প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:০২
আগুনের নদী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
॥ তেরো ॥
ধীরে ধীরে উঠে বসলো জামশেদ। চোখ খুলে দেখলো পাশে নিয়াজ, ইলিয়াছ ও মামুন পড়ে আছে। রক্তাক্ত। সে উঠে ওদের পাশ দিয়েই ধীরে ধীরে কটেজের ছাদে উঠে দেখলো সেখানে অনন্যা বসে আছে। অনন্যা তাকে দেখেই উঠে বসলো, তারপর বললো, ‘তোমার কথা মতোই কাজ করেছি জামশেদ।’
‘দারুণ হয়েছে। তুমি যখন চারদিকে ঘুরছিলে, মুচকি হাসছিলে এবং তোমার কোমর থেকে পানিযুক্ত নকল সিরিঞ্জটা বের করে বিষযুক্ত সিরিঞ্জটা রেখে দিয়েছিলে, তখন আমি হালকা করে চোখ খুলে সব দেখছিলাম। তোমার কাজের প্রশংসায় আমি ধন্য। তোমাকে পাশে না পেলে হয়তো ওই সময় আমাকে মরতে হতো। আমার প্রাণের সিন্দুকের চাবি তুমি। তোমার মাথায় আমি যে চীপ বসিয়েছি তা আমি ছাড়া আর কারও খোলার সুযোগ নেই। তাই আমি যা বলবো, তুমি তো তা-ই করবে।’
‘হ্যাঁ, এখন থেকে তোমার প্রাণের সিন্দুকের চাবি আমি, আর আমার জীবনের নাটের গুরু তুমি। তুমি চাইলেই আমি বেঁচে থাকবো, আর তুমি না চাইলেই আমাকে মরে যেতে হবে। তুমি যে আমাকে বেঁধে নিয়েছো আমার মস্তিস্কে একটি যন্ত্র বসিয়ে। গুড। ভালোই করেছো। বাংলাদেশে গেলে আমাকে সাজা ভোগ করতে হবে আর এখানে থাকলে আমি তোমার ছায়ায়ই বেঁচে থাকতে পারবো। কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না।’
‘এই তো আমার সোনার পাখি সুন্দর ভাবনায় যোগ দিয়েছে। গুড। ভেরি গুড। জীবনে সুন্দরভাবে ক্ষমতা আর সম্পদের মাঝে বেঁচে থাকার আনন্দই তো আলাদা। ক্ষমতা মানুষকে অমর করে রাখে। আর অঢেল টাকা মানুষকে যা খুশি তাই করার সুযোগ দেয়। জীবনটাকে ভিন্নভাবে ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে থাকার সামর্থ্য দেয়। এখন থেকে তুমি শুধুই আমার। আমার কাছ থেকে তোমাকে কেউ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। চলো, আমরা এই কটেজ থেকে কেটে পড়ি। ওরা যখন বুঝতে পারবে ঘটনাটা কী হয়েছে তখন আবার ফিরে আসতে পারে।’
‘আমরা কুকুরের মতো পালাবো না। ওদেরকে আসতে দাও। বরং আমরা ওদেরকেই কুকুরের মতো মারবো। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করো জামশেদ, আমার প্রাণপাখি।’
‘ওহ, তাই তো। এখন দেখছি আমার চেয়েও তোমার সাহস বেশি, বুদ্ধি বেশি। গুড। তোমাকে অভিনন্দন। তোমার মতোই একজন বান্ধবী আমার প্রয়োজন, তোমাকে দিয়ে পথের সব কাঁটা আমাকে পরিস্কার করতে হবে।’
‘ঠিক তাই। আমি তো শুধুই তোমার জন্যে।’ এ বলে অনন্যা জামশেদকে জড়িয়ে ধরলো। আর জামশেদও ধীরে ধীরে অনন্যার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো। এভাবে অনেক সময় অতিবাহিত হলো। জামশেদ উপলব্ধি করলো অনন্যার শরীরটা বেশ গরম। উষ্ণতায় ভরা। সে ভাবলো জীবনে অনেক নারী দেখেছে অনন্যার মতো নারীর উষ্ণতা সে কখনো পায়নি। মনে পড়লো, তাহলে তো আমিনুল এই কারণেই অনন্যার জন্যে জাপান থেকেও ছুটে আসতো। অনন্যা তো আসলেই সেরা, অনন্যা।
