প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২১, ০০:০০
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়ায়, মোবাইলে আসক্তি ও শিশুশ্রম বাড়ছে। এমন মন্তব্য করলেন শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। করোনায় নিম্নআয়ের মানুষের সংসারে টানাপোড়েন চলছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া পরিবারগুলো তাদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের বাড়তি আয়ের আশায় শিশুশ্রমে নিয়োজিত করছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে আসক্ত হয়ে উঠছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার চান্দ্রা বাজার, ফরিদগঞ্জ বাজার, রূপসা বাজার, কালিরবাজার, গোবিন্দপুর বাজার, গল্লাক বাজারসহ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে চোখের সামনে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে ও আনাচে-কানাচে এমনই চিত্রই দেখা গেছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর বলছে, সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী উপজেলায় বিভিন্নভাবে ১শ’ ১২ জন শিশুশ্রমে নিয়োজিত ছিলো। তবে করোনাকালীন ভাসমান বিভিন্ন বসতি এবং নিম্নআয়ের পরিবার থেকে শিশুশ্রম বাড়ায় এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন ফরিদগঞ্জ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মাকছুদা আক্তার।
মাকছুদা আক্তার বলেন, উপজেলায় শিশু শ্রমিকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছিলো ২০১৭ সালে। দীর্ঘদিন আর কোনো ধরনের সভা-সেমিনার নেই। তবে সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে আমরা অনেক শিশুকে ও তাদের পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনার চেষ্টা করেছিলাম। এছাড়া শিশুশ্রমে নিয়োজিতদের পুনর্বাসনের জন্যে উপজেলায় কোনো প্রকল্প নেই বলেও জানান তিনি।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি, কেন্দ্রীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি বদরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ বিল্লাল হোসেন পাটোয়ারী বলেন, করোনাকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের কারণে শিশুদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক শিশুই বিভিন্ন কর্মে জড়িত হয়ে গেছে এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের অনেক ছেলে-মেয়ে মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে দিন দিন বিপথগামী হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা শিক্ষকরা ভ্যাকসিন (টিকা) নিয়েছি, তাই আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। শিশুদের তো এমনিতেই করোনা হচ্ছে না। তাই নিয়ম-নীতি মেনে এই মুহূর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে ঝরেপড়া শিশুদের আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মোবাইলে আসক্ত হওয়া বিপথগামী ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।
লতিফগঞ্জ ফাযিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) মোঃ মহিউদ্দিন চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোতে বেড়ে ওঠা শিশুদের একটি অংশ বিভিন্ন হোটেল ও ছোট কারখানাগুলোতে কাজ নিচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে শিশু অপরাধ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে, মাদকের বাহকও বাড়তে পারে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের পক্ষে তিনি মতামত দিয়ে বলেন, অনলাইনভিত্তিক ক্লাস জোরদার করতে হবে। শিক্ষকদের মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে শিশুদের প্রতি অধিকতর খবরদারি করে শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করাতে হবে।
চান্দ্রা ইমাম আলী উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহ্ মোঃ মকবুল আহমদ চাঁদপুর কণ্ঠকে জানান, করোনাকালীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিশুশ্রম বেড়েছে এবং মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ছেলে-মেয়েরা মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে বিপথগামী হয়ে উঠছে। বিশেষ করে শিশুশ্রমে নিম্নআয়ের পরিবারের মধ্যে এই প্রবণতাটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিত্তবানরা সাহায্যের হাত বাড়ালে এমনটা হতো না।
তিনি বলেন, এ সময়ে ঢালাওভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া ঠিক হবে না। তবে দৈনিক একটি বা দুটি শ্রেণির ক্লাস নিলে আমরা শিক্ষকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘণ্টা নেয়ার ব্যবস্থা করতাম। এতে করে শিক্ষার ধারাবাহিকতা বজায় থাকতো, অন্যদিকে তাদের দৃষ্টি থাকতো না।
ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা, রূপসা, গাজীপুর, পাটোয়ারীবাজারসহ আরও কয়েকটি বাজারে দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত অনেক শিশু অটোবাইক চালাচ্ছে। অনেক শিশু বেকারি, গ্রিল-ওয়ার্কশপ ও ঔষধের দোকানসহ বিভিন্ন কর্মে জড়িয়ে পড়ছে।
অটোবাইক চালক রবিউল পঞ্চম শ্রেণি, রাব্বি ষষ্ঠ শ্রেণি, শাকিব চতুর্থ শ্রেণি, নিশাত কাজী পঞ্চম শ্রেণি, ঔষধের দোকানের কর্মচারী সোহাগ পঞ্চম শ্রেণি, শাহনেওয়াজ সপ্তম শ্রেণীসহ বেকারি এবং গ্রিল ওয়ার্কশপে কর্মরত শিশুদের সাথে কথা হলে তারা বলে, স্কুল বন্ধ, তাই তারা এ কাজে যোগদান করেছে। তাদের দাবি সংসারে যদি টানাপোড়েন না থাকতো তাহলে তারা এ কাজ করতো না। স্কুল খুলে দিলে আবার তারা স্কুলে চলে যাবে বলে তারা জানায়।
মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের সাথে কথা হলে তারা বলে, স্কুল বন্ধ। সময় কাটে না, তাই মোবাইল নিয়ে গেম খেলছি। এসব নিয়ে অভিভাবকদের অনেকের সাথে কথা হলে তারা বলেন, করোনাকালীন এ সময়ে স্কুলগুলো বন্ধ রাখার কারণে আমরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বিপাকে আছি। প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের চিন্তায় কাটে। ছেলে-মেয়েদের কতক্ষণ আমরা ডাক দিয়ে রাখবো। আর মহামারি করোনা দিয়ে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাবে সেটাও আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয়। তারপরেও সরকারের কাছে আবেদন, নিয়ম-নীতি মেনে স্কুলগুলো খুলে দিলে হয়তো অনেক ভালো হতো।