প্রকাশ : ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৯
চব্বিশের ক্রিকেট : নক্ষত্রের আলো, মায়া মরীচিকা
ফুটবল জাদুকর সামাদ কিংবা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়া ব্রজেন দাশ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে কিছুটা পাদপ্রদীপের আলো পাইয়ে দিলেও বিশ্বক্রীড়ামঞ্চে ক্রিকেটই বলতে গেলে সমীহের সাথে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বীরত্ব ইতিহাসের অংশ হলেও আশি-নব্বইয়ের উত্তুঙ্গ ফুটবল মুখরতা আর নেই। সেই দেউটি এখন নিভু নিভু। দাবা হতে কয়েকজন গ্র্যান্ড মাস্টার তৈরি হলেও তাদের খেলার ধারাবাহিকতা কর্পূরের মতো উবে গিয়ে আমাদের সম্ভাবনাকে উদ্বায়ী করে তুলেছে। কাবাডি আমাদের জাতীয় খেলা বটে, আমরা অদ্যাবধি কাবাডিতে এশিয়ার সেরা হতে পারলাম না। শুটিং স্বপ্ন দেখালেও তা লক্ষ্যচ্যুত। এমতাবস্থায় ক্রিকেটই আমাদের শিবরাত্রির সলতে বলা যায়।
চব্বিশের নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখনও ক্রিকেট আমাদের উজ্জীবিত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা দশ বছর পরে এবারই বিশ্ব টি-২০ ক্রিকেটে স্কটল্যান্ড নারী দলকে হারিয়ে জিতার ধারায় এসেছে। ষোলোটি খেলায় টানা হারের পর এবারই নারীরা জয়ের স্বাদ পেয়েছে। এর পাশাপাশি অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের নারীরা নেপালকে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠেছে, যাতে রোববার ভারতকে মোকাবেলা করার কথা।
বাংলাদেশের পুরুষ অনূর্ধ্ব-১৯ যুবারা ভারতকে হারিয়েই এবার এশিয়ার সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। অর্থাৎ দুহাজার চব্বিশ কিছুটা হলেও ক্রিকেট দিয়ে আমাদের মুখটাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বড়োদের সাকিব কাণ্ড আমাদের ক্রিকেটকে একটা বড়ো প্রশ্নের সম্মুখীন করে রেখেছে আজও। বিশ্ববরেণ্য একজন অলরাউন্ডার পেয়েও আমরা রাজনীতির পচা শামুকে পা কেটে চলেছি জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যতের।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল দুহাজার চব্বিশ সালে টি-২০ বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার পাশাপাশি সাতটি ক্রিকেট সিরিজে অংশ নিয়েছে। এর তিনটি হলো দেশে এবং চারটি হলো দেশের বাইরে। টি-২০ বিশ্বকাপে কাঙ্ক্ষিতভাবে সুপার এইটে পৌঁছলেও টানা তিন খেলায় হেরে পরবর্তী রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে যায়। সুপার এইটে বাংলাদেশ ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও আফগানিস্তানের কাছে পরাজিত হয়। সুনাম ও শক্তির বিচারে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যাওয়া মেনে নিলেও আফগানিস্তানের কাছে হার মানাটা কঠিন হয়ে যায়। কেননা অস্থিতিশীল রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে তারা যে অনুশীলন করতে পারে এটাই আফগানিস্তানের জন্যে বেশি। সেই অবস্থান হতে তারা নিজেদের নৈপুণ্য ও শক্তিমত্তায় হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এটা আমাদের জন্যে কষ্টের বৈকি।
