প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৮
হাইমচর বাজারের একটি স্কেচ চিত্র
॥ দ্বিতীয় পর্ব ॥
কেন হাইমচর বাজার নিয়ে আমাদের জানা দরকার। কারণ এটি আমাদের একটি শেকড়। যেমনি ঐতিহ্যের একটি বন্ধন, তেমনি সম্প্রীতির আঁতুড়ঘর। এখানে হিন্দু সম্প্রদায় ছিল ব্যবসায়ী, মুসলমান সম্প্রদায় ছিল ক্রেতা। গরুর বাজারের গরু, মুরগির বাজারের মুরগি, ডিমের বাজারের ডিম আসতো মুসলিম গেরস্ত বাড়ি হতে। নেতৃত্ব ছিল হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের হাতেই। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মুসলমান পরিবার ছিল কৃষি শ্রেণীভুক্ত।
গতপর্বে যেসব স্থান, ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছিলাম তাছাড়া অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তির নাম আমার স্মরণে না থাকায় বাদ পড়েছে তাদের নাম ও কিছু ঘটনা-পর্বে তাদের অবস্থানের কারণে তাদের বাজারের ইতিহাসের সাথে নাম নেয়া সমীচীন মনে করছি।
বাজারের পূর্ব মাথায় শ্রীকৃষ্ণ মাঝির বাড়ির সামনেই ছিল মিতালী স্টুডিও। এটা ছিল এ অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চাঁদপুরের একমাত্র স্টুডিও। ১৯৮০/৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দিলিপ দাদা। তিনি হাজীগঞ্জ উপজেলার অধিবাসী ছিলেন। সুদর্শন কালো কোঁকড়ানো চুলের অধিকারী দেখতে অনেকটা নায়ক নায়ক লাগতো। মিষ্টভাষী দাদার সাথে আরেকজন লম্বা আফগানি সুদর্শন নায়ক ছিলেন মন্টু পাটওয়ারী। অনামিকা ও কনিষ্ঠা দু আঙ্গুলে দুটি বড় বড় নখ রাখতেন। আমি আজও এ রকম নখ বাস্তবে আর কোথাও দেখিনি। দু নায়কের এ স্টুডিওতে বিশেষত বাজারের দিনগুলিতে বড় ভিড় ছিল। অকৃতদার মন্টু ভাই ১৯৮৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। দিলিপ দা কোথায় আছে আমার জানা নেই।
শ্রীকৃষ্ণ মাঝি বাড়ির লোকজন বেশ শিক্ষিত ছিল। এসপি নিবাস মাঝির নাম ছিল সুবিদিত। আমার জানামতে তার আগে হাইমচর থানায় কোন এসপি পদমর্যাদায় কর্মকর্তা ছিল কিনা আপনারাই বলতে পারবেন। যদিও তিনি পুলিশের ডিআইজি হিসেবে রিটায়ার্ড করেছেন। সুনীল কৃষ্ণ মাঝি, রাধেশ্যাম মাঝি দুজনই হাইমচর বালিকা বিদ্যালয়ের অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে বহু বছর শিক্ষকতা করেছেন। পরে ১৯৮৭ সালে সরকারিকরণ হলে এ বিদ্যালয়ে থেকে যান, যা বর্তমানে হাইমচর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। এ দুজন গুণী শিক্ষক ১৯৮৮ সালের নদীভাঙন প্রতিরোধ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে সুনীল দাদা ক্যাশিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল এবং বাড়ির রাস্তার পূর্ব পাশেই ছিল মোবারক রাঢ়ীর ধান-চালের ব্রয়লার মেশিন। বছরের পর বছর ইট-সুরকির মাঠে মায়েরা ধান কাটতে দেখেছি। মোবারক রাঢ়ীকে গরমের দিনে সন্ধ্যা অবধি গেঞ্জি গায়ে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছি। ১৯৮৮ সালের ভাঙনে তার মিলটি বাঁচলে ১৯৮৯ সালে তার ব্রয়লার মিলটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
সেকান্দর খাঁ ও মনা বেপারী ১৯৮৬/৮৭ সালে হাইমচর বাজারের পূর্ব মাথায় সিনেমাহল ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেখানে ৩-৬টা ম্যাটিনি শো ৬-৯টা দ্বিতীয় শো ৯-১২টা নাইট শোসহ ৩টি শো দেখানো হতো। আমরা ঈদের দিন মর্নিং শো দেখার জন্য যেতাম। যদিও তারপর চরভৈরবী বাজারে মেঘনা সিনেমা হলে বহু বছর অর্থাৎ চরভৈরবী বাজার ভাঙার পূর্ব পর্যন্ত মেঘনা সিনেমা চলমান ছিল। সম্ভবত লতিফ শনি কিংবা হজরত শনির বড় লম্বা ঘরে হাইমচর বাজারের সিনেমাহলটি ছিল। বাঁশের উপর কাঠের তক্তা বসিয়ে বেঞ্চ বানানো ছিল। তার উপরেই বসার ব্যবস্থা বেশ চমৎকার চলচে সিনেমা হল।