‘তবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আমার দীর্ঘদিনের একজন বন্ধু নিয়াজকে হারিয়েছি।’ অনন্যার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বলতে লাগলো জামশেদ, ‘তুমি কি জানো নিয়াজ আমার দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত এক সৈনিক ছিলো। তার মাধ্যমে আমি হাজার হাজার বাঙালি যুবককে ইটালি, ফ্রান্সসহ ইউরোপ কান্ট্রিতে চাকুরির বিশাল লোভ দেখিয়ে সাগর পথে নিয়ে আসতাম। তাদের কাছ থেকে আগে কোনো টাকা নেওয়া হতো না। কিন্তু যারা অথৈ সাগর পাড়ি দিয়ে আসতে পারতো, তাদেরকে আমার টর্চার সেলে এনে এই নিয়াজই তাদের পিতামাতা বা অভিভাবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো। আমি ভাগ পেতাম অর্ধেক। এরপর ওই সব যুবকদেরকে মেরে নদীতে খণ্ড খণ্ড করে ফেলে দেওয়া হতো।’
‘ওয়াও, চমৎকার বিজনেস।’ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ থেকেই উত্তর দিলো অনন্যা, ‘তোমার মতো বুদ্ধিমান গ্যাং লিডার আর হয় না বাবু। তুমি অনেক জিনিয়াস।’
‘বাট ব্যাড জিনিয়াস।’ উত্তর দিলো জামশেদ, ‘ছোটকাল থেকেই আমার কেনো জানি গ্যাং লিডার হওয়ার ইচ্ছে জাগে। আমি কখনোই কোনো বিষয়কে সোজা পথে ভাবতে পছন্দ করতাম না। সেই থেকে আমার পদযাত্রা। এখন আমি আমার মতোই করে গড়ে তুলেছি আমার ভুবন। আমি এক অন্ধকার জগতের বাসিন্দা, যেখানে আমিই সব। বাকি সব কুরবানির গরু। মজা পাই মানুষ হত্যা করে।’
‘তাহলে কি আমাকেও হত্যা করবে জামশেদ?’ অনন্যা প্রশ্ন করে।
‘আহা, কী বলো সোনা। তুমি তো এখন আমার হাতের পুতুল। যেমনে নাচাবো তুমি ঠিক তেমনেই চলবে। আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলার তো তোমার কোনো সিস্টেমই নেই। কারণ তোমার ব্রেনে এমন মাইক্রো চীপ লাগানো হয়েছে যে, আমি যা ভাবি, তুমি তাই করো। আমি যা মনে মনে আদেশ করি তুমি তো তা বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করবে। তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন, এই প্রয়োজন কখনোই শেষ হবার নয়। তোমাকে আমি ভালোবাসি প্রিয়তমা। তাই তিনজনের মধ্যে তোমাকেই পছন্দ করে নিজের করে নিয়েছি। তুমি অতুলনীয়া। তোমাকে আমি কখনোই শেষ করে দিবো না।’
‘এতো ভালোবাসা আমার জন্যে? শুনেছি গ্যাং লিডারদের মধ্যে নাকি ভালোবাসার প্রচলন নেই। তারা শুধু নারীকে ভোগের সামগ্রীই মনে করে, তারপর ভোগ শেষ হলে ছুড়ে ফেলে দেয়। তুমি কি এর বাইরে যেতে পারবে?’
‘সেটা তো তুমি সময় মতোই বুঝতে পারবে আমার প্রিয়তমা। তুমি সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে যখন আমার কাছে এসে পড়েছো, তখন তোমাকে কার সাধ্য ছুড়ে ফেলে দেয়?’
‘আমার মনে হচ্ছে আবেগ তোমাকে বোকা করে ফেলেছে জামশেদ। তুমি তো আর গ্যাং লিডার থাকতে পারে না। তোমার মতো লোকদেরকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে মানায় না। বুঝতে পারছো?’