দুহাজার চব্বিশে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল টেস্টে নবম, ওডিআইয়ে অষ্টম এবং টি-২০তে নবম র্যাংকিংয়ে অবস্থান করেছে। সর্বশেষ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়ে ওডিআইয়ে তাদের কাছে ধবল ধোলাই হলেও টেস্টে ড্র করেছে, যা আমাদের জন্যে স্বস্তির। প্রথম টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুশো এক রানের বিশাল ব্যবধানে জিতলেও আমরা সমতা আনতে পেরেছি দ্বিতীয়টাতে একশ এক রানের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আনন্দের হলো বিশ্বসেরা টি-২০ টিমের অন্যতম ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের দেশে হোয়াইট ওয়াশ করে আসাটা। এটা আমাদের কাছে বিজয়ের মাসে মুক্তি অর্জনের সমতুল্য। আরও আনন্দের হলো, ইয়ান বিশপ যখন আইসিসির স্পিরিট অব ক্রিকেটের পুরস্কারটি এ বছর বাংলাদেশকে দেওয়ার দাবি জানালেন তখন। আমাদের জাকের-শামিম জুটি আহত ফিল্ডার দেখে আর রান না নেওয়ার যে সৌজন্য দেখিয়েছেন তা অনুসরণীয়। জাকের আলী যেমন ঝড় তুলেছেন ব্যাটে, তেমনি অলরাউন্ডার চাঁদপুরের ছেলে শামিমও কম ছিলেন না। এক বছর পরে জাতীয় দলে ফিরে এসে দুটো টি-২০তে জয়ে অবদান রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। একটাতে ঝড়োগতির পঁয়ত্রিশ আর অন্যটাতে সিডরের তাণ্ডবে সাতাশ রান করে শামিম ইলিশের বাড়ির মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
এ মুহূর্তে ক্রিকেটই আমাদের দেশের ক্রীড়া স্পন্দন। তাই ক্রিকেট নিয়ে আমাদের মনোযোগ বাড়াতে হবে। ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের নিয়ে আমরা কোনো রাজনীতি চাই না। আমরা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে যেমন খেলোয়াড়ি নৈপুণ্য চাই, তেমনি খেলোয়াড়দেরকে সব ধরনের স্ক্যান্ডাল হতেও মুক্ত দেখতে চাই। আমরা চাই না, বিসিবি কর্তৃপক্ষ আর খেলোয়াড়দের মধ্যে রাজনীতির দেয়াল থাকুক। আমরা চাই না, খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠুক। কর্মকর্তারা যদি বুঝতে পারেন, তারা হলেন খেলোয়াড়দের ফ্যাসিলিটেটর, তবেই মঙ্গল। খেলোয়াড়দের যতটুকু সম্ভব শোবিজ জগৎ হতে দূরে রাখতে হবে, বিশেষ করে জাতীয় দলে খেলার সময়।
আমাদের খেলোয়াড়েরা ইদানীং আরেকটি বিষয়ে বেশি জড়িয়ে পড়েছে। তা হলো খেলার মাঠে ধর্মচর্চা। ধর্ম মূলত দেখানোর জন্যে নয়, ধর্ম হলো অন্তরে ধারণ করে সে আলোকে জীবন বিনির্মাণ করা। কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়েরা আজকাল খেলার মাঠকেই বেছে নেন তাদের ধর্মচর্চার প্রদর্শনীর জন্যে। এর ফলে খেলোয়াড়ি দক্ষতায় আর তাদের মনোযোগ থাকে না। ধর্ম চর্চার বিষয়টি যদি ক্যামেরার সামনে না এনে ড্রেসিংরুমে বা হোটেল কক্ষে সম্পাদন করা যায় তবে তাতেই শুদ্ধতা বজায় থাকে। নচেৎ তা হয়ে যায় বিজ্ঞাপন ও তারকাবাজি প্রদর্শন। কয়েকজন তারকা খেলোয়াড় ক্রিকেট জুয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এটাও আমাদের জন্যে দুঃখের। মনের মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেম ধারণ করে তবেই খেলার মাঠে নামতে হয়। নচেৎ দেশের মান-মর্যাদা বিকিয়ে আসতে দ্বিধা বোধ হয় না।
আমাদের ক্রিকেটাররা মনস্তাত্ত্বিক শক্তির দিক থেকে দুর্বল। অথচ ক্রীড়ায় অটুট মনোবলের কোনো বিকল্প নেই। তাই তাদের অনুশীলনে একদিকে যেমন রানক্ষুধা-উইকেট ক্ষুধা বাড়াতে হবে, তেমনি দাঁত কামড়ে উইকেটে পড়ে থাকার অভ্যাসও করতে হবে।
