প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা
সজল চৌধুরী
তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমি ভুল নিশ্চয় করব। আমি ফেরেস্তা নই। আমি মানুষ-আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবেÑআই ক্যান রেক্টিফাই মাইসেল্ফ। আমি যদি রেক্টিফাই করতে পারি সেটাই আমার বাহাদুরি। আর যদি গো ধরে বসে থাকি যে না আমি যেটি করেছি সেটি ভালো-দ্যাট ক্যান’ট বি হিউম্যান বিং। ফেরেশতা নই যে সবকিছু ভালো হবে। হতে পারে, ভালো হতে পারে। উই উইল রেকটিফাই ইট। এই সিস্টেম ইন্ট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে আরও খারাপ হচ্ছেÑঅলরাইট রেকটিফাইড ইট। কেননা আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষনহীন সমাজ গড়তে হবে।’ (তথ্যসূত্র : হাসান মোরশেদ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ)
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, জীবন-জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, শোষণহীন সমাজ, ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্যতা, গ্রামীণ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে প্রয়োজন ছিলো বৃহৎ কর্মপরিকল্পনার। যেখানে অতি অল্প সময়ে পুনর্বাসন নির্মাণ-পুনঃনির্মাণ, নতুন নতুন অবকাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এর এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ তাকে গ্রহণ করতে হয়েছিলো। জনজীবন যেনো কোনোভাবেই বিঘিœত না হয়, খাদ্যাভাব, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো যেনো সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে সক্ষম হয়, নিরাপত্তা যেনো নিশ্চিত হয় প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে এসবের দিকে লক্ষ্য রেখেই কীভাবে সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক মুক্তির দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় এগুলোই প্রথম কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা বললে মোটেও ভুল হবে না, স্বাধীন দেশে এই বৃহৎ নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে অনেক কণ্টকময় পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সময়কে পাড়ি দিতে হয়েছিলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর অবিচল থেকেই বঙ্গবন্ধু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন সদ্য স্বাধীন হওয়া সোনার বাংলাদেশ গঠনকল্পে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল ছিলো তাঁর সেই স্বপ্নের যাত্রার অভিমুখে অগ্রসরের খুব অল্প কিছু সময়। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন বিশ্বের ইতিহাসে আজও তা বিরল এবং সকলের অনুকরণীয়।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সঠিক শিক্ষা ছাড়া দেশ গঠন কখনোই সম্ভব নয়। তাই তো তিনি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশে গণমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুদ্ধকালীন সময়ে পাক-হানাদার বাহিনীর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, শিক্ষা অবকাঠামোগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করা। বিনষ্ট হয় শিক্ষা উপকরণের অনেক কিছু। যার দরুণ যুদ্ধপরবর্তী অতি অল্প সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্যে তৎকালীন সরকার আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন শিক্ষাব্যবস্থার পুনসংস্কারের জন্যে। বৃহৎ একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন দেশের উচ্চশিক্ষার অবকাঠামোগুলো পুনরুদ্ধার করার জন্যে এবং সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে। তাছাড়া মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। সেই সাথে অতি দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যে বই বিতরণ, বেতন মওকুফ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সকল ধরনের শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। গঠন করা হয় শিক্ষা কমিশন যার নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা। শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় মানোন্নয়ন ও গণমুখী করাই যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো। দেশের সকল শিক্ষার্থী যেনো দেশের সকল প্রান্তে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেজন্যে গ্রামগুলোতেও তৈরি করা হয় নতুন নতুন বিদ্যালয়-কলেজ।