সুলতান ভাইয়ের সাইকেল ভাড়ার দোকানটি ছিল শ্রীকৃষ্ণ মাঝিদের বাড়ির ঠিক সামনে। যত্তসব পুরাণ ভাঙাচোরা সাইকেল ভাড়া দিতেন। ঘণ্টা সাধারণত ২/৩ টাকায় দিতেন। কতবার তার দোকানের সাইকেল ভাড়া নিয়ে রাস্তা থেকে ডাইরেক্ট ধানক্ষেতে পড়ে নাকানিচুবানি খেয়েছি তার ইয়ত্ত্যা নেই। সুলতান ভাই পরে বর্তমান গার্লস স্কুলের পাশে বাড়ি করেছিলেন, সেখানে থাকেন কিনা আমার জানা নেই।
বাজারের পূর্ব মাথায় আরো দুজনের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ছিলÑপ্রয়াত হাবিবুর রহমান আখন (হাবু আখন) ও প্রয়াত আব্দুর রব মোল্লা। রব মোল্লার টিন, রড, সিমেন্টের ব্যবসা ছিল। সম্ভবত ১৯৮০/৮১ সালে হাইমচরে তেল-গ্যাস পাওয়া গেছে বলে রিউমার উঠেছিল। বাপেক্স (ইধহমষধফবংয চবঃৎড়ষবঁস ঊীঢ়ষড়ৎধঃরড়হ ধহফ চৎড়ফঁপঃরড়হ ঈড়সঢ়ধহু খরসরঃবফ)-এর বিশাল গাড়িবহর লতিফ শনির ধান চালের ব্রয়লার মাঠের ভিতর (পার্ক) জমা হয়েছিল। এ রকম বিশাল বিশাল গাড়ি, যা আমরা আগে কখনো দেখিনি।
ওয়াপদা বেড়িবাঁধ হয়ে হাইমচর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে (বয়েজ স্কুল) যাওয়ার রাস্তা ছিল। কালিখোলা থেকে যাওয়া রাস্তাটি ডাক্তার নেসার গাজীর ফার্মেসির পাস দিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে থানার সাথের রাস্তায় মিলিত হয়েছে। অন্য রাস্তাটি সিএসডি গোডাউনের পাশ দিয়ে বয়েজ স্কুল, থানা পার হয়ে পরিবার পরিকল্পনা অফিস পার হয়ে সাজাহান সরকার, সিরাজুল ইসলাম সরকারের বাড়ি পার হয়ে বটতলার সাথে উত্তর দক্ষিণমুখী রাস্তার সাথে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণমুখী রাস্তাটি আমান উল্যাহ মাঝির (খান সাহেব আলী হোসেন মাঝির বড় ছেলে) বাড়ির সামনে দিয়া চরভৈরবীর দিকে চলে গিয়েছিল। উত্তরমুখী রাস্তাটি নীলকমল লঞ্চঘাটের দিকে ৩/৪ মাইল পর্যন্ত আমরা দেখেছি। বর্ষাকালে ধান ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে দলবেঁধে বাটা মাছের শত শত ঝাঁক পানিতে খেলা করতে দেখেছি যা আমার মনকে এখনো শিহরিতো করে।
১৯৭৮/৮৯ সালে বয়েজ স্কুলটি ছিল টিনের, যা উত্তর-দক্ষিণমুখী রাস্তার পূর্ব ভিটিতে অর্থাৎ রাস্তার সাথে এবং তার সামনে পশ্চিম দিকে মাঠ ছিল। উত্তর ভিটিতে ছিল হাইমচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার দুই বন্ধু সাইফুল (ইতালী প্রবাসী) এবং রশীদ (লক্ষ্মীপুরে একটি হাইস্কুলে কর্মরত) এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। পরে বিদ্যালয়টি পাইলট বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। নাম হয় হাইমচর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। স্থানান্তরিত হয় থানা সংলগ্ন রাস্তার সাথে। বিদ্যালয়ের সাথে পশ্চিম পাশে দু-একটি হিন্দু বাড়ি ছিল। তারা বাড়ি বিক্রি করায় বিদ্যালয়ের জায়গা বাড়ানো এবং খেলার মাঠ বড় করা সহজ ছিল। মাঠের উত্তর পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে সম্ভবত একটি হিন্দু বাড়ি ছিল তার পেছনেই ছিল হামিদ পাটওয়ারীর ধান-চালের ব্রয়লার মেশিনের ধান শুকানোর মাঠ। পাশেই ছিল নীলকমল ওসমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সদ্য যোগদানকৃত শিক্ষক ইমানুর রহমান স্যারের বাসা। আমরা তাকে রহমান স্যার বলেই ডাকতাম। স্যার সম্ভবত ১৯৮৫ সালে বিদ্যালয়ে যোগদান করেছিলেন এবং ২০০৬/২০০৭ সালে নিজ শহর জামালপুরে ফিরে গিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে নদী ভাঙার পর কিছুদিন মাঝি বাড়িতে ছিলেন। তারপর তেলীর মোড সংলগ্ন তেলী বাড়ির পেছনে এবং রাস্তার সাথে ১৯৯১ সাল হতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করছিলেন। বর্তমানে জামালপুর থাকলেও আমার মতো অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর প্রিয় অভিভাবক হিসেবে তিনি আমাদের মাঝে আলোকবর্তিকা হিসেবে বেঁচে আছেন।
