প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২১, ০০:০০
‘গত দেড় বছর ধরে খুবতো মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করলেন, আশানুরূপ ফলাফল যেহেতু মিলছে না এবার একটু উল্টো পথে হাঁটুন। গাছ না ধরে গাছের শেকড় নিয়ে কাজ করুন। যে মানুষগুলো সোস্যাল ডিস্টেন্স মানছে না, মাস্ক পরছে না, অযথা চায়ের দোকানে এসে আড্ডা জমিয়ে দিচ্ছে, মূল সড়কে পুলিশের সাথে লুকোচুরি খেলে অলিতে-গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের সন্তানদের মোটিভেট করুন। যেন তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব সে নেয়। আমি মনে করি, কোনো সন্তান যদি তার বাবাকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় 'বাবা তুমি মাস্ক পরো না কেন? এই বাক্যটি উচ্চারণ করে তবে সে বাবা মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হবেন না। সন্তান যদি বাবাকে বলে, লকডাউনের মধ্যে তুমি বাইরে বের হলে আমি আজ ভাত খাবো না, তুমি বাসায় থাকো। তুমি বাইরে গেলে তোমার জন্যে আমি অসুস্থ হয়ে পড়বো। তুমি কি চাও আমি অসুস্থ হই? প্রশ্নটা বাবাকে ভাবাবে। ওই সন্তানের কথা বাবা-মা ফেলতে পারবেন না। তাই এই ছোট ছোট শিশুকে কাজে লাগাতে হবে, শিশুদের মোটিভেট করতে হবে। করোনাকালীন এ যুদ্ধে শিশুরাই হতে পারে সবচেয়ে বড় সৈনিক। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলেন চাঁদপুর-৫ আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মেজর (অবঃ) রফিকুল ইসলামের সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর উত্তম খেতাব প্রদান করে। সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও দেশের প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারে তিনি মন্ত্রীর পদমর্যদায় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের এই অকুতোভয় যোদ্ধা করোনাকালীন যুদ্ধে তাঁর জেলা চাঁদপুরের করোনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কী ভাবছেন তা নিয়ে কথা বলা হয় দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় নিজের চাপা কষ্টের কথা, আক্ষেপের কথা, করোনাকালীন সময়ে কী ভাবছেন জানালেন সে কথাগুলো।
পুরো জেলার লক্ষাধিক শিশুকে কিভাবে, কোনো প্রক্রিয়ায় মোটিভেট করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। একজন পুলিশের পক্ষে প্রত্যেক ঘরে পৌঁছানো সম্ভব নয়, কিন্তু একজন শিক্ষক করোনাকালীন পাঠদান করাতে গিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর সাথে অনলাইন ক্লাস বা জুম অ্যাপে কানেক্টেড রয়েছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার গল্প শোনাক। ৭১-এর যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মত করোনাকালীন যুদ্ধে শিশুরাও চাইলে বীর যোদ্ধা হতে পারে, ঘরে থেকে এ যুদ্ধে অংশ নিতে পারে শুধু মাত্র তার বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যদের ঘরে থাকতে বা বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গেলে মাস্ক পরতে বাধ্য করার মাধ্যমে।
মেজর রফিকুল ইসলাম বলেন, মূল কথা হলো বাবা-মা তার সন্তানের কথা শুনবে আর সন্তান শিক্ষকের কথা শুনবে, শিক্ষক প্রশাসনের কথা শুনবে। এভাবে একটি বলয় তৈরি করতে হবে। পুলিশ সড়কে হার্ড লাইনে থাকুক, শিক্ষকগণ দেশের এই দুর্দিনে নীরবে নিভৃতে সফট লাইনে প্রতিটি পরিবারকে বুঝানোর দায়িত্ব নিক। নরমে-গরমে তবেই এর সুফল মিলবে। শুধুমাত্র পুলিশ দিয়ে জনগণকে ঘরে আটকে রাখাটা হবে চোর-পুলিশ খেলার মত। তাই জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করবো, পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি জেলার সকল শিক্ষককে কাজে লাগান। জেলার প্রতিটি এলাকাকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিন। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রীর জেলাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে শিক্ষকরাই শিশু সৈনিকদের দিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে।
