মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২:১৪

সাবেক কৃতী সাঁতারু আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু)-এর সাক্ষাৎকার

রেলওয়ে লেকে আমাদের তিন সাতারুর ২৪ ঘণ্টা সাঁতার আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো

গোলাম মোস্তফা
রেলওয়ে লেকে আমাদের তিন সাতারুর ২৪ ঘণ্টা সাঁতার আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো

চঁাদপুরের এক সময়ের কৃতী সঁাতারু আশীষ কুমার লোধ সেন্টু। নিজের হাতে শত শত ছেলেমেয়ের জীবন বঁাচাতে সঁাতার শিখাতে পারলেও নিজ পরিবারের কাউকে সঁাতার না শেখানোর আক্ষেপ রয়েছে। তিনি সোমবার (৮ ডিসেম্বর ২০২৫) চঁাদপুর কণ্ঠের ক্রীড়াকণ্ঠের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই আক্ষেপের বিষয়টি জানান। নিচে প্রশ্নোত্তর আকারে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলোÑ

ক্রীড়াকণ্ঠ : কেমন কাটছে আপনার দিনকাল? পেশাগতভাবে আপনি কেমন আছেন?

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : চলমান সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। সামান্য একটি ব্যবসা দিয়ে বর্তমানে সাধারণ জীবনযাপন করছি। একজন সঁাতারু হিসেবে বর্তমানে আগের ন্যায় সম্মান পাচ্ছি না। অবশ্য এই না পাওয়ার পেছনে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের দুর্বলতাকে আমি ভাবছি।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনি একজন সঁাতারু ছিলেন। সঁাতারে আপনার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের কথা মনে পড়ে কি? সেগুলো কী কী?

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : প্রতিটা মানুষের সোনালী অতীতের স্মৃতিগুলো মনে থাকে। সেই সময় সঁাতারে আমার কৃতিত্ব দেখে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের যে উৎসাহ উদ্দীপনা পেয়েছি, সেটি আজও স্মৃতি হয়ে আছে। তৎকালীন সময়ে আমরা মহকুমা থেকে জেলা, বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে যেতে আমাদের অনেক ঘাট পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে হ্যঁা, সত্য কথা বলতে হবে, সে সময় মুখ চেয়ে বা নিজের লোক বলে কোনো শব্দ ছিলো না। যার ফলে সত্যিকারের সঁাতারুরা তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারতো। আমি ১৯৭৭ সালে আক্কাছ আলী রেলওয়ে একাডেমীর হয়ে সঁাতার শুরু করি। আমি আমার সঁাতারে ফ্রি স্টাইল (মুক্ত সঁাতার) বাটারফ্লাই (প্রজাপতি সঁাতার), ব্রেস্ট স্ট্রোক (বুক সঁাতার) ও বেক স্ট্রোক (চিৎ সঁাতার) ইভেন্টে অনেক কৃতিত্ব অর্জন করি। আশির দশকে অর্থাৎ এরশাদ সরকারের শাসনামলে চঁাদপুরকে জেলা ঘোষণার পূর্বে বর্তমান চঁাদপুর শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কের ‘অঙ্গীকার’ পাদদেশে রেলওয়ে লেকে ২৪ ঘন্টা অবিরাম সঁাতার কাটি আমরা ৩ জন। তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট আফতাব উদ্দিন সাহেবের সার্বিক সহযোগিতায় এই সঁাতারে অংশগ্রহণ করিÑ আমি, আমার সহযোদ্ধা সঁাতারু (বর্তমানে ফটোসাংবাদিক) বাদল মজুমদার ও আমার আরেক বন্ধু এমদাদ হোসেন। এই সঁাতার চঁাদপুরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়াও কুমিল্লায় একটি জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সঁাতারে অংশ নেই। এই প্রতিযোগিতার সংবাদ তৎকালীন সময়ে কুমিল্লার দৈনিক রূপসী বাংলার প্রথম পৃষ্ঠার ওপরে ছাপানো হয়। সেই সংবাদে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সেখানে লেখা হয় ‘চঁাদপুরের সঁাতারুর কৃতিত্ব’। সর্বোপরি সোনালী দিনের সেই স্মৃতি কখনোই ভোলা যাবে না।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার সাথে যঁারা সঁাতারে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন, তারা কে কে? কোথায় আছে জানেন কি?

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : তৎকালীন সময়ে চঁাদপুরের সঁাতারের উর্বর একটি মাটি হিসেবে সারাদেশে বেশ আলোচিত ছিলো। আসলে এ সময় শুধু সঁাতারেই নয়, ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইভেন্টে নানাভাবে চঁাদপুরের মুখ উজ্জ্বল করেছে অনেকেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই সকলের কাজে ব্যস্ত। কয়েক বছর পর পর কারো সাথে দেখা হয় বা কথা হয়। কিন্তু নানা কারণে যোগাযোগ হচ্ছে না। আসলে নিজের পারিবারিক কারণে কে কোথায় আছে সেটিও জানা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আপনার সন্তান ও আত্মীয় স্বজন কাউকে কি সঁাতার শিখিয়েছেন?

