প্রকাশ : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩
মটকা চায়ের কাব্য

আত্রাইয়ের শাহাগোলা বাজারের মটকা চায়ের দোকানটা শুধু স্থানীয়দের কাছে নয়, আশপাশের জেলা থেকেও আগত চায়ের সমঝদারদের কাছে এক তীর্থস্থানের মতো। সন্ধ্যায় ধোঁয়া ওঠা মালাই চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে রেললাইনের ধারে বসে গল্প করা, কিংবা নিছকই জীবনের হিসেব মেলাতে মেলাতে এক কাপ চায়ে চুমুক দেয়া এ যেন এক নিত্যদিনের ছবি। অনির্বাণ, স্থানীয় কলেজের প্রাণবন্ত ছাত্র, গত কয়েকমাস ধরে এ দোকানের এক নিয়মিত অতিথি। তার দিনটা যেন মটকা চায়ের উষ্ণ স্পর্শ ছাড়া সম্পূর্ণ হতো না।
আজও বিকেলটা ছিলো একই রকম। সূর্যাস্ত এখনো হয়নি, পশ্চিম আকাশে লালের আভা ছড়িয়ে পড়ছিলো ধীরে ধীরে। অনির্বাণ এক মনে তার মাটির ভাঁড়ের গরম চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। মালাইয়ের ঘন স্তর আর চায়ের কড়া মিষ্টি গন্ধ তার মনকে যেন এক অন্য জগৎ-এ নিয়ে যাচ্ছিলো। প্রথম চুমুকটা মুখে নিয়েই সে চোখ বুঁজেছিলো, মনে হচ্ছিলো যেন সব ক্লান্তি, সব কোলাহল এ এক চুমুকেই শান্ত হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় চুমুকের জন্যে যখন সে চোখ খুললো, তখনই তার জগৎটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেলো। পাশের টেবিলে, আবছা আলো-ছায়ার খেলায় বসলো এক অপরূপ রমণী। তার রূপ যেন স্নিগ্ধতার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। লম্বা, ঢেউ খেলানো কালো চুলগুলো তার কাঁধের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে আছে আলস্যে। পরনে হালকা রঙের সালোয়ার-কামিজ, যা তার কমনীয়তাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। সেও অনির্বাণের মতোই এক হাতে মাটির ভাঁড় ধরেছিলো চায়ে চুমুক দিচ্ছিলো। তার মুখে এক কোনো গভীর নীরবতা, যা অনির্বাণকে মুহূর্তেই আবিষ্ট করলো।
অনির্বাণ হতবাক হয়ে তাকাচ্ছিলো। তার হাত থেকে প্রায় চা ছিটকে যাচ্ছিলো। সে যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেলো। এ মুহূর্তে তার কাছে চায়ের স্বাদ, বিকেলের বাতাস, রেললাইনের শব্দÑসবকিছুই গৌণ হয়ে গেলো। শুধু সেই মেয়েটি, তার চাহনি, তার চায়ে চুমুক দেয়ার ভঙ্গিÑসবকিছুই তার মনকে এক অবর্ণনীয় মুগ্ধতায় ভরে তুলেছে। যেন দীর্ঘদিনের কোনো এক অপূর্ণতা এ মুহূর্তে পূর্ণতা পাওয়ার অপেক্ষায়।
তার মনে পড়লো, ছোটবেলায় সে এক কোনো কবিতা পড়েছিলো, যেখানে কবি তার ভালোবাসার মানুষকে এক কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আজ অনির্বাণের কাছে এ মেয়েটি যেন সেই কবিতারই এক জীবন্ত রূপ। তার সৌন্দর্য এতোটাই স্বতঃস্ফূর্ত, এতোটাই প্রাকৃতিক যে মনে হয় যেন স্বয়ং প্রকৃতিই তাকে নিজ হাতে গড়েছেন।
মাটির ভাঁড় থেকে চা কখন শেষ হয়ে গেলো, অনির্বাণ টেরও পেলো না। তার চোখ আর সরছিলো না মেয়েটির দিক থেকে। এক অপার্থিব মায়াজাল যেন তাকে ঘিরে ধরলো। মনের গভীরে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলোÑকী এ মেয়ে? কী তার নাম? কোথায় থাকে সে? ইচ্ছে করছিলো, এখনই উঠবো গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু এক অজানা সংকোচ, এক ধরনের ভয় তাকে আঁকড়ে ধরছিলো। এ মুহূর্তে কোনো ভুল করে সে এ সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করতে চায় না।
ঠিক তখনই মেয়েটি পাশে বসা তার বান্ধবীর দিকে ঘুরে মৃদু হাসলো। “কিউটি! গরম গরম মালাই চা কিন্তু! একটু ধীরে ধীরে স্বাদ গ্রহণ করবি, ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলবি তো!” বান্ধবীর গলার স্বরটা মৃদু হলেও, অনির্বাণের কানে তা স্পষ্ট ভেসে এলো।
