বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২৭ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২১, ০০:০০

বিম্বিত বীক্ষণ

অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদার

অনলাইন ডেস্ক
বিম্বিত বীক্ষণ

পর্ব-১৭

জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের যে প্রক্রিয়া মানুষকে আলোকিত করতে সাহায্য করে তাকেই শিক্ষা বলে। কোনো বিষয় চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ যে ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করে এবং ঐ জ্ঞানের জ্যোতির দ্বারা নিজে আলোকিত ও সমাজকে জ্যোর্তিময় করতে সহায়তা করে, শিক্ষা তাকেই বলে। যে প্রক্রিয়া মানুষের মন-মনন, মানসিক উৎকর্ষ সাধন করে, মানুষের আচার-আচরণ, মন ও আত্মার ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন ঘটায়, মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রভাব ফেলে এমন কর্ম প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলে।

আর শিক্ষক হচ্ছেন উল্লিখিত শিক্ষা প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করার অনুপ্রেরণাদানকারী ব্যক্তি। তিনি সভ্যতার অভিভাবক, সমাজের অভিভাবক, সমাজের প্রতিনিধি। কার্যত শিক্ষক বলতে একজন আলোকিত, জ্ঞানী, গুণী ও বুদ্ধিদীপ্ত পণ্ডিত ব্যক্তিকে বুঝায়। তিনি শিক্ষাপ্রিয় নিবেদিতপ্রাণ সেবক, ব্যবসায়ী নন। তিনি তাঁর আচার-আচরণ, মন ও মননে নিজেই বটবৃক্ষের ছায়া। তাঁর সাফল্যের ভিত্তি হলো পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, নির্মল চারিত্রিক গুণাবলি, জ্ঞান সঞ্চারণে আন্তরিক সদিচ্ছা ও প্রচেষ্টা। তাই শিক্ষক বলতে এমন এক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ববান জ্ঞানী, গুণী ও প-িত ব্যক্তিকে বুঝায়, যিনি শিক্ষার্থীকে শিখন প্রক্রিয়ায়, জ্ঞান অন্বেষণ ও আহরণে, মেধা বিকাশ ও উন্নয়নে, শিক্ষার্থীর চরিত্র গঠনে, নৈতিক ও মানসিক গুণাবলি বিকাশে এবং সমাজ বিবর্তনে অনুঘটক ও সুশীল সমাজ তৈরির সহায়তা দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হচ্ছেন অন্য শিক্ষকদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাই প্রধানের দায়দায়িত্বও বেশি। শিক্ষকদের নিকট আমাদের সমাজের প্রত্যাশা অনেক। শিক্ষকগণ সমাজের প্রত্যাশা শতকরা যত ভাগ পূরণ করতে পারবেন, সমাজও ন্যূনতম তত ভাগ সম্মান শিক্ষকদের দেবেন বলে আমি মনে করি।