১৯৮০ সালে হাইমচর হাইস্কুলে নৃত্যের তালে তালে সংগীতানুষ্ঠানটি ছিল সেরা আর্টেস্টিক অনুষ্ঠান। মাঠভর্তি মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। যেহেতু নৃত্যশিল্পীযোগে সংগীতের লহরীতে নৃত্যর মূর্ছনায় তাল-লয় সব ঠিক রাখতে স্টেজসহ সব কিছু সাজাতে সময়ের প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু আমজনতার সহ্য হচ্ছিল না। মাঠ থেকে হৈ-হুল্লোড় ভেসে আসছিল আর মাইকে সিরাজুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল করিম, আজহারুল ইসলাম বাচ্চু স্যারের ধৈর্য ধরার আহ্বান আমরা শুনছিলাম। অবশেষে ২/৩ ঘণ্টার মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠানটি সুচারু রূপেই সম্পন্ন হয়েছিল।
১৯৮২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিটি থানাকে উপজেলা এবং মহকুমা জেলায় রূপান্তরিত করেন। সে হিসেবে চাঁদপুর জেলা এবং হাইমচর উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে জনমুখী প্রশাসন বিনির্মাণে এটি একটি মাইলফলক। থানা থেকে উপজেলায় পরিণত হওয়ার কারণে হাইমচর বাজার আরো গুরুত্ব লাভ করে। ১৯৮৩ সাল হতে বয়েজ স্কুল মাঠ হয়ে উঠে ক্রীড়া সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জনসভার কেন্দ্রস্থল।
১৯৮৬ সালে নীলকমল ওসমানীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই ষষ্ঠ শ্রেণীতে। সেই সময়ে বয়েজ স্কুল এবং গার্লস স্কুল থাকতো এক কাতারে নীলকমল হাইস্কুল থাকতো তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। যে কোন ক্রীড়া দিবসে নীলকমলের পক্ষ হয়ে সারাদিন মাঠে থাকতেন প্রধান শিক্ষক এ আর সুলতান মাহমুদ, আবদুল মতিন খান, আবুল কালাম মিয়া, ইমানুর রহমানসহ অনেকে। সাথে যেতেন একদল যুবক, যারা বিদ্যালয়ের পক্ষ হয়ে লড়াকু ভূমিকায় থাকতেন। তাদের মধ্য দু-একজনের নাম করতে হয়Ñজাহাঙ্গীর মাঝি, মহসীন সর্দার, বাবুল পাটওয়ারী, মুন্না খানসহ অনেকে। বয়েজ ও গার্লস স্কুলের পক্ষ হয়ে সিরাজুল ইসলাম সরকার, আজহারুল ইসলাম বাচ্চু, মাওলানা আবদুল করিম (কাঞ্চন মাওলানা), জয়দেব বাবু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সুনীল মাঝি, রাধেশ্যাম মাঝিসহ অনেক শিক্ষক। বয়েজ স্কুলের অনেক প্রাক্তন ছাত্র যাঁরা তাদের পক্ষ হয়ে ভূমিকায় থাকতেন তাদের দু-একজনের নাম স্মরণ করতে হয়Ñব্যাংকার রুহুল আমিন, জিএম জাহিদ হোসেন, কাঞ্চন হাজী, জাহান শরীফসহ অনেকে।
১৯৮৬ সালের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন হয়েছিল ৩ দিনব্যাপী। তখন মেঘনা নদী হাইমচর বাজার থেকে বেশি দূরে ছিল না। পুরো দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল নদীর পাড়। শরীর চর্চা প্রতিযোগিতা বরাবরের মতই নীলকমল ভালো করলেও প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থান নির্ধারণ করা হয়নি, যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হলো, চললো সারাদিন সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। বয়েজ স্কুলের আবিদ তালুকদার (সদ্য প্রয়াত) নীলকমল স্কুলের আলী হোসেন, কুদ্দুস পাটওয়ারী (শহীদ কুদ্দুস পাটওয়ারী) ছিল প্রতিযোগিতার মূল প্রতিযোগী। মাঠের পশ্চিম দিক উত্তর দিক এবং দক্ষিণ দিক থাকতেন বয়েজ স্কুলের ছাত্র এবং সমর্থকবৃন্দ শুধু উত্তর পূর্ব দিকের কর্নারে থাকতেন নীলকমল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। কতবার যে নীলকমল বনাম হাইমচর বয়েজ ধাক্কাধাক্কি, দৌড়াদৌড়ি, হাতাহাতি হয়েছে তা ইয়ত্ত্যা নেই। ২০০৭ সালে হাইমচর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর আর কখনো দু স্কুলের মারামারি হয়েছে বলে আমার জানা নাই। (চলবে)