মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩১ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইউসুফ গাজী গ্রেফতার

প্রকাশ : ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৪৮

নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশ : সম্ভাবনার জ্যোতি

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশ : সম্ভাবনার জ্যোতি

সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় অসাধারণভাবে বলেছেন,

‘সেইদিন দূরে নয়

যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর জয়।’

নজরুলের এ আশাবাদ আজ আলোর কিরণে জ্যোতির্ময়। নারীর জয়গান পুরুষের কাছে না হলেও সময় ঠিকই গাইছে। এর ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে ক্রিকেট মাঠে। আমাদের পুরুষ ক্রিকেট দল যেখানে অন্তর্কোন্দলে খেই হারা, সেখানে নারীদের ক্রিকেট শক্তিমত্তা মাঠে খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যের মাধ্যমে অনূদিত হওয়ায় আমরা আজ আশার আলোয় কাটিয়ে উঠছি অমানিশা। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা নারীশক্তির বিনির্মাণ দক্ষতার কথা ভালোভাবে অবহিত হতে পারি। ফরাসী বিপ্লবে জোয়ান অব আর্কের নেতৃত্ব যেমন আমাদের এনে দিয়েছে রেনেসাঁ, যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল যেমন আহত সৈনিকদের সেবা দিয়ে টেনে এনেছেন সুস্থতায়, তেমনি বাংলাদেশের তারামন বিবিরাও একাত্তরের রক্ত-রণাঙ্গনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের এনে দিয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। তাঁদের সেই উত্তরাধিকার স্পর্ধার সাথে বহন করে আমাদের নারী ক্রিকেট দল শত উগ্রমুখী প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মাঠে নেমে দীপ্তি ছড়ায়, আলোকিত করে তোলে নানা অজুহাতে পিছিয়ে রাখা নারী সমাজকে। ফুটবলে মনিকা-কৃষ্ণারা যেমন দাপিয়ে বেড়ায় মাঠ, তেমনি ক্রিকেটেও নিগার, নাহিদা, সালমা, রুমানারা বাংলাদেশকে আলোকিত করে চলেছে।

যে কোনো ক্রিকেট ফরম্যাটে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করা অনেক দেশের জন্যে স্বপ্ন। বাংলাদেশ দলের নারীরা সেই স্বপ্ন সফল করে তুলেছে। অস্থিরতার চারণভূমি পাকিস্তানে গত চার এপ্রিল হতে ঊনিশ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো দুহাজার পঁচিশ সালে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব। অংশগ্রহণকারী সব দলের চোখ ছিলো বিশ্বকাপে স্থান পাওয়া নিয়ে। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দল পাকিস্তানের কাছে হেরে গিয়ে সে স্বপ্নকে কঠিন করে তুলেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বাংলাদেশের আশার সূর্য হেসে উঠে। বাংলাদেশ হেরে গেলেও রান রেটে এগিয়ে ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের চেয়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মূল পর্বে চান্স পেতে হলে শেষ খেলায় থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিততে হতো দশ ওভারের মধ্যেই। কিন্তু বিধিকে ঠেকিয়ে রাখে কে? থাইল্যান্ডকে হারাতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ নারী ক্রিকেট দলকে দশ ওভার পাঁচ বল খেলতে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের কপালে দুহাজার পঁচিশের নারী বিশ্বকাপের শিকে ছিঁড়লো।

বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটাররা যে হারে বৈষম্যে ভোগে তা জগতে বিরল। এখনও বাংলাদেশে নারীদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা আসেনি। নারীদের পরিধেয় বস্ত্রের দৈর্ঘ্য মেপে আমরা একদিকে যেমন নারীদের ক্ষমতায়নকে দূরে ঠেলে রাখছি, তেমনি অন্যদিকে নারী স্বাধীনতাকে খর্ব করতে পথেঘাটে ইভটিজিংয়ে বিরক্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলছি নারীদের। এমন নেতিবাচক সমাজ-মানসকে জয় করে বাংলাদেশের নারীরা যে আজ ক্রিকেট মাঠকে নিজেদের প্রিয় প্রাঙ্গণ করে তুলতে পেরেছে, সেজন্যে তাদের সাধুবাদ দিতেই হয়। নারী ক্রিকেট দলের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো অনিশ্চয়তা। আজ খেলতে পারলেও কালকে যে খেলতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবুও এতো অনিশ্চয়তার মধ্যেও নারীরা তুলনামূলকভাবে পুরুষের চেয়ে ভালো করেছে।

