মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫  |   ৩৫ °সে
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ০০:২০

বাংলা নববর্ষ আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের উৎসব

উজ্জ্বল হোসাইন
বাংলা নববর্ষ আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের উৎসব

বাংলা নববর্ষ, যাকে আমরা ভালোবেসে পয়লা বৈশাখ বলি, যা আমাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের দিন নয় বরং একটি আবেগ, একটি সংস্কৃতি, একটি ঐতিহ্য এবং জাতিগত পরিচয়ের প্রতীক। বৈশাখের প্রথম দিনটি বাঙালির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতির গৌরব এবং ঐক্যের প্রতীক। এ দিনটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের কাছেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা নববর্ষ, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ বাঙালিদের একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এর ইতিহাস অনেকটা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে জড়িত।

বাংলা সনের উৎপত্তি ও নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে মুঘল আমলে। বাংলা সনের সূচনা মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) হয়েছিল। মুঘলদের রাজস্ব আদায়ের জন্যে তারা হিজরি (চন্দ্রভিত্তিক) সন ব্যবহার করতেন। কিন্তু হিজরি সন চন্দ্র বছরের ওপর নির্ভর করায় তা কৃষিভিত্তিক সমাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। কারণ হিজরি বছর ১১ দিন ছোট হওয়ায় প্রতিবার রাজস্ব আদায়ের সময় কৃষকেরা ফসল তুলতে পারতো না। এই সমস্যা সমাধানে আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন সৌর সন চালু করেন, যেটি পরবর্তীতে বাংলা সন নামে পরিচিত হয়। এই সনের নাম হয় ফসলি সন বা তারিখ-ই-ইলাহী। মূলত ভারতবর্ষে ব্যবহৃত প্রচলিত সৌর পঞ্জিকা ও হিজরি সনের সমন্বয়ে এই নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। যদিও বাংলা সনের প্রবর্তন হয় ১৫৮৪ সালে, কিন্তু আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছর অর্থাৎ ১৫৫৬ সাল থেকেই এর গণনা শুরু হয়। সেই হিসেবে বঙ্গাব্দের প্রথম বছর হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ। আজকের বাংলা সাল গণনা এই পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই করা হয়। এই নববর্ষের দিনে হালখাতা নামে এক নতুন ব্যবসায়িক প্রথা চালু হয়, যেখানে পুরনো দেনা-পাওনার হিসাব মিটিয়ে নতুন খাতা খোলা হয়। এটি ছিলো মূলত ব্যবসায়িক লেনদেনের একটি পদ্ধতি, যা নববর্ষকে সাধারণ মানুষের জীবনের অংশে পরিণত করে।

ব্রিটিশ শাসনামলেও বাংলা সনের ব্যবহার বহাল ছিল, তবে পশ্চিমা পঞ্জিকার ব্যাপক প্রচলনের কারণে নববর্ষ উদযাপন কিছুটা কম গুরুত্ব পায়। তবে বাংলার গ্রামাঞ্চলে ফসলি বছরের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব থেকে যায়।

স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য বাঙালি সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টায় নববর্ষ পায় নতুন রূপ। রবীন্দ্রনাথের গান ও সংস্কৃতিচর্চা নববর্ষকে একটি সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করে। স্বাধীন বাংলাদেশে নববর্ষ হয়ে উঠে বাঙালির জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক।

১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়, যা ২০১৬ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ সম্রাট আকবর সিংহাসনে আরোহণ এবং ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন (তারিখ-ই-ইলাহী/ফসলি সন)। বাংলা সনের ব্যবহার কিছুটা কমে এলেও গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত ছিলো।

বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, এবং বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কৃষির একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। নববর্ষের সময়টিই ফসল ঘরে তোলার উৎসবের সময়। তাই কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রির পর এই দিনটিকে আনন্দ ও উৎসবের মধ্য দিয়ে উদযাপন করে থাকেন। হালখাতা, ব্যবসায়িক দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলা, এই দিনের একটি পুরানো রীতি। এতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে গ্রাহকদের সম্পর্ক নতুনভাবে গড়ে উঠে।

