বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৬

ত্বরীকায়ে নকশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া

খাজা মুহাম্মদ আরিফুর রহমান তাহেরী নকশবন্দী মুজাদ্দেদী
ত্বরীকায়ে নকশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ জাল্লা শানুহুর যিনি আমাদেরকে ঈমানদার হিসেবে প্রিয় নবীর উম্মত করে দুনিয়াতে সৃষ্টি করেছেন। অসংখ্য দরুদ ও সালাম আল্লাহর প্রেমাস্পদ রাহমাতুল্লিল আলামিনের পবিত্র চরণ-যুগলে। এই পবিত্র প্রেমাস্পদ এঁর উত্তরাধিকারী হলেন আরেফীন ও সালেহীন ওলীয়ে কামেলগণ। পৃথিবীতে মানুষের হাজারো দুঃখে কষ্টে ভরা জীবন। তাই মানুষের জীবনে নেই কোনো শান্তি। এই শান্তি পাওয়ার অন্যতম ঠিকানা হচ্ছে মহান অলীয়ে কামেলগণের সোহবত বা সংস্পর্শ। কেননা, তাঁদের অন্তরে রয়েছে এক প্রেম সুধা। যা তাঁরা পান করেছেন মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এঁর নিকট থেকে। যাদের কথা পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাঁদের দুনিয়াতে কোনো ভয় নেই, পরকালেও কোনো চিন্তা নেই’। আর হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আল্লাহর মাহবুব ওলীগণের আলোচনা যে স্থানে হয় সে স্থানে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়’।

আউলিয়ায়ে কেরাম বলেন, মূর্খ সুফি শয়তানের হাসির পাত্র। আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ফকিহু ওয়াহেদুন আশাদ্দু আলাশ শাইতানে মিন আলফি আ-বেদে’ অর্থাৎ, একজন ফকীহ এক হাজার আবেদ থেকে শয়তানের উপর ভারী। (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।

ইলমবিহীন সাধনাকারীদেরকে শয়তান আঙ্গুল দ্বারা নাচায়, মুখে লাগাম ও নাকে রশি লাগিয়ে যেদিকে ইচ্ছা টেনে বেড়ায়। তখন তারা ভুল কাজ করলেও মনে করে ভালো কাজ করছে। তাই ইলম ও তাকওয়ার মাধ্যমেই ত্বরীকতের চর্চা করতে হবে।

পৃথিবীতে বহু ত্বরীকার ওলী আল্লাহ রয়েছেন। যারা সারা দুনিয়াতে প্রিয় নবীর প্রতিনিধি হয়ে ইলমে শরীয়ত ও ত্বরীকতের খেদমত করে যাচ্ছেন। সব ত্বরীকার মূল নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম থেকে। প্রিয় নবীর শিক্ষাকে শরীয়ত ও ত্বরীকতের আলোকে দুনিয়ার মানুষের অন্তরে এক আলো তৈরি করে দেন।

আমার আলোচ্য আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে পৃথিবীতে মশহুর ত্বরিকার অন্যতম নক্বশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া ত্বরীকা। এই দুই ত্বরীকার সম্পর্ক বা নিসবত শুরু হয়েছে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুর মাধ্যম দিয়ে। আফদালুন নাস বাদাল আম্বিয়া অর্থাৎ নবীগণের পরে মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ'লা আনহু। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু যিনি বর্তমানে রওজায়ে আত্বহারে রাসূলে পাকের কদম মোবারকের পাশেই শুয়ে আছেন। কোরআনে কারীমে তাঁকে ছানী ইছনাইন বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যা হিজরতের রাতের ঘটনার সাথে সম্পর্ক। ইমাম হাকেম রাহ. মুস্তাদরেক গ্রন্থে এবং হাজারাতুল কুদসে বর্ণিত আছে আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মা সাব্বাল্লাহু ফী সাদরী শাইয়ান ইল্লা সাব্বাততুহু সাদরে আবী বাকরীন’ আল্লাহ তায়লা আমি নবীর বক্ষে যা দান করেছেন, আমি তা আবু বকরের বক্ষে ঢেলে দিয়েছি। এই হিসেবে এই ত্বরীকার নিসবত হুযূর নবীয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হয়ে আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে শুরু। এভাবে এগুতে এগুতে আউলাদে রাসূল ইমাম জাফর সাদিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ইমাম জাফর সাদিক থেকে সুলতানুল আরেফীন বায়েজীদ বোস্তামী হয়ে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে ইমামুত ত্বরীকত সাইয়্যেদ খাজা বাহাউদ্দীন নক্বশেবন্দ আল বুখারী পর্যন্ত পৌঁছে। হালাতে মাশায়েখে নক্বশেবন্দীর মধ্যে রয়েছে খাজা বাহাউদ্দীন নক্বশেবন্দী দীর্ঘদিন সেজদায় পরে এমন একটি ত্বরীকা আল্লাহ তায়ালার কাছে চান, যে ত্বরীকায় অন্তর্ভুক্ত হলে মানুষ যেনো সহজেই আল্লাহ ও রাসূলকে পেয়ে যায়। দীর্ঘ আরাধনা ও রোনাজারির পরে আল্লাহ পাক খাজা বাহাউদ্দীন নক্বশেবন্দীকে এই ত্বরীকার নেয়ামত দান করেন এবং খাজা বাহাউদ্দীন নক্বশেবন্দি বলেনÑএই ত্বরীকায় যারা মুরিদ বা অন্তর্ভুক্ত হবেন, তারা আল্লাহ পাকের নিঃসন্দেহে নেয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই তরিকার দশটি মূলনীতি।

