প্রকাশ : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৭
ধারাবাহিক উপন্যাস-১৮
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশের পর)
সেদিন শপথ নিয়েছিলাম পেছনের সকল সমস্যাগুলো ভুলে আমরা বাঁচব নিজের মতো করে কিন্তু সমস্যা কী ভুলে থাকা যায়? ট্যুর শেষ করে আবার তো ফিরব সেই আত্মসম্মানহীন জীবনে তাহলে নিজের মতো করে বাঁচা হলো কীভাবে। যাক ফিরে এসে যেটা হবে সেটা দেখা যাবে এখন কিছুদিন নিজের মতো করে বাঁচি অন্তত। শপথ পাঠের পর আমরা যার যেমন খাতা কলম নিয়ে বসে তালিকা তৈরি করছি খরচের। পাঁচ দিনের হিসেবে যাওয়া ও থাকা-খাওয়া বাবদ একটা খরচ ফিক্সড করা হলো তারপর বুকিং দেওয়া হলো কক্সবাজার বিচ রিসোর্টে। এখানে সারোয়ার ও অনিমেষের শর্ত ছিল বারান্দায় বসলে যেন সমুদ্র দেখা যায় এমন পজিশন দেখে রুম নিতে। যেই কথা সেই কাজ, অনলাইনে বিস্তারিত জেনে-বুঝে তারপর হট লাইনে কথা বলে কনফার্ম হয়ে রুম বুকিং দেওয়া হয়। প্রথমে বলা হয়েছে দুটি রুম তারপর সারোয়ারের কথা-একটি ডাবল বড় রুমে থাকব আমরা একসাথে, আলাদা আলাদা হলে আড্ডা জমবে না। সারোয়ার আড্ডার মধ্যমনি তাই তার কথা অগ্রাহ্য করবে এটা হতে পারে না এবং কথায় যৌক্তিকতাও আছে তাছাড়া আড্ডার পরিবেশ সে তৈরি করে তাই তাকে এ বিষয়ে মূল্যায়ন করতেই হবে। অতঃপর আমাদের সে দিনটি চলে এসেছে। খুব বেশি এক্সসাইটেড ছিলাম কক্সবাজার ট্যুর নিয়ে কারণ আমার জীবনে এই প্রথম সমুদ্র ভ্রমণ। নদী দেখেছি বহুবার কিন্তু সাগর কখনো দেখা হয়নি। আমার বাড়ি কুমিল্লায় তাই কুমিল্লার বাসিন্দারা নদী-সাগরের প্রতি বেশ আকর্ষিত থাকে। এই শহরে গোমতী নদী ছাড়া আর তেমন কোনো নদী নেই তাও শহরতলীর ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীকে মরা গাং বলে। গোমতী নদীর ধারা শহরের বাইরে দিয়ে শাখা নদীর সাথে যুক্ত করে দিয়ে নদীর এই ধারাকে ফ্রিজ করে দিয়েছে। শুনেছিলাম পূর্বে পাহাড়ী ঢলের স্রোতে ভেসে যেত শহরতলী তাই শহর রক্ষার্থে এই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যাই হোক রাত ১১:৪০ ঘটিকার বাসে উঠে পড়লাম আমরা চারজন। পাশাপাশি বসতে পারায় কোনো ঝামেলা হয়নি তেমন। রাতের বেলা বাসে বেশ কিছুক্ষণ চলল আড্ডা। শীতের রাত তাই পথে কুয়াশা বেশি, টিকিট চেক করার পর যাত্রীদের ঘুমানোর সুবিধার্থে লাইট অফ করে দেওয়া হয়। ঘুম কী আর আসে আমরা সকলেই জেগে রয়েছি। রাত তিনটার দিকে হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে এসে থামে বাস যাত্রা বিরতির জন্য। অল্প সময়ের বিরতিতে সকলে চা নাশতা সেরে নিবে। আমরা ফ্রেশ হয়ে নেই প্রথমে তারপর চায়ের পর্ব সেরে নিয়ে আবার বাসে চেপে বসি। রাতের আকাশে অনেক কুয়াশা যদিও তবু চাঁদের আলো থাকায় স্পষ্ট দেখা যায় সবকিছু। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি সে দিনের কথা যখন বিয়ের পর প্রথম আমরা বাস ভ্রমণ করি। আমার পোস্টিং ছিল তখন রাজশাহীতে। এখনকার মতো অত্যাধুনিক বাস সে যুগে ছিল না। ঢাকা থেকে রাত আটটার বাসে উঠেছিলাম আর সেদিন ছিল চাঁদনী রাত। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছি। আমাদের মাঝে অপরিচিত থাকা বা একে অপরে লজ্জা পাওয়ার বিষয় অনেকটা কেটে গিয়েছিল তবুও কিছুটা থেকে যায় বাইরের পরিবেশে। সে আমার পাশে বসে থেকে জানালা দিয়ে অবিরাম বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছিল। যদিও বাসে অন্ধকার ছিল তারপরও তার মুখটা চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। তার হাত আমার হাতে নেওয়ার পর সে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে আর কিছুক্ষণ পর দেখি সে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে থাকি অনেকক্ষণ যাতে সে বাসে বসে ঘুমাতে পারে। আজ একই পরিবেশে আমি যাচ্ছি কক্সবাজারে। অতীত স্মৃতিটা যদি মধুময় হয় তাহলে তাকে ভুলা যায় না।
‘পিটার ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’
‘না সারোয়ার জেগে আছি। কিছু বলবে?’
‘আমরা যখন অফিসের কাজে দুজনে ঢাকা আসতাম তোমার খেয়াল আছে কত রাত এভাবে ট্রেনের টিকিট নিয়ে সিট পেয়েও তোমার চাঁদনী রাতের কারণে বসতে পারিনি। তিন-চার ঘণ্টা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে তুমি রাতের চাঁদ দেখতে।’
‘কী করে ভুলি যেখানে তোমার মতো মজার মানুষ সফরসঙ্গী হয় সেখানে কী সিটে বসে সময় কাটানো যায়। প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামলে কিছু না কিছু খেতে হবে মনে আছে তোমার।’
‘আমি স্ট্রিট ফুড বেশ পছন্দ করতাম তাই না চেখে থাকা যাবে না।’
‘সারারাত অর্ঘুমা থেকে ঢাকায় এসে ভোরে মতিঝিল গিয়ে রেস্টুরেন্টের প্রথম কাস্টমার আমরাই হতাম।’
‘ঠিক তাই। তোমার খেয়াল আছে পিটার একবার আমরা ট্রেন থেকে নেমে পড়ি খুব ভোরে। মতিঝিল আসার পথে আমার বেশ বাথরুম পায়। সেদিন বেশ অসহায় বোধ করেছিলাম। কোথাও কোনো টয়লেট নেই অবশেষে এক জীর্ণ পেট্রোল পাম্প পাই যার দারোয়ানকে ডেকে তুলে তুমি আমায় বাথরুমে পাঠালে। পেটের চাপে এতটাই মরিয়া ছিলাম যে খেয়াল করিনি কলে পানি আছে কী না।’
‘আরে বল কী সারোয়ার তারপর কী হলো?’