চাঁদপুরের দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক স্বামী স্বরূপানন্দ আজ থেকে একশ' দশ বছর আগে চরিত্রগঠন আন্দোলন চালু করে বলে গেছেন, দেশপ্রেমের বুনিয়াদ তৈরিতে ক্রীড়ার ভূমিকা অপরিসীম। কেবল কপালে পতাকা বেঁধে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রতীক নিয়ে গ্যালারি মাতালে হবে না, আমরা চাই, খেলোয়াড়েরা এক একজন হয়ে উঠবে দেশপ্রেমের প্রকৃত দূত। আমাদের ছেলেদের টিমের চেয়ে তুলনামূলক মেয়েদের টিম টেম্পারমেন্ট অধিক টেকসই। তাদের নামে যেমন কোনো স্ক্যান্ডাল নেই, তেমনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ারও কোনো হদিস নেই। ফলে তারা একমন একচিত্ত হয়ে জয়ের ব্রত নিয়ে খেলায় মনোনিবেশ করতে পারে।
ক্রিকেটে টাকার ছড়াছড়ি অধিক। অর্থই দক্ষতাকে অর্থহীন করে তোলে। কাজেই ক্রিকেটারদের বার বার মানসিকভাবে একজন ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠতে হবে।
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বিসিবি ও খেলোয়াড়দের নিয়ে দড়ি টানাটানি চলেছে। পাপনের সময়ে বিরাজমান দ্বৈরথ এখনও নতুনরূপে বিদ্যমান। শুধু মুখের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সিস্টেম ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। ফলে পরিবর্তনের সুফল খেয়ে ফেলে রাজনীতির পলিটিক্স। আমরা চাই, হাকিম পাল্টাতে পারে, হুকুম পাল্টাতে পারে, কিন্তু খেলোয়াড়ি মনোভাবের যাতে ব্যত্যয় না হয়। একজন খেলোয়াড় বেঁচে থাকেন তার নৈপুণ্যে। ফর্ম হয়তো ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু তার ক্লাস বা জাত দীর্ঘস্থায়ী। কাজেই কোনো প্রলোভনে আত্মবিনাশ নয়, দিনকে দিন আত্ম বিনির্মাণই হোক আমাদের সকল ক্রীড়াবিদের চূড়ান্ত মোক্ষ। মাঠের খেলায় হার হতেই পারে, কিন্তু সেই হারে যাতে মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত না হয়। সেই হারে যাতে মাঠে নামার যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।
খেলোয়াড়দের সারা বছর প্রশিক্ষণে রাখা দরকার। মূল জাতীয় দলের পাশাপাশি একটা ছায়া জাতীয় দল গড়ে সর্বদা কড়া অনুশীলন বলবৎ রাখা জরুরি। খেলোয়াড়দের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি যে, দলে কারও স্থান যেমন ধরাবাঁধা নয়, তেমনি দলে যে কোনো সময় যে কেউ আসতে পারে। আমরা চাই আমাদের ক্রিকেট বিশ্বজয়ী হয়ে উঠুক। শত সংকটেও আমরা চাই আমাদের ক্রিকেট দলের হাতে কোনো একটা ফরম্যাটের বিশ্বকাপ উঠুক। আমরা আমাদের খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়ি দক্ষতার ধারাবাহিকতা চাই। আকাশ-পাতাল উত্থান-পতন নয়, গ্রহণযোগ্য জয়-পরাজয়ের ব্যবধানই আমাদের কাক্সিক্ষত। রিক্ত নিঃস্ব হতে হতে আমরা আজ দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলেছি। আমরা নিস্তার চাই, আমরা উত্তরণ চাই। ক্রিকেট হয়ে উঠুক আমাদের উজ্জীবনের অনমনীয় সোপান। দুহাজার চব্বিশের মতো যুগপৎ নক্ষত্রের আলো এবং মায়া-মরীচিকা আমরা দেখতে চাই না, আমরা চাই, আকাশগঙ্গার ধ্রুবজ্যোতি, চাই প্রশান্তির পরিতৃপ্ত বাতিঘর। দুহাজার পঁচিশ আমাদের জন্যে নিয়ে আসুক ক্রিকেটীয় আলোক-প্রপাত।