১. নেগাহ দাশৎ খাওয়াতির : যার অর্থ হচ্ছে অন্তরকে সর্বদা অযথা চিন্তা ও অনিষ্টকারিতা হতে রক্ষা করা।

২. বাযে গাশৎ : আল্লাহর যিকর করার সময় আল্লাহকে একমাত্র মাকসূদ মনে করা, তাঁর সন্তুষ্টি, মুহাব্বত ও দীদার কামনা করা।

৩. ইয়াদ করদ্ : মৌখিক ও আন্তরিকভাবে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহকে স্মরণ করা।

৪. হুশ র্দ দম্ : প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর আন্তরিক জিকিরের প্রতি স্মরণ রাখা।

৫. ইয়াদ-দাশৎ: সর্বদা আল্লাহর প্রতি মনোযোগী থাকা এবং কোনো কিছু তাঁর দৃষ্টির বাইরে নেই এই খেয়াল রাখা।

৬. নযর ব কদম : প্রতি কদমে খেয়ালের সাথে দৃষ্টি রাখা।

৭. খাল্ওয়াত দর আন্ জুমান : অন্তরকে সর্বদা আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ রাখা।

৮. সফর দর ওয়াতন : উত্তম চরিত্র অর্জন করা ও আল্লাহর দিকে আত্মিক বিচরণ।

৯. ওকূফে ক্বালবী : সর্বদা আপন অন্তরকে পর্যবেক্ষণ করা।

১০. অকূফে আদাদী : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যিকর বিজোড় ভাবে করা।

এই ত্বরীকার নিসবতের সাথে আরেকটি নিসবত যুক্ত হয়েছে। আর তা হচ্ছেÑত্বরীকায়ে মুজাদ্দেদীয়া। যার প্রবর্তক হযরত ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু। যিনি আকবরের দ্বীনে ইলাহীকে ধ্বংস করে দ্বীনে মুহাম্মদীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার রূহানী খেদমতের বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ তখনও হেদায়েত পেয়েছে এখনো পাচ্ছে। হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু সেই ওলী আল্লাহ যাঁর ত্বরীকায় অন্তর্ভুক্ত বা মুরিদ হলে রূহানী নেয়ামত থেকে কেউ মাহরুম বা বঞ্চিত হয় না। আর এই ত্বরীকায় চির মাহরুম যে সে আসতে পারবে না। হযরত ইমামে রাব্বানী মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু-এঁর আগমন সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইঙ্গিত রয়েছে, যা ইমাম জালাল উদ্দিন সুযূতী তাঁর কিতাবে বর্ণনা করছেন। হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মানুষের শরীরে ১০টি লতিফা রয়েছে। আর তা হচ্ছেÑ

১) লতিফায়ে কলব, যার স্থান বাম দুধের দুই আঙ্গুল নিচে।

২) লতিফায়ে রূহ, যার স্থান ডান দুধের দুই আঙ্গুল নিচে।

৩) লতিফায়ে সীর, যার স্থান বাম দুধের দুই আঙ্গুল উপরে।

৪) লতিফায়ে খফী, যার স্থান ডান দুধের দুই আঙ্গুল উপরে।

৫) লতিফায়ে আখফা, যার স্থান বক্ষের মাঝখানে।

৬) লতিফায়ে নফস, যার স্থান কপালের মধ্যভাগে।

আর বাকি চারটি, আব (পানি), আতশ (আগুন), বাদ (বাতাস) ও খাক (মাটি)।

একজন কামেল ওলীর সোহবতে থেকে এই লতিফায় আল্লাহর যিকির জারি করে আল্লাহর মাহবুব বান্দায় পরিণত হওয়া যায়। এই ত্বরীকায় সুন্নতে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর সবচেয়ে বেশি তাগিদ দেয়া হয়। পাশাপাশি পীর মুর্শিদের সোহবতকে ত্বরীকায় উন্নতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে ধরা হয়।

গাছতলা দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল ইরশাদ মহিউস সুন্নাহ আল্লামা খাজা আহমদ শাহ নক্বশেবন্দী মোজাদ্দেদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নক্বশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া ত্বরীকার অন্যতম ধারক ও বাহক ছিলেন। তাঁরই উত্তরসূরি আল্লামা খাজা আবুল খায়ের নক্বশেবন্দী মুজাদ্দেদী, আল্লামা খাজা তৈয়্যবুল ইসলাম নক্বশেবন্দী মুজাদ্দেদী এবং আল্লামা খাজা আবু তাহের নক্বশেবন্দী মুজাদ্দেদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিগণও কামেলে মোকাম্মেল ছিলেন। মাওলায়ে কারিম যেনো তাঁর পেয়ারা মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার ছদকায় এই মহান তরীকার ক্বুরবত পুরোপুরি হাসিল করার তাওফিক দেন। আমিন, বেজায়ে নাবীয়্যিল কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

খাজা মুহাম্মদ আরিফুর রহমান তাহেরী নকশবন্দী মুজাদ্দেদী : সাজ্জাদানশীন, ঐতিহ্যবাহী গাছতলা দরবার শরীফ, চাঁদপুর সদর, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়