‘যেখানে প্রশাসনের লাঠি চার্জে কাজ হচ্ছে না, সেখানে শিশুদের মোটিভেশনালের আবেগ কতটুকু কার্যকর হবে?’ এই প্রশ্নের জবাবে বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত এই বীর যোদ্ধা জানান, আমাদের দেশটা স্বাধীন-ই হয়েছে আবেগ দ্বারা। মানুষকে অর্থ দিয়ে, লাঠি চার্জ করে যুদ্ধে নামানো যায়নি। দেশপ্রেমের আবেগেই তারা মাঠে নেমেছিলো। যুদ্ধক্ষেত্রে 'আবেগ' শব্দটি অনেক মূল্যবান, যদি তা যথাযথ কাজে লাগানো যায়। একাত্তরে 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি..' পুরো গানটাইতো আবেগ ছিলো।
রাস্তাঘাটে নানা অজুহাতে ঘুরে বেড়ানো জনগণকে নিয়ন্ত্রণে আনার বিষয়ে প্রবীণ এই সাংসদ চাঁদপুর কণ্ঠকে বলেন, জনগণকে কে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে? আমেরিকা পারেনি, ইউরোপ পারেনি, ইতালি-ভারত পারেনি, আর চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক পারবেন? আইন প্রয়োগ করে, জনগণকে দু'দিন ঘরে বন্দি রাখা যায়, কিন্তু সপ্তাহব্যাপী, ১৪ দিন ধরে জনগণকে ঘরে আটকে রাখাটা ইম্পসিবল। মাস্ক পরা ছাড়া কোনো ব্যক্তি রাস্তায় বের হলে তাকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে, বাড়ি থেকে আনতে ভুলে গেছি। এই ভুলে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য তার বাড়ির শিশুটিকে কাজে লাগাতে হবে। কাজটি অনেক ছোট মনে হচ্ছে কিন্তু কার্যকর করতে পারলে তা বিপ্লবে রূপ নিবে।
‘বর্তমান জেলা প্রশাসক জেলার করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন কি’ এমন প্রশ্নে সেক্টর কমান্ডার বলেন, পরামর্শতো অনেকই দেওয়ার আছে। কিন্তু পরামর্শ গ্রহণের জন্যেতো কেউ কোনদিন আমাদের নক করেননি। জানতে চাননি জেলা নিয়ে আমরা কিছু ভাবছি কি-না। চাঁদপুর কণ্ঠ-ই প্রথম আমার জমানো কথাগুলো শুনতে চাইলো। দায়িত্বশীল কেউতো কোনোদিন প্রশ্ন করেনি করোনার এই সংকট মোকাবেলায় আপনি কি ভাবছেন? তাই আমি শুধু আমার নির্বাচনী এলাকা শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ নিয়েই ভাবছি। সার্বক্ষণিক তা নিয়েই ভাবি।
‘আপনার নির্বাচনী এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলবেন কি’ এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার হাজীগঞ্জটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও শাহরাস্তি নিয়ে আমি বড্ড দুশ্চিন্তায় আছি। শুরুতেও আমি অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়ে কাজ করেছি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আরো কিছু অক্সিজেন সরবরাহ করবো। হেলথ মিনিস্ট্রির সেক্রেটারির সাথে কথা বলেছি। আমার এলাকার হেলথ সামগ্রীর চাহিদার কথা জানিয়েছি। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। প্রতিদিনই করোনার আপডেট নিচ্ছি। শাহরাস্তির করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে পৃথক কর্ম পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করি তা কাজে দিবে। আমি অতীতে বলেছি আপনাদের পত্রিকার মাধ্যমে, শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জবাসীকে আবারো বলছি, আপনারা শুধু তিনটি কাজ করুন। মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সোস্যাল ডিস্টেন্স ম্যান্টেইন করা। এই তিনটি কাজ করতে গিয়ে আপনাদের কি প্রয়োজন তা আমাকে জানান। মাস্ক লাগলে বলুন। হেল্থ সামগ্রী কী লাগবে তা জানান। এই তিনটি কাজই পারে আমাদের বাঁচা মরার মধ্যখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে।