রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা বিএম কলিম উল্লাহর ইন্তেকাল

কামরুজ্জমান টুটুল ও পাপ্পু মাহমুদ ॥
কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা বিএম কলিম উল্লাহর ইন্তেকাল

চাঁদপুর জেলার কিংবদন্তিতুল্য মুক্তিযোদ্ধা বি এম কলিম উল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। ভাষা সৈনিক, রাজনীতিবিদ, বিদ্যোৎসাহী সহ বহুমাত্রিক পরিচয়ে ভূষিত এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ৫ জানুয়ারি ২০২৪ শুক্রবার রাত ১২টা ৯ মিনিটে ঢাকার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৬ বছর। শুক্রবার বাদ জুমআ হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে প্রথম জানাজাশেষে তাঁকে নিজ গ্রামের বাড়ির সামনে দ্বিতীয় জানাজাশেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাদ আসর দাফন করা হয়। প্রথম জানাজায় ইমামতি করেন মুফতি আবদুর রউফ।

হাজীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান মানিকের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদাস্বরূপ মরহুম বিএম কলিমুল্লাহকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। প্রথম জানাজার পর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে মসজিদ মাঠে তাঁর মরদেহ রাখা হয়।

বিএম কলিম উল্লাহ হাজীগঞ্জ উপজেলার বড়কুল পশ্চিম ইউনিয়নের গোপালখোঁড় গ্রামের ভূঁইয়া বাড়ির মৃত হায়দার আলী ভূঁইয়ার ছেলে। মরহুমের একমাত্র পুত্র, হাজীগঞ্জ রোটারী ক্লাবের সাবেক সভাপতি রোটারিয়ান বিএম আহসান কলিম জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন তার বাবা। সবশেষ তিনি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২ টা ৯ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে ও ৭ মেয়ে, বহু নাতি-নাতনি সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

বিএম কলিমুল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন চাঁদপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, স্বতন্ত্র প্রার্থী ও হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী মাঈনুদ্দিন ও হাজীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আ.স.ম মাহবুব-উল আলম লিপন, সাবেক মেয়র আলহাজ্ব আঃ মান্নান বাচ্চু, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ রোটাঃ আহসান হাবিব অরুন, হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদের মোতাওয়াল্লী ড. আলমগীর কবির পাটওয়ারী, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক মুরাদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত সাহা, মোঃ আবু তাহের, মুজিবুর রহমান, হাজীগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আসফাকুল আলম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক হায়দার পারভেজ সুজন, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রোটাঃ রুহি দাস বণিক, বিএনপি নেতা আবুল বাশার প্রমুখ।

এছাড়াও বিএম কলিমুল্লাহর মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রেসক্লাব, সাংবাদিক কল্যাণ সমিতি, রিপোর্টার্স ইউনিটি নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন হাজীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমেদ খসরু।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড বিএম কলিম উল্লাহ ১৯১৮ সালে চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার গোয়ালখোড় গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হায়দার আলী ভূঁইয়া, মাতা মরহুমা একতের নেছা ও স্ত্রী মাহমুদা কলিম। তিনি ৮ সন্তানের জনক এবং পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বিএম কলিম উল্লাহ হাজীগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে ইন্টারমেডিয়েট এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

বিএম কলিম উল্লাহ ছিলেন মূলত ভাসানী ন্যাপের নেতা। তিনি কলেজ পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ভাসানী ন্যাপ অনেক পূর্বেই স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে। ভাসানী ন্যাপ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে স্লোগান তোলে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর'। মেহনতি মানুষের বন্ধু কমরেড কলিম উল্লাহ ভাসানী ন্যাপের পতাকা নিয়ে ১৯৬৮ সাল থেকেই গোপনে গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু করেন। সেই সময় থেকে তিনি ভাসানী ন্যাপের সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের পরিস্থিতি বুঝে তাঁর সশস্ত্র ক্যাডারদেরকে নিয়ে হাজীগঞ্জ থানার অস্ত্র লুট করে হস্তগত করেন। ওই দিন তিনি হাজীগঞ্জ থানা থেকে ৬টি রাইফেল ও কিছু বুলেট সংগ্রহ করেন।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তিনি হাজীগঞ্জের ডাঃ আবদুস সাত্তার, তাফাজ্জল হায়দার নসু চৌধুরী, আবদুর রব মিয়া, আলী আহমেদ দিগচাইল, আঃ মান্নান বিএসসিসহ আরো অনেক স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের নেতাদেরকে নিয়ে হাজীগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। কিছুদিন পর বিএম কলিম উল্লাহর যোগ্য নেতৃত্বে চাঁদপুরের শত শত ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর উদ্ভাবিত নিত্য নতুন রণকৌশল, সাংগঠনিক ক্ষমতা এবং আধুনিক গোয়েন্দা কার্যক্রম দ্বারা চাঁদপুরে পাকিস্তানের ৩৯তম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টারের প্রধান মেজর জেনারেল রহিম খানের মতো বিখ্যাত পাকিস্তানি সমরনায়ককে নাস্তানাবুদ করেন।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড বিএম কলিম উল্লাহ ছিলেন কিংবদন্তির এক মহাপুরুষ। তিনি পুরো ৯ মাস এমএফ (MF) বাহিনীর কমান্ডার সুবেদার জহিরুল হক পাঠানের সঙ্গে সহ-অধিনায়ক হিসেবে সংযুক্ত থেকে চাঁদপুরের বিভিন্ন যুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি অসাধারণ রণকৌশল, নৈপুণ্য ও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে পকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেন। যাঁর নাম শুনলে পাকিস্তানি দালালদের মনে ভয়ে আতঙ্কে টর্নেডো শুরু হতো। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশেষ করে হাজীগঞ্জ থানার অস্ত্রলুটের যুদ্ধ, সোনাপুর ব্যাংক থেকে অর্থলুট, মতলব থানার অস্ত্র লুট, কচুয়া থানার অস্ত্রলুটের যুদ্ধ, বলাখাল রামচন্দ্রপুর খেয়াঘাটের প্রথম যুদ্ধসহ বহু যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। জীবন সায়াহ্নে তিনি রাজধানী ঢাকায় বসবাস করেন এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উল্লেখ্য, বিএম কলিম উল্লাহ একজন বিদ্যোৎসাহী হিসেবে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার কারিগর। তিনি রামচন্দ্রপুর ভূঁইয়া একাডেমি, হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ, হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজ, হাজীগঞ্জ জামিয়া আহম্মদিয়া কোরআনিয়া মাদ্রাসা ও জিয়ানগর কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতাদের ছিলেন অন্যতম।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়