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি মানুষের কিছু পরাজয় থাকে। যা আসলে কখনোই সমাজে মুখ ফুটে বলা সম্ভব হয় না। নিজের এই দুহাতে শত শত ছেলেমেয়েকে অন্তত তাদের নিজের জীবন সেভ করার স্বার্থে সঁাতার শিখিয়েছি। এদের মধ্যে অনেকে জাতীয় পর্যায়েও কৃতিত্ব অর্জন করেছে। কিন্তু জীবনের পরাজয় এখানেই, নিজের পরিবারের দু সন্তানকে অর্থাৎ আমার দু ছেলেমেয়েকে সঁাতার শিখাইনি। এই না শেখানোর আক্ষেপটা আমার আমৃত্যু থেকে যাবে। যা কখনোই ভোলার নয়। এটি মনে করি আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা।

ক্রীড়াকণ্ঠ : চঁাদপুরের সঁাতারের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কী ধারণা? আপনাদের সময়ের মতো কি সঁাতার চলছে, না খারাপ অবস্থা?

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : সঁাতারের অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চঁাদপুরের গুটিকয়েক ব্যক্তি এগিয়ে এসে এই ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তঁাদের মধ্যে অন্যতম চঁাদপুরের সকলের পরিচিত মুখ, সাংবাদিক অঙ্গনের পথিকৃৎ, দৈনিক চঁাদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাতসহ বেশ কয়েকজন সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু নানা কারণে সেটি পুরানো ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না। যেমনÑ সংস্কারের নামে দীর্ঘ সময় ধরে চঁাদপুর সুইমিং পুলটি বন্ধ রয়েছে। দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে মূলত দেশের ক্রীড়াঙ্গন অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া নতুন প্রজন্ম ক্রীড়াঙ্গনে কৃতিত্ব অর্জন করলে তাদেরকে ধরে রাখার জন্যে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সামাজিকভাবে অথবা ব্যক্তিগতভাবে যে ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার, সেই পৃষ্ঠপোষকতা নেই। ক্রীড়ায় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কৃতীরা হারিয়ে যাচ্ছে, নতুন প্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে। এছাড়াও নজর করলে দেখা যায়, ক্রীড়াক্ষেত্রের নানা ইভেন্টগুলো স্থবির অবস্থায় রয়েছে। এক কথায় সকল ক্রীড়া ক্ষেত্রে এই স্থবিরতা আমাদের জন্যে একটি অশনি সংকেত। তাই আমি সমাজের সকল স্তরের বিত্তবানদের আহ্বান করবো, আগামীর সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে সকলে এগিয়ে আসুন, নতুন প্রজন্মকে বঁাচান।

ক্রীড়াকণ্ঠ : বিশ্বখ্যাত সঁাতারু আ. মালেক ও অরুন নন্দীর মতো সঁাতারু কি আর চঁাদপুরে জন্মাবে না?

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : আসলে এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, প্রতিটা মানুষের নিজের মধ্য থেকে একটি পণ করতে হবে বা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমি এ বিষয়ে সফলকাম হবো। সেটি স্থির করে তাকে সেই পথে এগিয়ে যেতে হবে। অপরদিকে যে একটি বিষয়ে কৃতিত্ব অর্জন করবে তাকে সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে হবে। তাহলেই পুরানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ আব্দুল মালেক ও অরুন নন্দীর মতো সঁাতারু চঁাদপুরে সৃষ্টি করতে হলে নতুন প্রজন্ম ও পৃষ্ঠপোষকদের উভয়ের এগিয়ে আসতে হবে, তাহলেই এঁদের মতো সঁাতারু সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। কিছুদিন পূর্বে নুরুল ইসলাম (চঁাদপুর শহরের ট্রাক রোড এলাকায় বাড়ি) ভারতের মুর্শিদাবাদে আন্তর্জাতিক দূরপাল্লার সঁাতারে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। আমি মনে করি, তাকে এখন থেকে ভালোভাবে পরিচালনা করা হলে সেও তাদের মতো সঁাতারু হবে।

ক্রীড়াকণ্ঠ : আমাদের ওপরের প্রশ্নমালার বাইরে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে বলতে পারেন।

আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু) : আমার শুধু এটুকুই বক্তব্য যে, আগামী প্রজন্মকে ক্রীড়া সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্রীড়াঙ্গনে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে, দেশের বিত্তবানতের এগিয়ে আসতে হবে। এর ফলে নতুন করে চঁাদপুর ও সারা দেশে সঁাতারসহ ক্রীড়ার অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ভূমিকা রাখার আহ্বান থাকলো।

২৪ ঘন্টা সঁাতার শেষে আশীষ কুমার লোধ (সেন্টু)কে অতিথিবৃন্দ পানি থেকে উপরে তুলছেন।

কৃতিত্ব অর্জনের পর কুমিল্লায় অতিথিদের সাথে সঁাতারু আশীষ কুমার লোধ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়