বঙ্গবন্ধুর ছিলো শিক্ষা আর শিক্ষকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন নাজুক ঠিক সে অবস্থাতে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন জাতিকে সুগঠিত করতে হলে সর্বপ্রথম দরকার সুশিক্ষা। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যেনো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো ধরনের ভেদাভেদ সৃষ্টি না হয়, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের বিকাশ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নির্মাণে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মূল শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। শিক্ষাব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে গড়ে তোলার কথা। তৈরি করেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। প্রাথমিক স্তরে কোনো ছাত্র-ছাত্রী যেনো ঝরে না পরে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের। উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যে গঠন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। উচ্চ শিক্ষার বিকাশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার জ্ঞান আহরণের রাস্তা প্রশস্ত করেছিলেন। এমনকি ইসলাম শিক্ষার যথার্থ মর্মবাণী সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি একটি উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সোনার বাংলা গড়তে তিনি বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সে মানুষগুলো হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, আধুনিক এবং স্বাবলম্বী। তাই তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশের সকল স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্যে ‘সোনার বাংলা’ গঠনকল্পে অবিরাম ছুটে চলেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর যেখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে সব বিষয়ের আধুনিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে অচিরেই। সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা এবং সেই প্রয়োজন পূরণ করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কথা-যেখানে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশে সময়ের সাথে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের পথ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই উচ্চশিক্ষা বিস্তারে অন্ততপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলে আসছেন এবং বাস্তবায়ন করছেন, যা অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ও আশাব্যঞ্জক। পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশে উচ্চশিক্ষার এমন প্রসার সহজেই চোখে পরে না। যার জন্যে আমরা সবসময় গর্বিত। তবে একটি বিষয় আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হবে এই বিপুল পরিমাণ উচ্চশিক্ষিত সমাজকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায় যা দেশের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে। তাছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে আমরা আরো বিশদভাবে ভাবতে পারি। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্যে প্রতি বছর সরকারি তহবিল থেকে বড় একটি বাজেট ব্যয় করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা কি পারি না আমাদের চিন্তা-ভাবনা এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে আর একটু পরিবর্তন ও সমসাময়িক করতে ‘বঙ্গবন্ধুর’ সোনার বাংলা গঠনকল্পে? যা শুধুমাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেই নয়, দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে সর্বাত্বক ভূমিকা পালন করবে। আর নাগরিক হিসেবে আমাদের পথ চলার লক্ষ্যকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে সুসজ্জিত করতে হবে শিক্ষা প্রসারে।
লেখক : শিক্ষক ও স্থপতি; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য-পরিবেশ বিষয়ক পিএইচডি গবেষণারত। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা
সজল চৌধুরী
তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমি ভুল নিশ্চয় করব। আমি ফেরেস্তা নই। আমি মানুষ-আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবেÑআই ক্যান রেক্টিফাই মাইসেল্ফ। আমি যদি রেক্টিফাই করতে পারি সেটাই আমার বাহাদুরি। আর যদি গো ধরে বসে থাকি যে না আমি যেটি করেছি সেটি ভালো-দ্যাট ক্যান’ট বি হিউম্যান বিং। ফেরেশতা নই যে সবকিছু ভালো হবে। হতে পারে, ভালো হতে পারে। উই উইল রেকটিফাই ইট। এই সিস্টেম ইন্ট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে আরও খারাপ হচ্ছেÑঅলরাইট রেকটিফাইড ইট। কেননা আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষনহীন সমাজ গড়তে হবে।’ (তথ্যসূত্র : হাসান মোরশেদ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ)
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, জীবন-জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, শোষণহীন সমাজ, ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্যতা, গ্রামীণ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে প্রয়োজন ছিলো বৃহৎ কর্মপরিকল্পনার। যেখানে অতি অল্প সময়ে পুনর্বাসন নির্মাণ-পুনঃনির্মাণ, নতুন নতুন অবকাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এর এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ তাকে গ্রহণ করতে হয়েছিলো। জনজীবন যেনো কোনোভাবেই বিঘিœত না হয়, খাদ্যাভাব, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো যেনো সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে সক্ষম হয়, নিরাপত্তা যেনো নিশ্চিত হয় প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে এসবের দিকে লক্ষ্য রেখেই কীভাবে সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক মুক্তির দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় এগুলোই প্রথম কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা বললে মোটেও ভুল হবে না, স্বাধীন দেশে এই বৃহৎ নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে অনেক কণ্টকময় পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সময়কে পাড়ি দিতে হয়েছিলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর অবিচল থেকেই বঙ্গবন্ধু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন সদ্য স্বাধীন হওয়া সোনার বাংলাদেশ গঠনকল্পে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল ছিলো তাঁর সেই স্বপ্নের যাত্রার অভিমুখে অগ্রসরের খুব অল্প কিছু সময়। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন বিশ্বের ইতিহাসে আজও তা বিরল এবং সকলের অনুকরণীয়।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সঠিক শিক্ষা ছাড়া দেশ গঠন কখনোই সম্ভব নয়। তাই তো তিনি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশে গণমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুদ্ধকালীন সময়ে পাক-হানাদার বাহিনীর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, শিক্ষা অবকাঠামোগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করা। বিনষ্ট হয় শিক্ষা উপকরণের অনেক কিছু। যার দরুণ যুদ্ধপরবর্তী অতি অল্প সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্যে তৎকালীন সরকার আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন শিক্ষাব্যবস্থার পুনসংস্কারের জন্যে। বৃহৎ একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন দেশের উচ্চশিক্ষার অবকাঠামোগুলো পুনরুদ্ধার করার জন্যে এবং সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে। তাছাড়া মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। সেই সাথে অতি দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যে বই বিতরণ, বেতন মওকুফ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সকল ধরনের শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। গঠন করা হয় শিক্ষা কমিশন যার নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা। শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় মানোন্নয়ন ও গণমুখী করাই যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো। দেশের সকল শিক্ষার্থী যেনো দেশের সকল প্রান্তে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেজন্যে গ্রামগুলোতেও তৈরি করা হয় নতুন নতুন বিদ্যালয়-কলেজ।
বঙ্গবন্ধুর ছিলো শিক্ষা আর শিক্ষকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন নাজুক ঠিক সে অবস্থাতে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন জাতিকে সুগঠিত করতে হলে সর্বপ্রথম দরকার সুশিক্ষা। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যেনো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো ধরনের ভেদাভেদ সৃষ্টি না হয়, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের বিকাশ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নির্মাণে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মূল শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। শিক্ষাব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে গড়ে তোলার কথা। তৈরি করেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। প্রাথমিক স্তরে কোনো ছাত্র-ছাত্রী যেনো ঝরে না পরে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের। উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যে গঠন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। উচ্চ শিক্ষার বিকাশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার জ্ঞান আহরণের রাস্তা প্রশস্ত করেছিলেন। এমনকি ইসলাম শিক্ষার যথার্থ মর্মবাণী সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি একটি উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সোনার বাংলা গড়তে তিনি বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সে মানুষগুলো হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, আধুনিক এবং স্বাবলম্বী। তাই তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশের সকল স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্যে ‘সোনার বাংলা’ গঠনকল্পে অবিরাম ছুটে চলেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর যেখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে সব বিষয়ের আধুনিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে অচিরেই। সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা এবং সেই প্রয়োজন পূরণ করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কথা-যেখানে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশে সময়ের সাথে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের পথ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই উচ্চশিক্ষা বিস্তারে অন্ততপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলে আসছেন এবং বাস্তবায়ন করছেন, যা অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ও আশাব্যঞ্জক। পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশে উচ্চশিক্ষার এমন প্রসার সহজেই চোখে পরে না। যার জন্যে আমরা সবসময় গর্বিত। তবে একটি বিষয় আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হবে এই বিপুল পরিমাণ উচ্চশিক্ষিত সমাজকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায় যা দেশের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে। তাছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে আমরা আরো বিশদভাবে ভাবতে পারি। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্যে প্রতি বছর সরকারি তহবিল থেকে বড় একটি বাজেট ব্যয় করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা কি পারি না আমাদের চিন্তা-ভাবনা এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে আর একটু পরিবর্তন ও সমসাময়িক করতে ‘বঙ্গবন্ধুর’ সোনার বাংলা গঠনকল্পে? যা শুধুমাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেই নয়, দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে সর্বাত্বক ভূমিকা পালন করবে। আর নাগরিক হিসেবে আমাদের পথ চলার লক্ষ্যকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে সুসজ্জিত করতে হবে শিক্ষা প্রসারে।
লেখক : শিক্ষক ও স্থপতি; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য-পরিবেশ বিষয়ক পিএইচডি গবেষণারত। বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা
সজল চৌধুরী
তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বলেছিলেন, ‘আমি ভুল নিশ্চয় করব। আমি ফেরেস্তা নই। আমি মানুষ-আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবেÑআই ক্যান রেক্টিফাই মাইসেল্ফ। আমি যদি রেক্টিফাই করতে পারি সেটাই আমার বাহাদুরি। আর যদি গো ধরে বসে থাকি যে না আমি যেটি করেছি সেটি ভালো-দ্যাট ক্যান’ট বি হিউম্যান বিং। ফেরেশতা নই যে সবকিছু ভালো হবে। হতে পারে, ভালো হতে পারে। উই উইল রেকটিফাই ইট। এই সিস্টেম ইন্ট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে আরও খারাপ হচ্ছেÑঅলরাইট রেকটিফাইড ইট। কেননা আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষনহীন সমাজ গড়তে হবে।’ (তথ্যসূত্র : হাসান মোরশেদ, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ নির্মাণ)
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিলো ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, জীবন-জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, শোষণহীন সমাজ, ন্যায়বিচার, সামাজিক সাম্যতা, গ্রামীণ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, দুর্নীতি ও বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে প্রয়োজন ছিলো বৃহৎ কর্মপরিকল্পনার। যেখানে অতি অল্প সময়ে পুনর্বাসন নির্মাণ-পুনঃনির্মাণ, নতুন নতুন অবকাঠামো প্রতিষ্ঠাকরণের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ জনপদ থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন এর এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ তাকে গ্রহণ করতে হয়েছিলো। জনজীবন যেনো কোনোভাবেই বিঘিœত না হয়, খাদ্যাভাব, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো যেনো সম্পূর্ণভাবে পূরণ করতে সক্ষম হয়, নিরাপত্তা যেনো নিশ্চিত হয় প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে এসবের দিকে লক্ষ্য রেখেই কীভাবে সর্বাঙ্গীণ অর্থনৈতিক মুক্তির দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় এগুলোই প্রথম কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা বললে মোটেও ভুল হবে না, স্বাধীন দেশে এই বৃহৎ নির্মাণযজ্ঞ পরিচালনা করতে গিয়ে তাকে অনেক কণ্টকময় পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। সময়কে পাড়ি দিতে হয়েছিলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর অবিচল থেকেই বঙ্গবন্ধু সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন সদ্য স্বাধীন হওয়া সোনার বাংলাদেশ গঠনকল্পে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল ছিলো তাঁর সেই স্বপ্নের যাত্রার অভিমুখে অগ্রসরের খুব অল্প কিছু সময়। আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যে উদাহরণ স্থাপন করে গেছেন বিশ্বের ইতিহাসে আজও তা বিরল এবং সকলের অনুকরণীয়।