একজন শিক্ষক হবেন জ্ঞান তাপস, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, ব্যক্তিত্ববান, চৌকষ, পাঠদানকারী ও জ্ঞান বিতরণে আন্তরিক। তিনি হবেন অবশ্যই সৎ ও নীতিবান। শিক্ষক সহজ হবেন, সরল হবেন, নির্মল হবেন, হবেন অকুতোভয় সত্যবাদী, সপ্রতিভ, ব্যক্তিত্ববান, সমাজ হিতৈষী, পরোপকারী এবং আধুনিকতামনস্ক বিচক্ষণ সমাজ সংস্কারক। শিক্ষক হবেন চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন, পরিশ্রমী, নিরপেক্ষ, হাস্যোজ্জ্বল, সুপরামর্শক ও প্রাণবন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বর্তমান শিক্ষক সমাজে শিক্ষকের এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনুপস্থিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষকরা অন্তর্মুখী। ছাত্রের কল্যাণের কথা চিন্তা করেন না। এর বিপরীতে নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। স্বল্প ক’দিনের শিক্ষকতায় যেটা উপলব্ধি করেছি তা হলো, যারা শিক্ষকতা করেন তারা অন্য পেশার লোকদের সাথে নিজেদের তুলনা করেন। তারা এটা ভুলে যান অন্য পেশার সাথে শিক্ষকতা পেশার অনেক পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষকতা পেশায় এসে ইচ্ছা করলেই সবকিছু করা যায় না।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে পাঠ বুঝিয়ে দিলেই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এ অর্থে বিদ্যালয়কে ‘সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা হয়’। একজন শিক্ষক শুধুই শিক্ষক নন তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। একজন ভালো শিক্ষক একজন ভালো প্রশিক্ষক। শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয় শিখিয়ে দেন তখন তিনি শিক্ষক, যখন সৃজনশীলতা, সততা, দক্ষতা, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম, নেতৃত্ব, কষ্টসহিষ্ণুতা, গণতন্ত্রীমনস্কতা ও পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়গুলো ছাত্রের মাঝে সঞ্চারিত করেন তখন তিনি হয়ে উঠেন প্রশিক্ষক এবং সমাজ সংস্কারক।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো মূল্যবোধ চর্চার অনন্য কারখানা। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে সমাজকে করতে পারে আলোকিত ও উদ্ভাসিত। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধের পরীক্ষা দিতে হয়। মূল্যবোধের চরম সংকট মুহূর্তে দেশের শিক্ষক সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধ বিকাশের জন্যে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণেধরা মূল্যবোধকে শিক্ষক সমাজই আবার জাগিয়ে তুলতে পারে।

শিক্ষকতা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীন পেশাগুলোর একটি। তবে কিছু কিছু দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের দ্বারা এই মহান পেশাটি কলুষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিক্ষকদের মূল্যবোধ নিয়েও দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এর বিপরীতে কিছু শিক্ষক আলোচিত হচ্ছেন তাদের কাজের জন্যে। শিক্ষক সমাজ আজ প্রাইভেট-কোচিং ব্যবসাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে। অপ্রিয় হলেও বিষয়টি মিথ্যা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অযোগ্য ব্যক্তিরা রাজনৈতিক পরিচয়ে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও আলোকিত ব্যক্তিরা শিক্ষক হিসেবে মর্যাদা পাচ্ছেন না।

আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশার সাথে নিজেদেরকে জড়াতে রাজি নন। সবার ইচ্ছা বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার। স্বল্প সময়ে গাড়ি বাড়ি, যশ-প্রতিপত্তির মালিক হবেন। অনেকে বলেন, সম্মান দিয়ে কী হবে, পেটে যদি ভাত না থাকে। আমি তাদের সে বক্তব্যের বিপরীতে গিয়ে বলি, আমরা যারা শিক্ষকতার ইথিকস্টুকু মানতে চাই তারা জেনে শুনেই এখানে এসেছি যে, এখানে সম্মান আছে কিন্তু আর্থিক প্রতিপত্তি নেই। কিছু শিক্ষক নিজেদেরকে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত করছেন এবং টাকা উপার্জনের বিকল্প পন্থা বের করছেন। সাধারণভাবেই বলা যায়, আদর্শ শিক্ষক তিনিই, যিনি তাঁর দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকবেন, নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকবেন, ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি স্নেহ ও দায়িত্বশীল হবেন, পড়ানোর পূর্বে পাঠ সম্পর্কে অবগত হবেন, পাঠ্যের বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে যার পড়াশোনা থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক শিক্ষকের কাছে না পড়ানোটাই ফ্যাশন, ক্লাসে দেরি করে উপস্থিত হওয়াটা রীতি, ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে দূরে থাকাটাই সার্থকতা। যা শিক্ষকদের কাছে কাম্য নয়।