বাংলা নববর্ষের দিনটি শুরু হয় সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। অনেকেই স্নান করে নতুন জামাকাপড় পরে, মন্দিরে যায়, দেবদেবীর পূজা করে এবং শুভ কামনা করে দিনটি শুরু করে। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, লোকসঙ্গীত, পান্তা-ইলিশ, আর নানা রঙের পোশাকে বৈশাখের রঙ ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলা নববর্ষ শুধু একটি নতুন বছরের সূচনা নয়, বরং এটি বাঙালির চিরায়ত সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য এবং ধর্মনিরপেক্ষ আনন্দঘন সামাজিক উৎসব। নববর্ষের দিনে পালিত হয় নানা ধরণের রীতিনীতি ও আচার, যা শহর থেকে গ্রাম, ধনী থেকে গরিব—সবার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। দিনের শুরু হয় স্নান ও নতুন পোশাকে। নববর্ষের দিনটি শুরু হয় ভোরে উঠে স্নান করার মধ্য দিয়ে। অনেকেই মনে করেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে নতুন বছরের শুরু করলে সারাবছর ভালো যাবে। এরপর সবাই পরে নতুন বা পরিষ্কার পোশাক—প্রধানত নারীরা পরে লাল-সাদা শাড়ি, পুরুষরা পরে পাঞ্জাবি-পায়জামা। এই পোশাকের মধ্য দিয়ে বাংলার ঐতিহ্য ও রঙিন সংস্কৃতি প্রকাশ পায়। এই দিনে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশীদের সাথে শুভ নববর্ষ বলে কুশল বিনিময় করা হয়। সামাজিক সম্পর্ক মজবুত করার এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। অনেকে শুভেচ্ছা কার্ড বা এখনকার দিনে ডিজিটাল বার্তার মাধ্যমে শুভ কামনা জানায়।

বাংলা নববর্ষে ব্যবসায়ীরা তাদের পুরানো হিসাব শেষ করে নতুন হিসাব খাতা (হালখাতা) খোলেন। এই দিনে ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের মিষ্টি বা উপহার দিয়ে আপ্যায়ন করেন। এটি একটি লোকায়ত অর্থনৈতিক রীতি, যা ব্যবসায়িক সম্পর্ক মজবুত করে। বর্তমানে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার রীতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একটি বিশেষ খাদ্যসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই দিনকে ঘিরে, তা হলো পান্তা ভাত ও ইলিশ মাছ খাওয়া। পান্তার সঙ্গে থাকে মরিচ, পেঁয়াজ, আলু ভর্তা ইত্যাদি। যদিও এই রীতির উৎপত্তি কৃষক সমাজ থেকে এখন এটি শহরাঞ্চলেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলা নববর্ষের দিন বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। মেলায় পাওয়া যায় হস্তশিল্প, পুতুল, কাঠের খেলনা, মাটির জিনিস, বাউলগান, পুঁথিপাঠ, লাঠিখেলা, যাত্রাপালা ইত্যাদি লোকজ বিনোদন। এটি বাংলার লোকসংস্কৃতিকে জীবন্ত করে তোলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বিশাল আকৃতির মুখোশ, রঙিন ব্যানার, বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি নিয়ে শোভাযাত্রাটি বের হয়। এটি বাঙালির ঐক্য, শান্তি ও শুভবোধের প্রতীক। অনেকেই নববর্ষের সকালে মন্দিরে পূজা দেন, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই পরিবারের সাথে দোয়া করে দিন শুরু করেন। যদিও বাংলা নববর্ষ মূলত ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব, তবে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ধর্মীয় অনুভব যুক্ত করেন। নববর্ষের দিনটি ঘিরে আয়োজিত হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, আবৃত্তি, নৃত্যনাট্য, পথনাটক ইত্যাদি। বিশেষভাবে এসো হে বৈশাখ গানটি এই দিনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এসব আয়োজন বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয়। নববর্ষের আয়োজনে শিশু ও কিশোরদের জন্যে থাকে আলাদা আনন্দের ব্যবস্থা—মেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, রঙ খেলা, পুতুল নাচ, বেলুন, মুখোশ পরে ঘোরা ইত্যাদি। এতে করে তারা ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। অনেক পরিবার নববর্ষের আগে ঘরবাড়ি পরিষ্কার ও সাজসজ্জা করে। বাড়ির উঠোনে আলপনা অঁাকা হয়, অনেক সময় দড়িতে ঝুলিয়ে রঙিন কাগজের সাজসজ্জা করা হয়। এতে করে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়।

বাংলা নববর্ষের রীতিনীতি ও আচার শুধু একটি দিন উদযাপনের বিষয় নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। এসব আচার-অনুষ্ঠান আমাদের সমাজের সৌহাদর্য, সম্প্রীতি ও ঐক্যের বার্তা বহন করে। তাই এসব রীতিনীতিকে সম্মান জানিয়ে তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বঁাচিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

বর্তমান সময়ে নববর্ষ উদযাপনেও আধুনিকতার ছেঁায়া লেগেছে। ডিজিটাল মিডিয়া, অনলাইন প্রচার, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বৈশাখের শুভেচ্ছা আদান-প্রদান, ফ্যাশন ডিজাইন ও রঙে রঙিন জামাকাপড় নববর্ষকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তবে এই আধুনিকতার মধ্যেও লোকজ রীতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রয়াস লক্ষণীয়।

