেজি, আরবি ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও বাংলাদেশে। তিনি মূলত ছন্দময় রচনার প্রতি আকৃষ্ট, বিশেষত গজল ও রুবাই ধাঁচে রচনা করেন অধিকাংশ কবিতা।
তাঁর কবিতা কেবল পঠিত নয়-দৃশ্যমানও হয়েছে। বহু ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে তাঁর কবিতা স্থান পেয়েছে। ২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া এবং ২০১৫ সালে নিউইয়র্কে তাঁর কবিতার চিত্রায়ণ নিয়ে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। একই বছর হেরাতে ‘নিঃসঙ্গতার ছায়া’ শীর্ষক একটি কাব্যচিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। তাঁর কবিতাকে কেন্দ্র করে সংগীতও রচিত হয়েছে, যা তাঁর কাব্যিক জনপ্রিয়তার আরেকটি দিক উন্মোচন করে।কবিতার সংকলন : Painful Thoughts (বেদনাদায়ক চিন্তাভাবনা) Blind Knot (অন্ধ গিঁট) Painful Reed (যন্ত্রণার বাঁশি) The Winds Scratched Throat (হাওয়ার ক্ষতবিক্ষত গলা), Four Walls (চার দেয়াল)— মাহজোবা হেরাভির কবিতা সংকলন, যা সংগ্রহ, সম্পাদনা ও ভূমিকা লিখেছেন ফারামানেশ। ছোটগল্প সংকলন : Ash Girls (ছাইয়ের মেয়েরা)








