প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
ফরিদগঞ্জের পূর্বাঞ্চলে পানিশূন্য সেচ খাল : বোরো আবাদ ব্যাহত হওয়ায় দিশেহারা কৃষকরা
ষাটের দশকে চাঁদপুর জেলার তিনটি ও পাশর্^বর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার তিনটি উপজেলা নিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প চাঁদপুর সেচ প্রকল্প (সিআইপি) তৈরি হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিলো বছরে একাধিক ফসল উৎপাদন। কিন্তু গত অর্ধশত বছর পরে এসে সেই উদ্দেশ্য বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে। সর্বশেষ কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে খালে পানিশূন্যতা। ফরিদগঞ্জের গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের আদশা গ্রামের খোরশেদ পাঠান (৫৫) নিজের ক্ষেতে বিআর ২৯ ধানের চারা লাগিয়েছেন। খালে পানি না থাকায় দূরের একটি পুকুর থেকে পানি কিনে এনে মাঠে দিয়েছেন। কিন্তু সেই পানিও শুকিয়ে গেছে। পাশের একটি ক্ষেতে বিআর ২৮ লাগানোর চিন্তা ছিল। কিন্তু পানির অভাবে গত এক মাসেও ধানের ক্ষেতে চারা লাগাতে পারেন নি। ধানের চারা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা গ্রামের অন্য কৃষকদের। পানির অভাবে হাহাকার গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের আদশা, খাজুরিয়া, মান্দারতলী, হুগলি, সাইসাঙ্গা এবং পাশর্^বর্তী রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুরা গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষকদের। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে খালে পানি সরবরাহ না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
|আরো খবর
১ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুরে সরেজমিনে গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, একরের পর একর জমি কৃষকরা ধানের চারা লাগানোর জন্য প্রস্তুত করে রাখলেও পানির অভাবে আবাদ করতে পারছেন না। মাঝেমধ্যে দুই-একটি জমিতে ধানের চারা রোপণের দৃশ্য দেখা গেলেও সেগুলোও পানি শূন্য। আবার বেশ কিছু জমি হাল না দেয়া অবস্থায় পড়ে আছে।
স্থানীয়রা জানায়, প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে খালে পর্যাপ্ত পানি চলে আসায় তারা সেচের মাধ্যমে ইরি-বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করতেন। কিন্তু এ বছর জানুয়ারি মাস পার হয়ে গেলেও পানি আসার খবর নেই।
আদশা গ্রামের কৃষক আবুল কালাম জানান, তিনি এ বছর নিজের পাশাপাশি কয়েক একর জমি আবাদের জন্য হাল দিয়েছেন। কিন্তু একমাস পার হলেও খালে এক ফোঁটা পানি নেই। কয়েকটি ক্ষেতে নিত্য ঘরের কাজে ব্যবহার করা পানি দিয়েছেন। এখনো বিস্তীর্ণ জমি আবাদের বাইরে। এভাবে চললে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। দুর্যোগের এ সময় আমরা নিজেদের এবং দেশকে সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হচ্ছি।
কৃষক টেলু পাঠান, খোরশেদ আলম জানান, তাদের বিআর ২৮ ধানের চারা ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। দুই একদিনের মধ্যে পানি আসলেও এই চারা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। অগ্রহায়ণ মাসে বীজতলা করেছি। এখন মাঘ মাসের অর্ধেক পার হয়েছে। এতদিন চারা ভালো থাকে না।
মান্দারতলী গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, আবুল খায়ের, মানিক হোসেন, মফিজুল ইসলাম জানান, পানির অভাবে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ধানক্ষেতে একবারের স্থলে কয়েকবার হাল দিতে হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেতে পানি কিনে ধান রোপণ করলেও পানির অভাবে পারছেন না বাকিগুলো। কয়েকশ’ একর ধানের আবাদী জমি এভাবে পড়ে রয়েছে। কয়েকটি স্থানে ধান ক্ষেত পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
আদশা গ্রামের সেচ ম্যানেজার আব্দুল কাদের জানান, তিনি সেচ মেশিন নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও খালে পানি না থাকায় কিছুই করতে পারছেন না। জানুায়ারির আগেই সেচের পানির জন্যে ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়া সেচের ড্রেনগুলো সংস্কার করে প্রস্তুত করলেও কোনো লাভ হয়নি। কৃষকরা বিভিন্ন পুকুর থেকে পানি চওড়া দামে কিনে ধান ক্ষেতে দিচ্ছে। এতে প্রভাব পড়বে ধানের মূল্যের উপর। আমি কয়েকশ’ একর জমিতে সেচের পানি দেই। এ বছর সেচের মাধ্যমে এক ফোঁটা পানিও দিতে পারি নি।
কৃষকরা জানান, এই এলাকাগুলো কিছুটা উঁচু হওয়ার কারণে পানি সঞ্চালনায় সমস্যা হয়। তাই খাল খনন করাও জরুরি। যাতে আমরা সারাবছর নিরবচ্ছিন্ন পানি পেতে পারি। বর্ষার সময় পানি পর্যাপ্ত থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে অন্য এলাকার তুলনায় কিছুটা কম থাকে। এতে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। এ বছরতো বিপদেই রয়েছি।
গুপ্টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নসহ পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকা এবং পাশর্^বর্তী উপজেলা রামগঞ্জের বেশ কিছু এলাকায় এ বছর এখন পর্যন্ত খালে পানি প্রবেশ করেনি। প্রতি বছর জানুয়ারির শুরুতে পানি আসলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম। বুধবার (১ ফেরুয়ারি) পর্যন্ত খালে পানি আসেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃষি অফিসসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কৃষকরা পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। আমি ইতিমধ্যেই খাল খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। তারা এসে পরিদর্শন করে গেছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, সরিষা চাষের জন্য এবার পাউবো খালে পানি ছাড়তে কিছুটা বিলম্ব করছে। তবে আশা করছি দুই একদিনের মধ্যে পানির সমস্যা সমাধান হবে। তিনি বিষয়টি জরুরিভাবে দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ড. সাফায়েত আহমেদ সিদ্দিকী বিষয়টি জেনে তাৎক্ষণিক উপজেলা কৃষি অফিসারকে সরেজমিন গিয়ে দেখার নিদের্শনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই পাশর্^বর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার ডিডিও এই বিষয়ে পাউবোকে বলেছেন। আমিও বলবো দ্রুত পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম জানান, সেচ খালের ওপর বেশ ক’টি ব্রীজ নির্মিত হওয়ায় খালে বাঁধ ছিলো। তাদেরকে বারংবার বাঁধ অপসারণের জন্যে বললেও তারা নির্মাণ কাজের জন্যে সময় নিচ্ছিল। গত সোমবার আমরা লোক দিয়ে সেগুলো অপসারণ করেছি। আশা করছি ৩/৪ দিনের মধ্যে ফরিদগঞ্জের পূর্বাঞ্চলের খালে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।