‘আমি তো আর রোবট নই প্রিয়তমা। আমি মানুষ। তিল থেকে তাল হয়েছি। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে জীবনের এই পর্যায়ে এসেছি। দীর্ঘজীবন একা একা থেকেছি, অর্থ কামিয়েছি। কিন্তু ভালোবাসা কাকে বলে কখনো মনের ভেতরেই আসেনি। শুধু যেদিন তোমাকে বিছানায় পেলাম, তোমার সবকিছু হাতিয়ে নিলাম। সেদিন মনে হলো আসলেই আমি এক অনন্যাকে পেয়েছি, যে কিনা উজাড় করে কাউকে সবকিছু দিয়ে দিতে পারে, আরাম আয়েশ, ভালোবাসা প্রেম-- সব। সবকিছু। আমি তো তোমাকে চোখের আড়াল করতেই পারবো না আমার জানপাখি।’
এবার জামশেদের বাহুবন্ধন থেকে আড়াল হলো অনন্যা। তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আমি কি একজন ভয়ংকর কিলার জামশেদের সাথেই এতোক্ষণ কথা বলেছি?’
হাসলো জামশেদ। তারপর অনন্যার কথার উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ। আমি ভয়ঙ্কর কিলার জামশেদ। তুমি আমাকে যা-ই বলো না কেনো তাতে আমার পেছনের কর্মজীবন পাল্টে যাবে না। আমি তোমার কাছে সাধু সাজতে পারি না। আমি সাধুও নই। আমি অবশ্যই পাপী। আমি অবশ্যই একজন বিকৃত মনের মানুষ। কিন্তু আমি এতেই শান্তি পাই। সহজ সরল পথে আমার শান্তি নাই। তুমি কি পারবে চলতে আমার সাথে?’
‘পারবো না কোনো? তুমি তো আমাকে তোমার মতোই করে সাজিয়ে নিয়েছো, এখন কোনো মতোই আমি তোমার ইচ্ছের বাইরে যেতে পারি না। আমার তো নিজস্ব কোনো পথ নেই। তোমার পথই এখন আমার পথ। ঠিক না?’
॥ চৌদ্দ ॥
‘আজ আমাদের হানিমুন’। মাঝ সাগরে একটা স্পেশাল ইয়টের কেবিনে অনন্যার সাথে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঘোষণা করলো জামশেদ।
ইয়টে বেশি লোকজন নেই। মাত্র সাত আটজন ক্রু আছে। এরা সবই তার ক্যাডার বাহিনীর লোক। তার একটা নির্দেশে যে কোনো শত্রুকে মুহূর্তেই খতম করতে এক সেকেন্ডও দেরি করবে না তারা। এরা এক একজন একশত লোকের বিরুদ্ধে লড়েও ক্লান্ত হবে না। সবক’টি বাছাই করা স্পেশাল কমান্ডো। আভটোমাট বা স্বয়ংক্রিয় কালাশনিকভ হাতে চারদিকে প্রহরায় আছে। একটু শব্দ হলেই ঠা ঠা করে গুলি ছুড়তে থাকবে একটানা ম্যাগাজিন খালি না হওয়া পর্যন্ত।
চাঁদের আলো নদী চুঁইয়ে পড়ছে শান্ত জলরাশির মাঝে। জামশেদ আজ হ্যাপি ট্যুরে আছে। এটা তার জীবনের প্রথম নয়। এমন হয়েছে বহুবার। প্রতিটা বারই তার সাথে একজন নারী থাকে। যাকে নিয়ে সে প্রথমবার হ্যানি ট্যূরে আসে। তারপর ভোরের আলো ফুটতেই ফিরে যায় কটেজে।
অনন্যা জামশেদের সাথে আনন্দের মাঝেই আছে। তার ব্রেনে মাঝে মাঝে কী যেনো বিপরীত কথামালা বেজে উঠে। আমিনুল, ইরফান, অধরা, মোনালিসা, বাবা-মা এসব শব্দ তাকে আঘাত করে। কিন্তু সে এদেরকে চিনতেই পারে না। বুঝতে পারে বাইরের কোনো কিছু সম্পর্কে।
সে শুধু একটাই বুঝতে পারে--জামশেদ। এ ছাড়া তার ব্রেনে আর কিছুই নেই।
এ সময়ে হঠাৎ করেই এক ছায়ামূর্তির উদয় হয় করিডোরে। অনন্যা তাকে দেখে, কিন্তু বুঝতে পারে না সে কে?