‘ও আপনারাও শুনছেন তো শুনুন পুরো কাহিনি।’
‘আমি তো ত্যাগ করে ত্যাগের সুখ নিলাম কিন্তু কলে তো পানি নেই। এদিকে পিটারকেও দেখতে পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে দেখি দূরে দারোয়ানের টেবিলটায় বসে বসে সে ঝিমাচ্ছে। তাকে ডাকছি কিন্তু জেনারেটরের আওয়াজে শোনা যাচ্ছে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর পিটার বলুক। সে জানে বাকিটা কীভাবে উদ্ধার করেছিল।’
‘জানেন দাদা আমাদের রেখে দারোয়ান নামাজ পড়তে চলে গেল মসজিদে। এদিকে সে সেরে আমাকে ডাকছে। জেনারেটরের আওয়াজে আমি শুনতে পাইনি। দেরি দেখে বাথরুমের দিকে তাকাতেই দেখি একটা হাত বাথরুমে দরজার উপরের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ডাকছে। আমি তড়িঘড়ি করে যাই গিয়ে শুনি বাথরুমে পানি নেই। কী মুসকিল! আশ পাশে পানি কোথায় পাই এদিকে হোটেল রেস্তরাগুলো তখনো খোলেনি। তাকে বললাম একটু অপেক্ষা কর আমি দেখছি। রাস্তায় ঝাড়ু দিতে থাকা সুইপারের একটা বালতি ছিল সেটা নিয়ে চলে আসি মসজিদে। মুসল্লিরা তখনো নামাজ পড়ছে। আমি পানি আনতে গিয়ে দেখি বালতির তলায় ফুঁটো। মেজাজ এতটাই গরম হয়েছিল যে মনে মনে তাকে বেশ বকাঝকা দিলাম। বালতির ফুঁটোয় হাত দিয়ে চেপে ধরে এক বালতি পানি এনে দেই তারপর ভদ্রলোক পরিষ্কার হয়ে বাইরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে ক্ষান্ত হন। তারপর বালতি ফেরত দেওয়ার সময় সুইপার যদি টাকা দাবি করে তখন মেজাজটা কেমন লাগে।’
‘হা হা হা...তারপর ?’
‘তারপর আর কী পকেট থেকে আমার টাকা খসল।
‘তুমি তো অনেক মহান কাজ করলে দেখি এ অসহায়ের পাশে দাঁড়িয়ে।’
‘হা হা হা...তারপর আরও আছে। হাতমুখ সাবান দিয়ে ধুতে হবে তাই রেস্টুরেন্টের দরজায় বাড়ি দিয়ে সে রেস্টুরেন্ট খোলায়। কর্মচারীরা আধঘণ্টা পর আসতে বললে সে ধমকে উঠে। সাত সকালে কে ঝামেলা করবে তাই আমাদের আসতে দেয়।’
‘তারপর?’
‘তারপর ভদ্রলোক ফ্রেশ হয়ে বসে বসে রেস্টুরেন্টে ঝিমালেন। আমার সে দিনটির কথা আজও ভাবলে নিজেই হাসি পায়। দিনগুলো সত্যি ছিল মজার।’
ভোররাত পৌঁনে পাঁচটায় চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। কাউন্টারে আমরা অপেক্ষা করছি আর সারোয়ার গেল মসজিদে নামাজ আদায় করতে। আমাদের যেতে হবে কর্ণফুলি ব্রিজের কাছে সেখান থেকে অনায়াসে বাসে করে চলে যাওয়া যায়। পুরোপুরি ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করছি আর কিছুক্ষণের মধ্যে সারোয়ার নামাজ সেরে চলে আসে। শরীর অনেক ক্লান্ত এতে বুঝতে পারছি আমরা বয়স্ক হয়ে গেছি এখন আর আগের মতো রাত জেগে থাকা যায় না। আরও তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ অবশিষ্ট রয়েছে। রেস্ট যা নেওয়ার নেওয়া হয়ে গেছে এখন একটু ঝিমিয়ে পড়লে আর বাকিদের নিয়ে আজ কক্সবাজার যেতে পারব না। আমরা অর্ঘুমা থেকে সকলেই ক্লান্ত। অলংকার থেকে একটা সিএনজি ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে চলে আসি কর্ণফুলি ব্রীজের মোড়ে তখন পুরোপুরি ভোর হয়ে আলো ফুটেছে। শীতের কুয়াশা ঘেরা ভোর কত বছর পর দেখলাম যদিও তেমন একটা শীত লাগছে না চট্টগ্রামে। এখানে অনেকগুলো গাড়ির কাউন্টার থাকলেও কক্সবাজার পৌঁছাতে সবচেয়ে কম সময় নেয় এমন একটা বাস নির্বাচন করে তার কাউন্টারে ব্যাগগুলো রেখে আমরা পাশের রেস্টুরেন্টে চলে আসি নাশতার জন্য। চা নাশতা সেরে আমাদের এবার যাওয়ার পালা। কাউন্টারে আসতেই দেখি একটা বাস এসে থামে যাওয়ার জন্য আমরা টিকিট কেটে উঠে পড়ি। বাসের সিটগুলো একটু আরামদায়ক হওয়ায় ঝিমাতে ঝিমাতে আমাদের ঘুম আসতে বেশি একটা সময় লাগেনি। আমার এক্সসাইটমেন্ট বেশি থাকায় বেশ কিছুটা পথ জেগে ছিলাম তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি টেরই পাইনি। চোখ খুলে দেখি আমরা কক্সবাজার ঢুকছি, তখন সকাল সাড়ে নয়টা। শহরতলিতে যদিও লোকজনের আনাগোনা আছে তবু আমরা ঘিঞ্জি এলাকার মানুষগুলো এটাকে কম ভাবি। টেলিফোন করে নরেন্দ্রদা হোটেলের লোকেশন নিলেন তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে আসি হোটেলে। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের রিসিভ করে রুম অবদি নিয়ে আসলেন। ভদ্রলোকের এই আচরণ সত্যি মনমুগ্ধকর। যেখানে পরিবারগুলো মূল্যায়ন করতে চায় না সেখানে এমন মূল্যায়িত হওয়া সত্যি ভাগ্যের বিষয়। আমরা রুমে এসে সকলে ফ্রেশ হই এক এক করে। গিজার্টের গরম পানি দিয়ে সাওয়ার নেই তারপর যে যার মতো করে বিছানায় হেলে পড়ি। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন দুপুর দেড়টা। ক্ষুধা পেয়েছে সকলেরই তাই রেস্টুরেন্টের রিসিপশনে যোগাযোগ করে ওদের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার রুমে আনিয়ে নেই। খাবার আনতে একটু সময় লাগবে এদিকে আমার সমুদ্র দেখার আগ্রহ মনে প্রবল ঝড় তুলছে। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দূরে বীচ দেখা যাচ্ছে তারপর বিশাল সমুদ্র। যদিও আমরা আছি পাঁচতলায় আর সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় ঠান্ডা বাতাসে গা শিরশির করছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে কাটাই। মনের আকাক্সক্ষা আজ বাস্তবতার রূপ নিয়েছে অবশেষে। এ জীবনে কখনো এই আশা পূরণ হবে তা ভাবতে পারিনি। ঘুমিয়েছি বেশ কিছুক্ষণ তারপরও চোখের পাতায় ঘুমের রেশ লেগেই আছে আর সেজন্য মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কিছুক্ষণ বসার পর নরেন্দ্র দা আর অনিমেষ এসে পাশে বসলেন।
‘কী ভাবছ?’
‘কিছু না দাদা। আমার সমুদ্র ভ্রমনের স্বপ্নটা পূরণ হবে সেটা ভাবিনি কখনো। কতদূর থেকে চলে এসেছি সমুদ্রের কাছাকাছি আর একটু পথ শেষ করলেই সমুদ্র, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না দাদা আমি এসেছি এখানে।’
‘এরই নাম জীবন বুঝলে। কার কোন আশা, কোন স্বপ্ন কখন পূরণ হবে সেটা স্বয়ং বিধাতাই জানেন।’
‘তুমি ঠিকই বলেছ অনিমেষ। আমরা কেহই বলতে পারব না।’
‘তা জনাব, আপনাদের কী ক্ষুধা পায়নি! আমার কিন্তু বেশ পেয়েছে। সেই সাত সকালে নাশতা করেছি এখন সেগুলো হজম হয়ে পেট নতুন করে খাবার চাইছে। তোমার পার্টনার এখনো বিছানা ছাড়েনি অনিমেষ।’
‘আরে বলছেন কী দাদা সারোয়ার এখনো বিছানায়। ও কী এখানে শুধু ঘুমাতে এসেছে?’
‘আরে না পিটার উঠে গেছি। শরীরটা মেজমেজ করছে তাই বিছানায় শুয়ে আছি। বয় এসে এখন খাবার দিয়ে গেল তোমরা ভিতরে এসো তো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। নরেন্দ্র দা কী কী অর্ডার করলেন শুনি।’
‘তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর খাবার টেবিলেই বসে দেখে নিও।’
দুপুরের খাবারের তালিকা খারাপ ছিল না। নারকেলি মাছের সাথে সব্জি ও দু-তিন পদের ভর্তা-ভাজি। বেশ আয়েশ করে খাওয়া হয় আমাদের। নারকেলি মাছটা সামুদ্রিক মাছ তাই স্বাদও অন্যরকম। মিঠা পানিতে এই মাছ পাওয়া যায় কী না আমার জানা নেই কারণ বাজারে কখনো নজরে পড়েনি। খাওয়া-দাওয়ার পর যার যেমন আবার বিছানায় গিয়ে ঢলে পড়লেন। আমি বিছানায় নয় পুনরায় গিয়ে বারান্দায় বসি। শেষ দুপুরের রোদটা ভালোই লাগছে। কিছুক্ষণ পর ওরা এসে আমার পাশে বসল।
‘সমুদ্র বারান্দায় বসে দেখবে নাকি যাবে সেখানে?’
‘ইচ্ছে তো আমারও আছে কিন্তু তোমরা সকলে লাঞ্চের পর গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লে।’
‘খাওয়ার পর শরীরটা ঝিমিয়ে যায় তাই বিছানায় একটু গড়াগড়ি দিলাম। এখন চারটে বাজে আর ঘণ্টা দেড়েক পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তা তোমরা কোথায় যাবে ঠিক করলে? দাদা আপনার কোনো প্ল্যান আছে নাকি?’
‘হুম আছে। আমরা আজ আর সমুদ্রের দিকে যাব না।’
‘যাব না মানে! কেন যাব না?’
‘বলছি শোন। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে একটু সরে গিয়ে আলাদাভাবে বাঁচতে ইচ্ছে হয়েছে বলেই তো এখানে আসা তাই না?’
‘আপনি বলে যান দাদা আমরা পরে বলব।’
‘তাহলে আগে আমাদের ড্রেস আর গেটআপ চেঞ্জ করতে হবে।’
‘মানে কী? আপনি কী করতে চাইছেন একটু খুলে বলবেন?’
‘আমরা এখন শপিং করব। চল বার্মিস মার্কেটের এরিয়াতে যাই। সেখানে গিয়ে এই পাঁচ-সাত দিনের জন্য যা যা কেনার কিনে নেই।’
‘আমরা তো আসার দিন শপিং করেছি তাহলে এখন আবার কেন?’
‘প্রয়োজন আছে। আরে বন্ধুবর এই জীবন কী দ্বিতীয়বার আসবে আর আসলেও আমরা সকলে কী একসাথে থাকব তখন? এখন যা আছে তাকেই সেরা করে তুলি এসো।’
‘বাহ্ দাদা যখন ভেবে নিলেন তখন আমল করবই, চল তাহলে।’
রিসোর্টের গেইট পেরিয়ে আমরা চলে আসি রাস্তায়। বীচের আশপাশের এলাকা হওয়ায় রাস্তাঘাট বেশ চকচকা ও যানযট বিহীন। অটো রিকশা নিয়ে চলে আসি শহরতলীতে বার্মিজ মার্কেটের দিকে। বীচ এলাকা থেকে এখানে একটু যানযট আছে দেখছি। আমরা সকলে বেশ কিছু মার্কেট ঘুরলাম আর ঘুরে ঘুরে সকলের জন্য কেনাকাটা করা হয়। ড্রেসকোড নির্বাচন করতে বলা হয় সারোয়ারকে আর সে সকলের জন্য নির্বাচন করে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর গাছপালা আঁকা বয়েল সুতি কাপড়ের শার্ট এবং পায়ে থাকবে চটি জুতা। এই বয়েসে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া কেমন যেন অদ্ভুত লাগবে তারপরও সেই পুরানো দিনের স্বাদটা খারাপ লাগবে না। আমি বেশ উৎফুল্ল আর সারোয়ার সে তো জন্মেছেই এই উৎফল্লতার জন্য। লোকটা পারেও বটে যেন তার কোনো কিছুতেই কোনো প্রকার অনুভূতি নেই। কোনো দুঃখ নেই, বেদনা নেই যা আছে তা চঞ্চলতা, হৈ-হুল্লোর, আনন্দ-বিনোদন। মাঝেমধ্যে তাকে দেখলে হিংসে হয়, কীভাবে পারে একটা মানুষ এতটা স্ট্রেস ফ্রি থাকতে। সৃষ্টিকর্তা হয়তো এমন কিছু মানুষও সৃষ্টি করেছেন যাদের জীবনটা আমাদের মতো কঠোর বাস্তবতার হয় না। রাত আটটার দিকে আমরা রুমে চলে আসি। সকলের এখনো ক্লান্তি দূর হয়নি। আমার রুমের চাইতে বারান্দায় ভালো লাগে তাই বারান্দায় বসে কাটাচ্ছি। হঠাৎ অনিমেষ বারান্দায় এসে আমায় রুমে আসতে বলে।
‘খাওয়া-দাওয়া করতে হবে নাকি? এখন সোয়া আটটা বাজে আমরা খাওয়া-দাওয়া শেষে বীচে গিয়ে বসব কিছুক্ষণ, কী বল পিটার?’
‘আমরা আজ সমুদ্রে যাব না বললেন তাহলে এখন আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন?’
‘হা হা হা ... আমরা কাল থেকে মন খুলে সমুদ্র দেখব তাই আজ যেতে চাইনি কিন্তু তোমার সমুদ্র দর্শনের অতৃপ্তি দেখে মন চাইল না বসে থাকতে। আজ একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নিয়ে বীচে গিয়ে বসব। ভারী জামাকাপড় পড়ে নাও শীতের রাত যেন অসুস্থ্য না হয়ে পড়ি আমরা কেহ।’
‘না দাদা আজ যখন সিদ্ধান্ত হলো বীচে যাব না তাহলে যাব না। কাল ভোরের মর্নিং ওয়াক বীচেই হবে তখন মন খুলে সমুদ্র ভ্রমণ করব। আকাক্সক্ষা কিছু না থাকলে নতুন কিছুতে মজা পাওয়া যায় না।’
‘তাহলে এখন কী করব? বীচে যাব বলেই চলে এলাম তাড়াতাড়ি নতুবা আরও কিছু সময় মার্কেটে কাটিয়ে আসতাম।’
‘আমাদের করার অনেক কিছু আছে দাদা। আমরা তো দাবার সামগ্রি এনেছি। বসে যাও সারোয়ার আর অনিমেষ। আমি বসব বারান্দায় কিছুক্ষণ আর দাদা আপনি কী করবেন?’
‘আমার সঙ্গী আছে সেটা নিয়ে টেনশন করতে হবে না।’
‘সঙ্গী কোনটা?’
‘ডায়েরি।’
রাতের ডিনার শেষে আধ ঘণ্টার মতো আমরা এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করি। আমাদের মতো এখানে আরও বহু লোক যার যেমন ঘুরছে ফিরছে। শীতকালে কক্সবাজার বীচে ভীড় একটু বাড়ে কারণ এ সময় বাচ্চাদের পরীক্ষাগুলো শেষ হয় এবং অভিভাবকেরা ফ্রি থাকেন তাছাড়া শীতকাল ঘোরাফেরার জন্য উৎকৃষ্ট সময় কারণ এ দিনে বৃষ্টি-তুফানের ভয় নেই, প্রচণ্ড গরম নেই। রুমে এসে যার যেমন বসে পড়ে দাবার আড্ডায়। পিটার চলে যায় একটা চাদর নিয়ে বারান্দায় আর আমি ডায়েরিটা বের করে হারিয়ে যাই নিজ জগতে।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]