‘কিউটি!’ নামটি কানে আসতেই অনির্বাণ যেন এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আহা! নামের সঙ্গে তার চেহারার কী অদ্ভুত মিল! ‘কিউটি’Ñএ নামটা যেন তার রূপে আরো এক নতুন মাত্রা যোগ করলো। অনির্বাণ অনুভব করলো, এ নামের পেছনে কেবল মিষ্টি রূপ নয়, এক কোমল হৃদয়ের প্রতিচ্ছবিও লুকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে অজান্তেই এক মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
কিউটি হাসলো। সেই হাসি যেন চায়ের দোকানের আবছা আলোয় এক ঝলক নরম রোদ এনে দিলো। অনির্বাণ মনে মনে ভাবলো, এ হাসিটা যদি সে প্রতিদিন দেখতে পেতো, তবে তার প্রতিটি সকালই উৎসবের মতো মনে হতো। সে কিউটির সাথে তাল মিলিয়ে মনে মনে চায়ে চুমুক দিলো। প্রতিটি চুমুকে যেন কিউটির অস্তিত্ব আরো গভীরভাবে মিশে যাচ্ছিলো তার অনুভবে।
অনির্বাণ একদৃষ্টে তাকাচ্ছিলো কিউটির দিকে। তার চোখে এখনো শুধু কিউটির মুখ, কিউটির হাসি, কিউটির চুলে লাগা বিকেলের আলো। তার মনে হলো, যেন তার দীর্ঘদিনের একাকীত্ব আজ এক নতুন সঙ্গীর সন্ধান পেয়েছে। এ নীরব মুহূর্ত, এ নীরব মুগ্ধতা যেন এক নিবিড় কথোপকথন তৈরি করছিলো তাদের মাঝে।
হঠাৎ করেই, কিউটির চোখ পড়লো অনির্বাণের চোখে।
দু’টি চোখ যেন এক মুহূর্তে একে অপরের সঙ্গে কথা বললো। সময়ের ঘড়ি যেন থেমে গেলো সেই এক মুহূর্তে। অনির্বাণের সমস্ত শরীর যেন এক অজানা, বিদ্যুৎ-শিহরণে কেঁপে উঠলো। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করলো দ্রুত তালে। তার সারা শরীরে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি খেলে গেলো। এ দৃষ্টিবিনিময় এক মিনিটেরও কম, কিন্তু অনির্বাণের কাছে তা মনে হলো অনন্তকাল। তার মনে হচ্ছিলো, সে যেন কোনো মহাকাব্যের নায়ক, আর কিউটি তার স্বপ্নের নায়িকা।
কিউটি চোখ সরিয়ে নিলো না, বরং তার মুখে এক মিষ্টি, মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়লো। সেই হাসি যেন মালাই চায়ের মিষ্টতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। অনির্বাণ অনুভব করলো, এ হাসির পেছনে লুকিয়ে আছে এক অব্যক্ত আমন্ত্রণ, এক নীরব আশ্বাস। তার মনে হলো, এ হাসিটি শুধু তাকেই উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়েছে।
ততক্ষণে বাইরে হালকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। কিউটির লম্বা চুলগুলো সেই বাতাসে উড়ে এসে তার ডাগর দু’টি চোখ দু’টিকে মুহূর্তের জন্যে ঢেকে দিলো। অনির্বাণ দেখলো, কিউটি তার ডান হাত দিয়ে আলতো করে চুল সরিয়ে আবার তাকালো অনির্বাণের দিকে। এবার তার দৃষ্টিতে কেমন যেন এক কোনো নীরব আমন্ত্রণ, এক গভীর প্রশ্ন। যেন সে নিঃশব্দে কিছু একটা বলতে চাইলো, যা শুধু অনির্বাণই বুঝতে পারবে। তার ঠোঁটের কোণে আবারো এক মৃদু হাসি ফুটে উঠলো, যা অনির্বাণের হৃদয়ে এক নতুন আশার সঞ্চার করলো।
অনির্বাণ স্তব্ধ হয়ে বসলো। তার মনে হলো, এ মুহূর্তটি যেন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। মটকা চায়ের দোকানে এসে সে শুধু চা পান করলো না, সে যেন খুঁজে পেয়েছে তার মনের মানুষ। তার হৃদয়ে ভালোবাসার প্রথম অঙ্কুরোদগম হলো এ নীরব দৃষ্টিবিনিময়ের মধ্যদিয়ে। তার মনে হলো, মটকা চায়ের ভাঁড়ে শুধু চা ছিলো না, ছিলো এক অব্যক্ত প্রেমের শুরু, এক নতুন কাব্যের প্রথম পঙ্ক্তি।
অনির্বাণ মৃদু হাসলো। তার ভেতরের সংকোচ যেন ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাচ্ছিলো। সে অনুভব করলো, এ মুহূর্তে তার আর কোনো ভয় নেই। তার হৃদয়ে এখনো শুধু কিউটিকে জানার, কিউটির সঙ্গে কথা বলার এক তীব্র আকাক্সক্ষা। সে যেন এক নতুন করে জন্ম নিলো এ মটকা চায়ের দোকানে, কিউটির চোখে চোখ রেখে। সে জানে না এ গল্পের শেষ কোথায়, কিন্তু এ শুরুটা তার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
অনির্বাণ নিশ্চিত, সে আবার আসবে। কালও আসবে। কিউটিকে আবার দেখবো। আর এবার, সে হয়তো সাহস করে কিছু বলবে। এ নীরব মুগ্ধতাকে ভেঙে সে তার হৃদয়ের কথা কিউটির কাছে পৌঁছে দেবো। মটকা চায়ের এ দোকানটা এখনো তার কাছে শুধু চা পানের জায়গা নয়, এটা তার স্বপ্নের শুরু, তার ভালোবাসার গল্প লেখার এক নতুন ঠিকানা।







