সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

আলোকিত মানুষ হাজী কাউছ মিয়ার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ

আলোকিত মানুষ হাজী কাউছ মিয়ার স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ
স্টাফ রিপোর্টার ॥

মুক্তিযুদ্ধ একটি উজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলার আপামর জনগণ ১৯৭১ সালে একই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন পতাকা। যে স্বাধীন পতাকা এ দেশের কথা বলে, কথা বলে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের। আজকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে গোটা জাতি।

যুদ্ধকালে দেশের অনেক মানুষ অস্ত্র হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন ছিলো। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাদেরই একজন হাজী মোঃ কাউছ মিয়া। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী অঙ্গনে আলোচিত সমাজসেবক ও ব্যবসায়ী তিনি। দেশের আলোকিত এই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ জন্মস্থান চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া নিজের আত্মীয়-স্বজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন।

হাজী কাউছ মিয়ার বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা করেন। তার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দামামায় কাউছ মিয়ার আর পড়াশোনা এগোয়নি। বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরাণবাজারে স্টেশনারী দোকান দেন। পরে তিনি ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট ছিলেন। ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। চাঁদপুরে ব্যবসা করার সময় রেলওয়ে বড়স্টেশন এলাকা দিয়ে তার যাতায়াত ছিলো দেশের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক এলাকা পুরাণবাজারে।

তিনি তখন স্বচক্ষে দেখেছেন পুরাতন রেল স্টেশনে পাক হানাদার বাহিনীদের টর্চার সেল। এখানে তারা ক্যাম্প বসিয়ে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতন করতো। যাতায়াতের সময় অনেক বাঙালিকে তিনি বলেছেন, তোরা এদিক দিয়ে যাইস্ না, ওরা ধরবে। সেই সময় অনেককে সতর্ক করেছিলেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের দোকানের পণ্য সামগ্রী দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিতেন না। এছাড়া নানাভাবে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু মানুষকে সহযোগিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিষয়ে আলোচনাকালে তিনি এসব কথা জানান।

কাউছ মিয়ার এক চাচাতো ভাই রুস্তম আলী বেপারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ আইটি স্কুলের সামনে হানাদার বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন প্রত্যককে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে নগদ অর্থ প্রদান করা হবে। বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত সেই অর্থ রুস্তম আলী বেপারীর স্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হয়। রুস্তম আলী বেপারীর স্ত্রী এখন জীবিত নেই। এখন থেকে চার বছর আগে ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শহীদ রুস্তম আলী বেপারীর তিন ছেলে ও ১ মেয়ে রয়েছে। বড় মেয়েকে হাজী মোঃ কাউছ মিয়া বিয়ে দেন এবং মেয়ের জামাইকেও চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন।

বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে নারায়ণগঞ্জে জায়গা কেনার জন্যে কাউছ মিয়া সে সময় তার চাচাতো ভাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীর স্ত্রীকে (তার ভাবীকে) বলেছিলেন। কিন্তু ভাবী তার কথা শোনেননি। ওই টাকা দিয়ে তৎকালে নারায়ণগঞ্জে চার বিঘা জমি রাখা যেতো।

কাউছ মিয়া বলেন, তার কথা যদি তখন ভাবী শুনতো, সেই জায়গার দাম এখন শত কোটি টাকা হতো। ভাবী তার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন। এখন ভাবী বেঁচে নেই। শহীদ এই পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের এখন পর্যন্ত তিনি সহযোগিতা করে আসছেন। তাদেরকে কাউছ মিয়া সরকারি সহযোগিতা নিতে দেননি। তিনিই সহযোগিতা করছেন। তাঁর আরেক মামাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা আঃ মালেক দেওয়ান। বাড়ি তরপুরচ-ী আনন্দবাজার। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আঃ মালেক দেওয়ান মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছেন।

১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা ৭১ বছর এককভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন কাউছ মিয়া। বর্তমানে তাঁর বয়স ৯২ বছর। স্বাধীনতার আগে এবং পরে সিআইপি মর্যাদার সর্বাধিক ১৯ বার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জনের বিরল রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ২০২১ সালে মুজিববর্ষের চমক ছিলেন কাউছ মিয়া। কেননা মুজিববর্ষে সারা দেশের মাত্র একজনই দেশসেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কর প্রদানে সততা, আন্তরিকতা ও স্বপ্রণোদনার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে জাতীয় রাজস্ব খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় দেশসেরা করদাতার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। সারাদেশে এ সম্মাননা তিনি একাই পেয়েছেন। ২০২০-২১ করবর্ষেও বাংলাদেশে সর্বোচ্চ করদাতাদের মধ্যে তিনি প্রথম হয়েছেন।

১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাউছ মিয়াকে নিরাপত্তার জন্য একটি রিভালবার লাইসেন্স প্রদান করেন। যার নং-১৪। তিনি সেই রিভালবারটি বয়সের কারণে নিজের ইচ্ছায় ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার বংশাল থানায় সরকারি নিয়ম অনুুযায়ী জমা দেন।

ব্যবসা জগতে তিনি এক জীবন্তকিংবদন্তী। মানবসেবার উজ্জ্বল নক্ষত্র। দেশবাসী হাজী কাউছ মিয়াকে একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক ও দানবীর হিসেবেই চিনেন।

হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার বড় বাবার নাম হাজী মোঃ মুসলিম মিয়া বেপারী, দাদার নাম হাজী মোঃ সবদ আলী মিয়া বেপারী (সবদ হাজী)। পিতা হাজী মোঃ আব্বাস আলী মিয়া বেপারী ও মাতা জমিদার কন্যা মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। তারা কেউ বেঁচে নেই। তাদের বাড়ির বেশ নামডাক ছিলো। এক নামে হাজী বাড়ি হিসেবে চিনতো সবাই। তার দাদারা ছিলেন ৬ ভাই। তারা পায়ে হেঁটে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন। তখন হজ্বে যেতে সময় লাগতো ৬ মাস, এখন সময় লাগছে ৬ ঘণ্টা।

কাউছ মিয়ার বড়বাবা অর্থাৎ নানার পিতা আজগর দেওয়ান। তিনি ছিলেন সতেরশ’ সালে ত্রিপুরা ডিস্ট্রিকের প্রতাপশালী জমিদার। আজগর দেওয়ানের ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে। উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলেমেয়ে আটজনই ছিলেন জমিদার। আজগর দেওয়ানের কনিষ্ঠ পুত্র জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম। ১৮৬৫ সালে তিনি কোলকাতা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাইটেল পাস করেন।

কাউছ মিয়া তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে কখনো কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তির নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করেননি। তার বাপদাদারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি। এমনকি পূর্বপুরুষদের কেউ রাজনীতি করেনি। এ জন্যে কাউছ মিয়া এবং তার ছেলেরাও কোনো রাজনীতি করেন না।

তিনি তার মরহুম পিতার নামে উত্তর তারাবুনিয়া আব্বাস আলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে (কবি নজরুল সড়কে) মায়ের নামে ফাতেমা খাতুন মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি চাঁদপুর গুয়াখোলা আবাসিক এলাকায় মদিনা জামে মসজিদ এবং স্ট্র্যান্ড রোডে (বর্তমান কবি নজরুল সড়কে) আল-আমিন স্কুলের পাশে বোগদাদীয়া জামে মসজিদ গড়ে দিয়েছেন। এ দুটি মসজিদের মোতওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়