জামশেদ তাকে বুকের গহীনে কাছে টেনে নেয়। তারপর বলে, ‘বাইরে কি দেখছো সোনা?’
‘একটা অবয়ব।’ উচ্চারণ করে অনন্যা, ‘ঠিক যেনো আগে কোথায়ও দেখেছি কিন্তু চিনতে পারছি না।
কথাটা শুনেই তড়াক করে উঠে অস্ত্র হাতে নিয়ে বাইরে এগিয়ে গেলো জামশেদ। কিন্তু কোথায়ও কেউ নেই। শুধু চাঁদের দীর্ঘায়িত ম্লান আলো ছাড়া।
আবারও ফিরে এলো জামশেদ। তারপর অনন্যাকে বললো, ‘বাইরে তো কেউই নেই সোনা। তুমি কি কাউকে দেখেছো?’
‘হ্যাঁ, আমি একজনকে দেখেছি, সেটা তার ছায়া। সম্ভবত আসল লোকটা লুকিয়ে পড়েছে।’
‘না। তেমন হবার সুযোগ নেই। আমার লোকেরা তাহলে তাকে ঘায়েল করে ফেলবে। কেউ আসার সুযোগ নেই একদম। এখানে শুধু তুমি আর আমি।’
‘কেউ আছে। আমার ব্রেন বলছে, কেউ আছে একজন। খুব কাছেই আছে, যে তোমাকে আজ খুন করে আমাকে নিয়ে যাবে বহুদূরে।’
আশ্চর্য হলো জামশেদ। জীবনে এমন কথা সে কখনও শুনেনি। তাহলে কি অনন্যার মাইক্রো চীপ ঠিকমতো কাজ করছে না? বড্ড গোলমেলে হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। সম্ভবত তার হেলুসিনেশন হচ্ছে।
‘অনন্যা, তোমার মস্তিস্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। তুমি এলোমেলো কথা বলছো।’
‘না, আমি ঠিকই আছি। তোমাকে সে ৫টি গুলি করে হত্যা করবে, তারপর আমাকে নিয়ে যাবে এখান থেকে।’
‘কীভাবে সম্ভব?’
‘সে তোমার সবক’টি সশস্ত্র ক্যাডারকে খুন করেছে। আমার মস্তিস্ক বলছে।’
‘ধূর, কী বলছো যা-তা। এটা হতেই পারে না।’
‘তাদের রক্তাক্ত দেহগুলো পড়ে আছে চারদিকে। হ্যাঁ, এবার লোকটার নাম মনে পড়ছে, তার নাম ইরফান।’
থ বনে গেলো জামশেদ। অনন্যা তাহলে কি বাস্তবে ফিরে এসেছে? তার চীপ নষ্ট হয়ে গেছে? না। নষ্ট হলে সে কীভাবে এসব কথা জানলো? তাহলে তার মস্তিষ্কে স্থাপন করা মাইক্রো চীপই তাকে চারদিকের পরিবেশ সবকিছু বলে দিচ্ছে। ঘটনাটাই ঠিকই ঘটেছে।
অস্ত্র হাতে আবারও বাইরে এলো সে। পুরো ইয়ট প্রদক্ষিণ করলো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। হঠাৎ করেই দেখলো তার বাহিনীর একজনের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীরটা রক্তাক্ত। সে অস্ত্র উঁচিয়ে চারদিকে তাকালো কেউ নেই।
আমার সশস্ত্র ক্যাডাররা গেলো কোথায়? হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো নাকি? মনে মনে প্রশ্ন করে জামশেদ। কী হলো এখানে? এসব ভাবতে ভাবতে আবারও অনন্যার কামরায় ফিরে এলো সে।
অনন্যা জানতে চাইলো, ‘পেয়েছো তাকে?’