আর কিছুদিন পরেই ভারতে শুরু হতে যাচ্ছে ওয়ানডে নারী বিশ্বকাপ টুর্নামেন্ট। প্রমীলা ক্রিকেট ওয়ানডে বিশ্বকাপের ত্রয়োদশ আসর বসবে এ বছরের সেপ্টেম্বরে। ভারতে অনুষ্ঠিতব্য এ টুর্নামেন্টে সরাসরি সুযোগ পেয়েছে ছয়টি দল। আইসিসি নারী ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে দুহাজার বাইশ সাল থেকে দুহাজার পঁচিশ সাল পর্যন্ত শীর্ষে থাকা পাঁচটি দল সরাসরি পৌঁছে যায় বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে আর স্বাগতিক দেশ হিসেবে আগেই মূল পর্বে খেলা নিশ্চিত করে ভারত। বাছাইপর্বের বাধা পেরিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে পাকিস্তান ও সবশেষে বাংলাদেশ। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ছাড়াও এবারের নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নেবে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলংকা। আটটি দল রাউন্ড রবিন লীগ পদ্ধতিতে খেলবে গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলো। সেখান থেকে পয়েন্টের ভিত্তিতে সেরা চারটি দল যাবে সেমি-ফাইনালে। ভারতের পাঁচটি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে এবারের বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো। তবে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কারণে ভারতের মাটিতে খেলতে আসবে না পাকিস্তান। তাদের ম্যাচগুলো আয়োজন করা হবে নিরপেক্ষ কোনো ভেন্যুতে। সেই ভেন্যুর নাম এখনো চূড়ান্ত করেনি ভারত। আগামী ঊনত্রিশে সেপ্টেম্বর পর্দা উঠবে এবারের বিশ্বকাপের। ছাব্বিশ অক্টোবর মুল্লানপুরের মহারাজ যুজভিন্দ্র আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে হবে নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপ দুহাজার পঁচিশের ফাইনাল।

বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলকে আসন্ন বিশ্বকাপে ভালো করতে হলে এখন থেকেই দল ঘোষণা করে তাদের নিবিড় পরিচর্যায় রাখতে হবে। শুধু ক্রিকেটীয় প্রশিক্ষণ নয়, তাদের মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ, পারিবারিক ও রাজনৈতিক চাপমুক্তির ব্যবস্থা সবই অটুট রাখতে হবে। তাদের শারীরিক সামর্থ্য যাতে বজায় থাকে সেজন্যে এখন থেকেই খেলোয়াড়দের ডায়েট পর্যবেক্ষণ করা দরকার। অঢেল আর্থিক সামর্থ্যের কারণে দেখা যায়, তারা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিংবা সশরীরে গিয়ে হলেও বিভিন্ন ফাস্টফুড ও জাঙ্ক ফুডের প্রলোভনে নিজেদের ফিটনেস হারিয়ে ফেলেন। এ দিকটা কড়াকড়িভাবে নজরদারি করতে হবে। নিজেদের শতভাগ স্ক্যান্ডালমুক্ত রাখতে হবে। নচেৎ তার জের পুরো দলকেই টানতে হয়। পুরো দলটাকে সেনাবাহিনীর একটা ব্রিগেডের মতোই শৃঙ্খলায় আনতে হবে। কারণ, ক্রীড়ায় সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো অটুট শৃঙ্খলা। জাতীয় দল, এ-দল, বি-দল তৈরি করে সপ্তাহে ছোট ছোট টুর্নামেন্ট খেলাতে হবে। ইনজুরি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। যতই অনুশীলন করুক, মাঠে খেলা না হলে কারও প্রকৃত সামর্থ্য যাচাই হয় না। তাই খেলার মধ্যে রাখতে হবে দলকে। মাঠের খেলার পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান নিয়েও পুরো দলকে বসতে হবে। বিশ্বকাপে প্রতিপক্ষের দলগুলোর খেলোয়াড়দের দুর্বলতা ও শক্তিমাত্রা অনুধাবন করার জন্যে তাদের খেলার ভিডিও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতিপক্ষের প্রতিটা খেলোয়াড়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ যেমন ল্যাপটপ ও মাথায় থাকতে হবে, তেমনি নিজেদের ফাইন টিউনিংয়ের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন তেন্ডুলকরের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যায়। তিনি কোনো একটা সফরে খেলার জন্যে গেলে রেস্টুরেন্টে তাকে কফি পরিবেশনকারী এক ভক্ত একটা কথা ধরিয়ে দেন। তিনি বলেন, ইদানীং তেন্ডুলকরের দ্রুত আউট হওয়ার মূল কারণ তার আর্ম গার্ডটা ভারী বেশি। তাই দ্রুত ব্যাট চালনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেটা। তেন্ডুলকর তার পরামর্শ মাথায় নিয়ে আর্ম গার্ড পরিবর্তন করে হাল্কা করে নেন। এতে তিনি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, তাঁর ব্যাট সঞ্চালনায় আগের চেয়ে গতি এসেছে। এ ঘটনা প্রমাণ করে, পারফেক্ট হওয়ার সুযোগ সর্বদা বিরাজমান। কাজেই নিজের খেলার ভিডিও নিজে দেখেও অনেক সূক্ষ্ম ত্রুটি সংশোধন করা যায়।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমাদের নারী ক্রিকেটারদের খেলার মাঠে নামতে হয়। এ সুবর্ণ সুযোগ যাতে সাফল্য ও সার্থকতায় অনূদিত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রত্যেকের জরুরি। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষ বা বোর্ডেরও আর্থিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। যাতে খেলোয়াড়দের মনোযোগ সঞ্চালনায় ব্যাঘাত না ঘটে। খেলা শুধু ব্যাটেবলে হয় না, খেলা হয় সমগ্র সত্তা দিয়ে। কাজেই খেলোয়াড়েরা নিজেদের মানসিকভাবে নির্ভার যেমন রাখতে হবে, তেমনি মনকে একাগ্র করে বিশ্বকাপকে ধ্যানজ্ঞান করতে হবে। বার বার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হবে, মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়