বাংলা নববর্ষ, বাঙালির প্রাণের উৎসব, তার ঐতিহ্যবাহী রূপ অক্ষুণ্ন রেখেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছে এক আধুনিক রূপ। নববর্ষ এখন কেবল গ্রামীণ বা লোকজ উৎসব নয়, বরং এটি শহুরে জীবনে, মিডিয়া, ফ্যাশন, প্রযুক্তি এবং অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আধুনিকতার ছেঁায়ায় বাংলা নববর্ষ যেমন আরও বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে, তেমনি কিছু পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জও এনেছে।

বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের একটি বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে মানুষ বৈশাখী শুভেচ্ছা বিনিময় করে, ছবি শেয়ার করে এবং লাইভ অনুষ্ঠান দেখে। আগে যেখানে নববর্ষে হাতে লেখা শুভেচ্ছাপত্র চালু ছিল, এখন সেটি স্থান দিয়েছে ডিজিটাল গিফ্ট, এনিমেশন, স্ট্যাটাস ও ভিডিও শুভেচ্ছাকে। অনেকে ঘরে বসেই অনলাইনে বৈশাখী গান, নাটক ও মেলা উপভোগ করেন।

এই দিনটি ঘিরে বৈশাখী ফ্যাশনে এসেছে আধুনিক ছেঁায়া। নববর্ষ উপলক্ষে এখন দেশজ ফ্যাশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক নকশা, ব্র্যান্ডিং ও বাণিজ্যিক উপস্থাপন।

বিভিন্ন নামকরা ফ্যাশন হাউস বৈশাখ উপলক্ষে লাল-সাদা পোশাকের নতুন ডিজাইন বাজারে আনে। এতে দেশীয় তঁাতের কাপড়, ব্লক প্রিন্ট, এবং লোকজ মোটিফের আধুনিক রূপ দেখা যায়। আধুনিক বৈশাখী সাজে হাতে তৈরি গয়না, পুঁতির মালা, কঁাসার কানের দুল, ফুলের টিকলি ইত্যাদি তরুণ-তরুণীদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয়।

মিডিয়া ও জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে নববর্ষ এখন টেলিভিশন, রেডিও, সিনেমা ও অনলাইন কনটেন্টে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে বৈশাখ উপলক্ষে নাটক, গান, কবিতা, নাচের অনুষ্ঠান প্রচার হয়। বৈশাখকেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনে উঠে আসে ফ্যাশন, খাবার, ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতিযোগিতা। নববর্ষ কেন্দ্রিক সিনেমা/সিরিজ কিছু নাটক বা ওয়েব সিরিজের প্লটেও বৈশাখকে উপজীব্য করা হয়।

নববর্ষ এখন একটি বড়ো বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পণ্য বাজারজাতকরণে, হোটেল-রেস্তোরঁা, অনলাইন শপিং ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে বৈশাখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বৈশাখী ছাড় ও অফার-দোকানপাট, অনলাইন মার্কেটপ্লেস ও ব্র্যান্ডগুলো বিশেষ ছাড় ও নতুন কালেকশন নিয়ে আসে। রেস্তোরঁাগুলোতে বৈশাখী স্পেশাল মেনু থাকে পান্তা-ইলিশ, দেশি খাবার ও নকশাদার পরিবেশনা।

নগরজীবনে আয়োজনের পরিবর্তন চোখে পড়ে যেমন, শহরের রাস্তাঘাটে, বিশেষ করে ঢাকার রমনা, টিএসসি, চারুকলা প্রাঙ্গণ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রভৃতি শহরে বড়ো পরিসরে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান নিজেদের কর্মস্থলে আয়োজন করে বৈশাখী মেলা ও কালচারাল প্রোগ্রাম।

আধুনিকতা যেমন নববর্ষকে নতুনত্ব দিয়েছে, তেমনি কিছু চ্যালেঞ্জও এনেছে।  কিছু ক্ষেত্রে উৎসবের মূল উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যায় পোশাক, খাবার বা সাজসজ্জার প্রতিযোগিতা। এতে মূল সংস্কৃতি হারিয়ে যায়। অনেক সময় লোকজ গান, আবহমান রীতিনীতির জায়গা দখল করে নেয় পশ্চিমা বা অপ্রাসঙ্গিক বিনোদন।

বাংলা নববর্ষের আধুনিকতা আমাদের সংস্কৃতিকে বিস্তৃত করেছে, দিয়েছে গতি ও নতুন এক অভিব্যক্তি। তবে এই আধুনিকতার মধ্যে আমাদের উচিত ঐতিহ্যের মূল সুরটিকে ধরে রাখা। প্রযুক্তি ও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নববর্ষ উদযাপন করলেও, এর শেকড় যেন থাকে মাটির কাছেই। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এ মেলবন্ধনই বাংলা নববর্ষকে যুগোপযোগী করে তুলেছে। নববর্ষ উদযাপনের কারণে বিপণন খাত, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি, খাবার খাতসহ অনেক অর্থনৈতিক খাতে চাঙ্গাভাব দেখা যায়। অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে নিজেদের পণ্যের প্রচার ও বিক্রয়ের সুযোগ পান। এই দিনটি বাঙালি সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুযোগও তৈরি করে।

যদিও নববর্ষ আমাদের গৌরবের বিষয়, তবুও এ উৎসবের বিকৃতি ঘটছে কিছু জায়গায়। অতিরিক্ত ভোগবাদিতা, অশালীনতা, পরিবেশ দূষণ, কিংবা ঐতিহ্যের নামে বাড়াবাড়ি–এসব অনেক সময় নববর্ষের মূল চেতনাকে আঘাত করে। আবার কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠী এই উৎসবের বিরোধিতা করে, যেটি বাঙালির সার্বজনীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যায়।

বাংলা নববর্ষকেন্দ্রিক উৎসব আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন এবং জাতিগত স্বকীয়তার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।

বাংলা নববর্ষ, পয়লা বৈশাখ এমন একটি উৎসব, যা ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি ও রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলিয়ে বাঙালিদের এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক ছাতার নিচে একত্রিত করে। এই দিনটির মধ্য দিয়ে বাঙালির ঐতিহ্য, চেতনা, সংস্কৃতি এবং জাতীয় পরিচয়ের প্রকাশ ঘটে। বাংলা নববর্ষ উদযাপন হলো বাঙালি সংস্কৃতির শেকড়ে ফেরার দিন। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বাঙালির হাজার বছরের লোকজ সংস্কৃতি, পোশাক, খাদ্য, সংগীত, শিল্পকলা ও ভাষার প্রকাশ ঘটে। বৈশাখী মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, লোকসংগীত, পান্তা-ইলিশ খাওয়া—এসবই এক গভীর সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ।

বাংলা নববর্ষ একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব, যা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষ একসাথে পালন করে। এটি এমন একটি দিন, যেখানে ধর্ম নয়, সংস্কৃতি মুখ্য। এর ফলে এই উৎসব জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে দঁাড়িয়েছে। বাংলা নববর্ষের উদযাপন ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানি শাসনামলে যখন রবীন্দ্রসংগীত ও বাংলা ভাষা সংকুচিত করার চেষ্টা হয়, তখন এই উৎসব হয়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের অস্ত্র। পরবর্তীতে নববর্ষ উদযাপন জাতীয় পরিচয়ের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গে পরিণত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ একটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দিন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই দিনটিতে ছুটি ঘোষণা করে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এমনকি ২০১৬ সালে ইউনেস্কো যখন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তখন তা বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতিকে আরও দৃঢ় করে।

বাংলা নববর্ষ এমন একটি উৎসব, যা শহরের উচ্চশ্রেণি থেকে শুরু করে গ্রামের কৃষক পর্যন্ত সবাই উদযাপন করে। এটি সমগ্র জাতির সংস্কৃতির একটি সমন্বিত রূপ, যা বাঙালি জাতির চেতনার মূল ভিত্তি গড়ে তোলে।

এই উৎসবের মাধ্যমে বাংলা ভাষা, কবিতা, সংগীত, নৃত্য এবং লোকজ শিল্পের সংরক্ষণ ও চর্চা হয়। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, বাউলগান—সবকিছু মিলিয়ে এই উৎসব হয়ে উঠেছে আমাদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক শক্তিশালী প্রকাশভঙ্গি। নববর্ষ উপলক্ষে স্কুল-কলেজে যেসব সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয়, তাতে অংশগ্রহণ করে নতুন প্রজন্ম। তারা গান গায়, কবিতা আবৃত্তি করে, মেলা ঘোরে, ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। এর ফলে তারা ছোটবেলা থেকেই শেখে— আমি বাঙালি, আমার একটা আলাদা জাতীয় পরিচয় আছে।

বাংলা নববর্ষ কেবল একটি ক্যালেন্ডারভিত্তিক উৎসব নয়, এটি একটি জাতিগত আত্মবোধের দিন। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা ধর্মে বিভক্ত হলেও সংস্কৃতিতে এক। বাংলা নববর্ষ তাই আমাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক, ঐক্যের ভিত্তি, এবং সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের প্রেরণা। এই উৎসব উদযাপন করেই আমরা বিশ্বের কাছে গর্ব করে বলতে পারি আমি বাঙালি।

বাংলা নববর্ষ আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির শিকড়কে সুদৃঢ় করেছে। নববর্ষ উদযাপন কেবল আনন্দ আর উৎসব নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভাষা ও আত্মপরিচয়ের উৎসব। তাই এ ঐতিহ্যকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রক্ষা ও সমুন্নত রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক, চঁাদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়