‘না পাইনি।’ হতাশভাবে জবাব দেয় জামশেদ।
ঠিক সেই মুহূর্তেই রিভলবার হাতে কামরায় প্রবেশ করলো ইরফান। দ্রুত হাতের পিস্তল চালালো জামশেদ। কিন্তু কাজ হলো না। ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তার আগেই ইরফানের রিভলবার শব্দ করে কথা বললো। জামশেদ ডান বাহুতে গুলি খেয়ে পড়ে গেলো ফ্লোরে। হাত থেকে পিস্তলটা দূরে চলে গেছে।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর। তারপরও জামশেদ উঠে দাঁড়ালো। শক্তি সঞ্চয় করে একটা লাথি চালালো ইরফানের বুকে। ইরফান সেটা অগ্রাহ্য করে আবারও ঘুরে গেলো। লাগলো না। আবারও ইরফানের হাতের রিভলবার কথা বললো। এবার জামশেদের ঠিক হাঁটু বরাবর গুলিটা লাগলো। গুলির আঘাতে জামশেদ পড়ে গেলো। তারপর আবার অন্য পায়ে ভর করে উঠে দাঁড়ালো। এবারও ইরফানের রিভলবার কথা বললো।
আর সুযোগ হলো না জামশেদের। এবার ঠিক পিঠ বরাবর গুলিটা লাগলো। মাটিতে পড়ে আর উঠার শক্তি পেলো না জামশেদ। কাতরাতে কাতরাতে বললো, ‘তুমি কীভাবে আমার সন্ধান পেলে ইরফান। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর আমার সন্ধান পাবে না।’
হাসলো ইরফান। তারপর বললো, ‘শয়তানের খোঁজ যদি আজরাইল না পায়, তাহলে শেষদিন তার জান কবজ করবে কীভাবে? এটাই চিরসত্য। তোমাকে আগেরবার ছেড়ে দিয়েছি, এবার আর তোমার সেই সময় হবে না। বুঝতে পারছো?’
জামশেদ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। রিভলভারের ট্রিগারটা জামশেদের বুক বরাবর টানতে যাবে, এমন সময় ঠিক সামনে এসে দাঁড়লো অনন্যা। তারপর বললো, ‘ওকে মেরো না, দোহাই তোমার। ওকে মেরো না। ওকে আমি ভালোবাসি, প্রাণের চেয়েও বেশি।’
আশ্চর্য হলো ইরফান। বলে কি মেয়েটা! যে লোকটি তার জীবনের সবচেয়ে ক্ষতি করেছে তাকেই কিনা সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে? হ্যাঁ, বস ঠিকই বলেছে, তাকে সম্ভবত যাদুমন্ত্র করেছে জামশেদ। না হয় ওকে তার মতো করে গড়ে নিয়েছে। সেটা পরে দেখা যাবে।
এ সময় ইরফান অনন্যাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর জামশেদকে প্রশ্ন করলো ইরফান, ‘আমি তোমার কাছে তিনটা প্রশ্ন করবো। যদি উত্তর দাও, তাহলে তোমার জন্যই সুবিধা হবে। আর যদি উত্তর না দাও তাহলে বাকি দুটি গুলি তোমার বুক বরাবর চলবে।’
‘বলো।’
‘এমপি হত্যায় তোমার সাথে আর কোন্ কোন্ রাজনৈতিক নেতা ছিলো?’
‘বলবো না।’
ঠাস্ করে একটা শব্দ হলো। ইরফানের রিভলবারের গুলিটা জামশেদের অন্য হাতে লাগলো। উহ্, করে একটা শব্দ করলো জামশেদ। তারপর বললো, ‘বলছি বলছি।’
হঠাৎ করেই জামশেদ উঠে দাঁড়ালো এবং দ্রুতই ইরফানের হাতের পিস্তলটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। তারপর ইরফানকে জড়িয়ে ইরফানের নাকে মুখে ঘুষি চালাতে লাগলো। পর কয়েকটা ঘুষিতে ইরফান পড়ে গেলো ফ্লোরে। এবার দ্রুতই ইরফানের রিভলবরটা হাতে নিলো জামশেদ। তারপর বললো, ‘এবার বুঝতে পারছো? শয়তানের খেলা শেষরাতে।’ হাসতে লাগলো জামশেদ।
হাসি শেষে ইরফানকে বললো, ‘শেষ গুলিটা তোমার ভাগ্যেই আছে ইরফান। তবে তার আগে শুনে নাও। এই দেশে বসে আমি সব কলকাঠি নাড়ি, আর খুন হয় বাংলাদেশে। ওই জেলার রাজনৈতিক অনেক নেতাই চায় না এমপি ইমতিয়াজ তার রাজত্ব চালিয়ে যাক। সে ওই জেলার সব নেতার পদমর্যাদা কেড়ে নিয়েছে। তারা ইমতিয়াজের জন্যে সুবিধা করতে পারে না। তাই তারা আমাকে দুই কোটি টাকা দিয়েছে। আর আমিও চেয়েছি ইমতিয়াজের রাজত্বের অবসান হোক। তাই তাকে কলকাতায় নিয়ে নৃশংসভাবে মেরেছি। তাকে মারার আগে উলঙ্গ করে চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারপর তার হাত, পা, কান, বডি, মাথা কাটা হয়েছে। রিয়াজ কসাইকে দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে কেটে তাকে ব্লেন্ডার মেশিনে ব্লেড করা হয়েছে। হলুদ, লবণ-মরিচ মাখানো হয়েছে। তারপর তাকে বাথরুমের কমোডে ফ্লাশ করে দেওয়া হয়েছে। আরিয়ানা আমার বান্ধবী ছিলো, এই কাজে সে সহযোগিতা করেছে। তাছাড়া সেখানে আরো কয়েকজন সুন্দরী সিনেমার নায়িকাও ছিলো, যারা এর আগের রাতে ইমতিয়াজকে সঙ্গ দিয়েছে। বুঝতে পারছো ইরফান। মানুষের টাকা হয়ে গেলে বাকি থাকে ক্ষমতা। ক্ষমতা পেয়ে গেলে বাকি থাকে সুন্দরী সুন্দরী নারী। ওই ইমতিয়াজও সুন্দরী নারীদের দ্বারা শেষ অবস্থা মজে গিয়েছিলো।’ হাসতে লাগলো জামশেদ।
ইরফান দেখলো জামশেদের চারটি গুলির স্থান থেকেই কলকলিয়ে রক্ত পড়ছে। সে জানে জামশেদ আর বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। তাই তাকে কথায় কথায় ভুলিয়ে রাখতে চাচ্ছে।
‘আচ্ছা, শেষ গুলিটা তো তুমি আমাকে করবেই। ঠিক আছে মানলাম। একটা কথা জানার ছিলো। অনন্যাকে তুমি কীভাবে পটিয়েছো?’ প্রশ্ন করলো ইরফান।
‘আরে ওকে এই দেশের সেরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে মাথায় মাইক্রো চীপ বসানো হয়েছে। সে কমপক্ষে আধামাইল দূরে কী হচ্ছে তার সঙ্কেত পাবে এবং আমাকে জানাবে। এটা বলতে পারো বিজ্ঞানের একটা নতুন আবিষ্কার। এটা আমার টাকার জোরে সম্ভব হয়েছে। তোমরা বাংলাদেশের সিপাইরা এখনো টেকনোলজিতে বহু দূরে আছো। এসব বুঝতে পারবে না।’
এ সময় অনন্যা জামশেদের কাছাকাছি হলো। তারপর জামশেদকে ঢুলুঢুলু চোখে বললো, ‘ডার্লিং তুমি ওকে কেনো গুলি করছো। তুমি তো তাকে মারতে পারবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে সে তোমাকে শেষ গুলিটাই করবে।’
জামশেদ কিছু বোঝার আগেই কাণ্ডটা ঘটে গেলো। অনন্যা ছোঁ মেরে জামশেদের হাত থেকে রিভলবারটা কেড়ে নিয়ে ইরফানের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ইরফান সেটা দ্রুত হাতে নিয়ে জামশেদের বুকে গুলি চালালো।
জামশেদ পড়ে যাচ্ছে, আর অনন্যার দিকে তাকিয়ে আছে। ছটফট করতে করতে অনন্যাকে বললো, ‘আমার সন্তান কিন্তু তোমার পেটে আছে। তার যত্ন নিও।’ আর বেশি কিছু বলতে পারলো না, মাথাটা কাৎ হয়ে গেলো জামশেদের।
(চলবে)