শিক্ষকদের আরেকটি বিষয় আমাকে খুব ব্যথিত করে, তা হলো সমাজের কোনো অসঙ্গতি দেখে নির্লিপ্ত থাকা। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়। কোনো অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেও চুপ থাকে। এটা এক ধরনের অপরাধ। আমাদের দেশের তরুণ সমাজ অনেক সময়ই বিপথগামী হয়। রাস্তাঘাটে ছাত্রের কোনো অন্যায় আচরণ দেখে নীরব থাকাটা বেদানাদায়ক। কোনো কোনো সময় হয়তো প্রতিবাদ করাটা বিপদ ডেকে আনে। তথাপি যখনই একজন শিক্ষক অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে, আমি নিশ্চিত সে প্রতিবাদে অন্যরাও সহযোগী হবেন। ছাত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করা একজন আদর্শবান শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্বও বটে।

শিক্ষকদের যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় সেটি হলো প্রাইভেট পড়ানো। অনেক শিক্ষক আছেন যারা প্রাইভেট পড়ানোটাকে মূল পেশা হিসেবে ধরে নিয়েছেন আর শিক্ষকতাকে উপরি পেশা হিসেবে মনে করেন। এ ধরনের মানুষের শিক্ষকতা করার নৈতিক কোনো অধিকার নেই। অভিজ্ঞতার আলোকে যে বিষয়গুলো আমাকে খুব পীড়া দিয়েছে সেগুলো নিয়ে আমি বরাবরই কথা বলেছি। কারো সমর্থন পেয়েছি আবার কারো কাছ থেকে বাধাও পেয়েছি। বিশেষ করে বিজ্ঞান বিভাগ এবং ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়ে অগ্রগণ্য। একটা কথা প্রচলিত আছে, প্রাইভেট না পড়লে বিজ্ঞান বিষয়ের ছাত্রদের ব্যবহারিক পরীক্ষায় কম নাম্বার দেয়া হয়। কথাটার সত্যতা আছে। সেটা অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি। যারা প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে সেই শিক্ষকরা যতœ নেন, কিন্তু যাদের পড়ার সামর্থ্য নেই বা পড়ে না তাদেরকে অবজ্ঞা করেন, কোনো কোনো সময় মানসিক অত্যাচার করেন। যেটি একজন শিক্ষকের কাছে কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। এতে করে সেই সমস্ত ছাত্রের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয় বা কোনো কোনো সময় শিক্ষকই ভীতির সৃষ্টি করেন।

আমাদের অভিভাবকরাও মনে করে ছাত্রকে যদি প্রাইভেট পড়তে দেয়া হয় তবে সব উৎরে যাবে। এটা অনেকটা টাকা দিয়ে শিক্ষা (!) কেনার মত। এই কেনাকাটায় যে সমস্ত শিক্ষক নিজেকে জড়িত করেন না তারা হয়তো আর্থিক সুবিধা পান না, তবে আত্ম মর্যাদা পান। আরেকটি বিষয় এখানে আলোচনার দাবি রাখে, একজন শিক্ষক দৈনিক কয়টা ক্লাস নেবেন। সরকারি পরিপত্র আছে, একজন প্রভাষক সপ্তাহে ২৪টি, সহকারী অধ্যাপক ১৮টি, সহযোগী অধ্যাপক ১২টি এবং অধ্যাপক ৮টি ক্লাস নেবেন। কিন্তু দেখা যায় একজন প্রভাষক বাসায় সকালে তিন ব্যাচ এবং বিকেলে তিন ব্যাচ প্রাইভেট পড়ান। মাঝে দুটি ক্লাস নেন। মানে দৈনিক ৮টি ক্লাস নেন। এটা কি একজন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব? কোনো অবস্থাতেই নয়। সকালে বাসায় তিন ব্যাচ পড়িয়ে এসে ক্লাসে যখন পাঠদান করতে যান তখন তিনি থাকেন ক্লান্ত। ক্লাসের প্রতি আগ্রহ থাকে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, ক্লাসে এসে গল্প ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এ বিষয়গুলো শিক্ষা বিজ্ঞানীরা ভেবে দেখেছেন কিনা জানি না। এ জায়গা থেকে আমাদের যে কোনো উপায়ে হোক বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা শিক্ষকতা পেশাটা কলুষিত হতেই থাকবে। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়