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন সঠিক শিক্ষা ছাড়া দেশ গঠন কখনোই সম্ভব নয়। তাই তো তিনি যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশে গণমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুদ্ধকালীন সময়ে পাক-হানাদার বাহিনীর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, শিক্ষা অবকাঠামোগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সংঘটিত করা। বিনষ্ট হয় শিক্ষা উপকরণের অনেক কিছু। যার দরুণ যুদ্ধপরবর্তী অতি অল্প সময়ে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের জন্যে তৎকালীন সরকার আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন শিক্ষাব্যবস্থার পুনসংস্কারের জন্যে। বৃহৎ একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন দেশের উচ্চশিক্ষার অবকাঠামোগুলো পুনরুদ্ধার করার জন্যে এবং সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের জন্যে। তাছাড়া মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়। সেই সাথে অতি দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যে বই বিতরণ, বেতন মওকুফ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক সকল ধরনের শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। গঠন করা হয় শিক্ষা কমিশন যার নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা। শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় মানোন্নয়ন ও গণমুখী করাই যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো। দেশের সকল শিক্ষার্থী যেনো দেশের সকল প্রান্তে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সেজন্যে গ্রামগুলোতেও তৈরি করা হয় নতুন নতুন বিদ্যালয়-কলেজ।
বঙ্গবন্ধুর ছিলো শিক্ষা আর শিক্ষকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন নাজুক ঠিক সে অবস্থাতে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন জাতিকে সুগঠিত করতে হলে সর্বপ্রথম দরকার সুশিক্ষা। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যেনো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কোনো ধরনের ভেদাভেদ সৃষ্টি না হয়, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞানের বিকাশ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নির্মাণে শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মূল শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা। শিক্ষাব্যবস্থাকে বাধ্যতামূলক হিসেবে গড়ে তোলার কথা। তৈরি করেছিলেন নৈশ বিদ্যালয়। প্রাথমিক স্তরে কোনো ছাত্র-ছাত্রী যেনো ঝরে না পরে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের। উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্যে গঠন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। উচ্চ শিক্ষার বিকাশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে উচ্চশিক্ষার জ্ঞান আহরণের রাস্তা প্রশস্ত করেছিলেন। এমনকি ইসলাম শিক্ষার যথার্থ মর্মবাণী সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেননি। তিনি একটি উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সোনার বাংলা গড়তে তিনি বলতেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সে মানুষগুলো হবে অসাম্প্রদায়িক, শিক্ষিত, আধুনিক এবং স্বাবলম্বী। তাই তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি গণমুখী এবং সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশের সকল স্তরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্যে ‘সোনার বাংলা’ গঠনকল্পে অবিরাম ছুটে চলেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর যেখানে শিক্ষা থেকে শুরু করে সব বিষয়ের আধুনিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে অচিরেই। সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সমাজের প্রয়োজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা এবং সেই প্রয়োজন পূরণ করবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কথা-যেখানে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশে সময়ের সাথে উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের পথ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই উচ্চশিক্ষা বিস্তারে অন্ততপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলে আসছেন এবং বাস্তবায়ন করছেন, যা অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ও আশাব্যঞ্জক। পৃথিবীর আর অন্য কোনো দেশে উচ্চশিক্ষার এমন প্রসার সহজেই চোখে পরে না। যার জন্যে আমরা সবসময় গর্বিত। তবে একটি বিষয় আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হবে এই বিপুল পরিমাণ উচ্চশিক্ষিত সমাজকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায় যা দেশের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে। তাছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার পদ্ধতি নিয়ে আমরা আরো বিশদভাবে ভাবতে পারি। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার জন্যে প্রতি বছর সরকারি তহবিল থেকে বড় একটি বাজেট ব্যয় করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা কি পারি না আমাদের চিন্তা-ভাবনা এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে আর একটু পরিবর্তন ও সমসাময়িক করতে ‘বঙ্গবন্ধুর’ সোনার বাংলা গঠনকল্পে? যা শুধুমাত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেই নয়, দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে সর্বাত্বক ভূমিকা পালন করবে। আর নাগরিক হিসেবে আমাদের পথ চলার লক্ষ্যকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে সুসজ্জিত করতে হবে শিক্ষা প্রসারে।
লেখক : শিক্ষক ও স্থপতি; বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য-পরিবেশ বিষয়ক পিএইচডি গবেষণারত।